ছোটবেলায় বড় বোন তাঁকে
উৎসাহ দিতেন ডাক্তার হওয়ার জন্য। অন্যদিকে বড় ভাই চাইতেন
ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। কিন্তু কোনোটাই তিনি হতে পারলেন না। কলেজজীবনে রাজনীতির সাথে খুব বেশি জড়িত থাকাতে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া আর হলো না
দেলোয়ার হোসেন ফারুকের। হয়েছেন আইটি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসাকে বেছে নিলেন।
দৈনিক আমাদের কাগজ এবং সাপ্তাহিক সংবাদের অন্তরালের সম্পাদক ও প্রকাশক, আতাকরা
হাইস্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা
ও চেয়ারম্যান, র্যাডিসন ডিজিটাল
টেকনোলজিস লি.,র্যাডিসন বিল্ডারস
ও হাউজিং লি., এবং পরিবর্তন ফাউণ্ডেশন নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ফারুক।
সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত দেলোয়ার হোসেন ফারুক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধারণ করেন মননে। লালন করেন তাঁর নীতি-আদর্শকে। মনেপ্রাণে ভালোবাসেন আওয়ামী লীগকে। তাই ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে পথ চলা তার।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক ও
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং লাকসাম উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ছিলেন।
দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবায় স্থানীয়
বাজার সম্প্রসারণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে
রপ্তানি শক্তিশালী করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশেন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড
ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর স্ট্যান্ডিং কমিটি
অন মেম্বার ওয়েলফেয়ারের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সাথে
তাঁর সাথে আড্ডা জমে রাজধানীর কারওয়ান বাজারস্থ রেডিসন ডিজিটাল টেকনোলজি লিমিটেডের অফিসে। তার বর্ণাঢ্য জীবনের নানান দিক নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন তিনি।
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার আতাকরায় জন্ম দেলোয়ার হোসেন ফারুকের। পিতা সিরাজুল হক, মাতা আমেনা বেগম। দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। শৈশব ও কৈশোর কাটে
তার লাকসামে। প্রাইমারি পর্যায়ের পড়ালেখা করেন আতাকরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হাইস্কুলও নিজের এলাকায় আশিরপাড় উচ্চবিদ্যালয় থেকে। পড়াশুনায় বরাবরই প্রথম সারির ছিলেন তিনি। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কুমিল্লা বোর্ডে এসএসসি ও এইচএসসিতে স্টার
মার্কসসহ কৃতিত্বের সাথে পাস করেন।এর পরে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা কলেজ থেকে গণিতে স্নাতোকোত্তর করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হেলথ ইকোনোমিকসে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
কলেজে রাজনীতির প্রতি টান কেন অনুভব করতেন, আগে কি রাজনীতি করার
স্বপ্ন দেখতেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ফারুক বলেন, স্কুলজীবন থেকে ক্লাসে ফার্স্টবয় থাকার সুবাদে ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্বও পালন করেছি একেবারে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। সেই সুবাদে ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে আমি একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানে প্রথম বক্তব্য দেই। তখন থেকেই নেতৃত্বের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল। মনে মনে রাজনীতি করার স্বপ্ন দেখি। মূলত নেতৃত্বের প্রতি দুর্বলতা থেকেই রাজনীতিতে আসা।
জানতে চাওয়া হয়, আপনি তো সক্রিয়ভাবে ছাত্ররাজনীতি
করেছেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক ও
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্ররাজনীতি জীবনের স্মরণীয় কোন ঘটনার কথা কি মনে পড়ে?
জবাবে ফারুক বলেন, এমন তো অনেক ঘটনাই
আছে। রাজনীতি করতে গিয়ে জেল খেটেছি, বিরোধীদের নির্যাতন সহ্য করেছি। একটা ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে। ২০০২ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে আমি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। এটা সিনিয়র অনেকেই মেনে নিতে পারে নাই। আবার আমি ছাত্রদলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিয়মিত ক্যাম্পাসে যেতাম। এতে ছাত্রদল আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়।
পরবর্তীতে আমার সংগঠনের দুই-একজনের সহযোগিতায় আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে ২০০২ সালের অক্টোবর হাতিরপুলে আমার বাসার সামনে আক্রমণ করে। তবে উপস্থিত মানুষের চিৎকারে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। আমাকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়। অনেকে ভেবেছিল আমি মারা যাবো। হাসপাতালে আমাকে দেখতে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। নেত্রী আমাকে দেখতে যাওয়ার পরেই কাকতালীয়ভাবে আমার শারীরিক অবস্থা অনেক উন্নতি হয়। কিছু দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাই। এটা আমার ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার শুরুর গল্পটা জানতে চাইলে তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, আমি মূলত ব্যবসা শুরু করেছি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন থেকে। মাস্টার্স পাস করা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসায় ছোট ছোট পুঁজি বিনিয়োগ করে সফল হতে পারিনি। আইসিটি সেক্টরে ব্যবসা শুরু করেছি আইএসপি দিয়ে। প্রথমে এক রুমের একটি
অফিস থেকে আজকের এই জায়গায় এসেছি।
আমি ছাত্র থাকা অবস্থায় কখনোই চাকুরি করার কথা ভাবতাম না। সব সময় ভাবতাম
নিজেই এমন কিছু করবো, যাতে অন্যদের সহযোগিতা করা যায়।
ব্যবসার শুরুতে কি ধরনের সমস্যার
মুখোমুখি হয়েছেন জানতে চাইলে ফারুক বলেন, আমি জীবনে অনেক ব্যবসা করেছি। তাই শুরুর গল্পটা আমার কাছে বিভিন্ন রকমের। ব্যবসা শুরুর সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল
পুঁজির অভাব। পুঁজি নাই তো অফিস নাই।
অফিস নাই তো কর্মী আসবে
কোথা থেকে? আস্তে আস্তে সব কিছুই হলো।
একেবারে প্রথম দিকে ব্যবসা শুরু করতাম আর লস খেতাম।
আবার কিছু দিন বসে থাকা। আমার নতুন করে শুরু করা। এভাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত করেছি।
সেদিনগুলোর কথা বলুন যখন এই ব্যবসাটাকে ধরে
রাখতে অপনাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।
অদম্য তরুণ ব্যবসায়ী বলেন, আসলে ব্যবসা ধরে রাখার সংগ্রাম সেই প্রথম থেকে এখনও করছি। ব্যবসা ধরে রাখা প্রত্যেক ব্যবসায়ীর কাছে একরকম সংগ্রাম। আমি যেহেতু একই সাথে ব্যবসা করি, রাজনীতি করি আবার সামাজিক কাজকর্ম করি, সুতরাং আমার কাছে এই সংগ্রাম আরো
বেশি। আর আইসিটি সেক্টরে
ইঞ্জিনিয়ারদের মেইনটেইন করাই খুবই কষ্টকর। আমার পরিশ্রম মেধা আর সততা প্রতিনিয়ত
এই সংগ্রাম আমাকে জয়ী হতে সহযোগিতা করে।
কুমিল্লার লাকসামে তিনি নিজ উদ্যোগে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত কলেজের সাফল্যও বলার মতো। সবচেয়ে বড় বিষয় তার
কলেজে পড়াশুনা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করানো হয়। এবিষয়ে তিনি বলেন, আমার আতাকরা এক সময় ছিল
লাকসামের একটি অবহেলিত জনপদ। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সব দিক দিয়ে
অবহেলিত ছিল। আমি অনার্স প্রথম বর্ষ পড়াকালীন থেকে এলাকার উন্নয়নের কাজ শুরু করি। বলতে পারেন আমার রাজনীতি ব্যবসা এ সকলই করেছি
আমার এলাকার উন্নয়নের জন্য। উন্নয়ন করতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে তরুণ যুবসমাজ ও নারীদেরকে শিক্ষিত
না করলে এ সমাজের উন্নয়
সম্ভব হবে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই গরিব জনগোষ্ঠীকে
শিক্ষিত করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এবং বিনামূল্যেই তা সকলের কাছে
পৌঁছে দিতে হবে। আর সেই কারণেই
এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও লাকসামে একটা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতোমধ্যেই কারিগরি শিক্ষাবোর্ড থেকে অনুমতি নিয়েছি। আশা করি খুব শিগগিরই এটির কার্যক্রম শুরু হবে।
পরিবর্তন ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও-এর মাধ্যমে বিভিন্ন
সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন তিনি। কেমন ধরণের কাজ করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে সমাজসেবক বলেন, পরিবর্তন ফাউন্ডেশন মূলত একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এই সংস্থায় আমার
সাথে আরো অনেকেই আছে। এই সংস্থা মানুষের
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেনিটেশন ও মাদকের কুপ্রভাব
সম্পর্কে সচেতন করার কাজ করে।
আপানি তো এক যুগেরও
বেশি সময় ধরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট আছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইসিটি খাতের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন। এবিষয়ে ফারুক বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সফটওয়্যার, ই-কমার্স এবং
আইটিএস খাতের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এই খাতে বিশ্বজুড়ে
হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। দেশে ভালো মানের সফটওয়্যার নির্মাতাদের যদি প্রমোট করা যায় তবে গার্মেন্টের পরেই বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে অন্যতম খাত হতে পারে এটি। ১৬ কোটি মানুষ
মানে ১৬ কোটি ভোক্তা।
সুতরাং ই-কমার্সেও আমাদের
দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। আমি আশাবাদী, ভাল কিছু করা সম্ভব। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে ‘ভিশন২০২১’
ঘোষণার পর আমরা দেখতে
পাচ্ছি কত দ্রুত বাংলাদেশ
এগিয়ে যাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ী বলেন, বেসিস তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত সংগঠন। বেসিস নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গন সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বেসিস মূলত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। এটি হচ্ছে দেশীয় সফটওয়্যার, ই-কমার্স এবং
তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক
সেবা (আইটিএস) খাতের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন।
সম্প্রতি দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবায় স্থানীয়
বাজার সম্প্রসারণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে
রপ্তানি শক্তিশালী করতে বেসিসের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন মেম্বার ওয়েলফেয়ারের
চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ফারুক। এবিষয়ে তার পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের `স্ট্যান্ডিং কমিটি অন মেম্বার ওয়েলফেয়ার’
কমিটির প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে বেসিসের সদস্যদের কল্যাণ তহবিলের ফান্ড বৃদ্ধি করা। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে এই কল্যাণ তহবিলের
মাধ্যমে প্রত্যেক সদস্যদের পাশে থাকার। বেসিসের সম্মানিত সদস্যদের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া আমাদের কার্যনির্বাহী পরিষদের একার পক্ষে এই লক্ষ্য কবাস্তবায়ন
সম্ভব না। সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব হবে বেসিসের সদস্য কল্যাণ তহবিলের ফান্ড বৃদ্ধি করা। তাই সব সদস্যদের এই
কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
আপনার র্যাডিসন ডিজিটাল
টেকনোলজিস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি দেশের আইসিটি খাতে কী অবদান রাখছে
জানতে চাইলে তিনি বলেন, র্যাডিসনডিজিটাল টেকনোলজিস
লিমিটেড মূলত একটা সফটয়্যার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আমরা আইটি সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে বেকার যুবসমাজকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি।
নিউজটি বিবার্তায় প্রকাশ হয়েছে। মূল নিউজটি দেখতে ক্লিক করুন এ লিংকে।