দেশের প্রথম আরজে (রেডিও জকি) নীরব খান। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় এফএম রেডিও স্টেশন। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন এরশাদের (সাবেক রাষ্ট্রপতি) মতো হওয়ার। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি হয়েছেন দেশের সেরা আরজে।
জীবনের শুরু থেকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। একাধারে সফল আরজে, নিউজ প্রেজেন্টার, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার, অভিনেতাসহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এফএম রেডিও’র প্রতিষ্ঠাতা ও আরজে নীরব।
বর্তমানে CITYFM 96 রেডিও স্টেশনের প্রধান প্রোগ্রামার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। একইসাথে তিনি বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশনের প্রোগ্রাম, নাটক ও অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত।
সম্প্রতি আড্ডা জমে রাজধানীর বাংলামটর CITYFM 96 রেডিও স্টেশনের অফিসে। আরজে নীরব তার জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন টেকভয়েস২৪-এর প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজের সাথে। আজ আপনাদের শোনাবো নীরব থেকে আরজে নীরব খান হয়ে ওঠার গল্প। নীরবের জবানিতেই শোনা যাক সেই কাহিনী-
আমার জন্ম হয়েছে রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায়। সেখানে বিদ্যুৎ গেছে মাত্র কয়েক বছর আগে। ভাঙাচোরা রাস্তা-ঘাট মিলিয়ে এক কথায় যাকে বলে অজপাড়া গাঁ।
ওই রকম একটা পরিবেশে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি মাছপাড়া কলেজে। গ্রামের অতি সাধারণ একটা বেসরকারি কলেজ। চাটের বেড়া, ভাঙা বিল্ডিং, ভাঙা টিনের শেড। দেখা যেত ক্লাসে স্যার যখন প্রথম বেঞ্চের এক পাশ থেকে বেত মারা শুরু করতেন, আমরা তখন পেছনের ভাঙা বেড়া দিয়ে দৌড়ে পাটের খেতে চলে যেতাম।
আমি ইংরেজি আর অংকের জন্য অনেক মার খেতাম। তখন আমার আব্বা স্কুলে গিয়ে স্যারকে এই কথা বলতেন যে, পড়ালেখা ঠিকমতো না করলে মাইরা হাড্ডি-গুড্ডি ভাইঙা ফেলবেন আর মাংসটা আলাদা করে রাখবেন।
পড়ালেখা কামাই করেছি, তারও কিছু কারণ ছিল। কারণটা হচ্ছে আমি ছোট বয়সেই কিছু সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে যাই। যদি ক্লিয়ারলি বলি তাহলে এটা হবে যে, আমাদের যশোর এলাকায় বামপন্থি রাজনীতি ছিল। যারা বিশ্বাস করে যে অস্ত্র দিয়ে সমাজের সব কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব। আমার আব্বাও জাসদের রাজনীতি করতেন। জাসদের মূলনীতি ছিল যে, সারা পৃথিবীর ধনী-গরিব সবাই সমান।
তখন আমি অনেক ছোট। ক্লাস এইট/নাইনে পড়ি। তখন কার্লমার্কসের দ্বারা অনেকেই বেশ প্রভাবিত হয়েছিল। আমিও তখন ওই রাজনীতিতে জড়িয়ে যাই। মনে হয়েছে দেশে গরিব মানুষ কেন থাকবে। আর কোনো কারণ ছাড়াই কেন বড়লোক হবে। সেখান থেকে উঠে আসতে আমার অনেক সময় লাগছে। এটা ছিল একটা লং জার্নি। নিজেকে পরিবর্তন করতে নিজের সাথে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাছাড়া পরিবারেরও চাপ ছিল।
আমার আব্বা পলিটিক্যাল নানা করাণে অনেকবার জেল খেটেছেন। অনেকবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মজার বিষয় হলো আমার আব্বা-আম্মু দু’জনই মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তাদের প্রথম দেখা, পরিচয় তারপরে বিয়ে। বড় ভাই হওয়ার পর আব্বা জেলে ছিলেন ৮ বছর। পরিবার শুরু হয় কষ্ট আর দৈন্যদশা নিয়ে। নানা সমস্যা ছিল আমাদের পরিবারে। এসব সমস্যা এক সময় শেষ হয়।
এরই মধ্যে আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। আমার বয়স তখন ১৭ বছর ৬ মাস। আমার রেজাল্ট ভালো ছিল। এটা ছিল আমার জন্য গুড পয়েন্ট। গ্রামে আমি যা-ই করি না কেন পড়ালেখায় এসএসসিতে আমি আমার থানার মধ্যে প্রথম হয়েছি। এইচএসসিতেও জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলাম। এটা ছিল আমার জন্য খুবই ইতিবাচক।
যখন আমি প্রথম ঢাকায় আসি, তখন আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে ১৫০০ টাকা নিয়েছিলাম। এটা আমার স্পস্ট মনে আছে। বিনা কারণে নয়, পড়ালেখার জন্য। ভর্তি হই ঢাকা ইউনিভার্সিতে। পড়ালেখা কলেছি, আরো কত কী করছি...।
আমার প্রথম কাজ ছিল পত্রিকায় কনট্রিবিউটিং। মনে আছে পুরো এক মাস কাজ করে পাই মাত্র ৩০০ টাকা। আমি ভাগ্যবান। কারণ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতি সাংবাদিকাতায় পড়ালেখা করার ফলে আমার কাজের সুযোগ ছিল বেশি। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকাতায় অনার্স ও মাস্টার্স করি। আর তাই সম্মানের জায়গাটাও পেয়েছিলাম।
এই জায়গাটা তো এমনিতে হয়নি। এক সময় আমার স্বপ্নই ছিল আমি ৮ হাজার টাকা বেতনের একটা চাকরি করব। মাসে ৫ হাজার টাকা যাবে বাসা ভাড়া, বাকি ৩ হাজার টাকা দিয়ে সুন্দরভাবে চলে যাবে আমার ছোট্ট সংসার। এটাই হবে আমার ঢাকার লাইফটাইল।
ওই স্বপ্ন নিয়েই পত্রিকায় কাজ করি। শুরু করি দৈনিক ইত্তেফাকে। তারপরে বিনোদন, বিনোদন থেকে আসি ভোরের কাগজে। সেখানে বছর দুয়েক কাজ করার পরে চলে গেলাম মানবজমিন পত্রিকায়। ওইখান থেকে আসি রেডিওতে।
ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও আমি ঢাকা ইউনিভার্সিতে বিতর্ক প্রতিযোগিতা করতাম। মহসিন হলের তখন সেক্রেটারি ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন সেরা বিতার্কিকের মধ্যে আমি একজন ছিলাম।
এটা ছিল আমার জীবনের জন্য বড় মাইলফলক। ভালো ফিডব্যাক পেয়েছি। তখন রেডিও'র জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজা হচ্ছিল কে শুদ্ধ বাংলায় সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তারপরে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক করে তাদেরকে ডাকা হলো।
২৮দিনের প্রশিক্ষণের পর আমরা পাঁচজন নির্বাচিত হয়েছিলাম। আর ঘটনাক্রমে হোক বা যোগ্যতার করাণেই হোক বাংলাদেশের এফএম রেডিও’র প্রথম আরজে হই আমি। এটা আমার জীবনের একটা বিশেষ প্রাপ্তি।
তবে আমার সাথে অরো পাঁচজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তারা অবশ্য পরে কেউ আর থাকেনি। তারপরে আমি আসি এবিসি রেডিওতে। সেখানে কাজ করি কিছুদিন। একপর্যায়ে এবিসি রেডিও বিক্রি করে দেয়া হলো।
এরপর আমি জয়েন করি রেডিও টুডেতে। তখনও এটা শুরু হয়নি ভালো করে। সেখানে গিয়ে দেখি ২৪ ঘণ্টার প্রোগ্রামের মধ্যে সব ভালো ভালো জায়গাগুলো বুক হয়ে গেছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমি পেলাম রাতের প্রোগ্রামটা। প্রোগ্রামের জন্য সবচেয়ে বাজে সময় হচ্ছে রাত। আর ভালো সময় বিকেল। আমার কপালে জুটলো রাতের অনুষ্ঠান। মেনে নিলাম এবং অনুষ্ঠান করতে শুরু করলাম।
জীবনে যত জ্ঞান অর্জন করেছি সব দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এভাবেই এক বছর চলে যাচ্ছে। অথচ ম্যানেজম্যান্ট আমাকে বুঝতে পারছে না। আমার কাজের কোনো মূল্যায়নও করছে না। তারা আমাকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা করছে। তখন ঢাকা রেডিওর ম্যানেজমেন্ট একটা জরিপ করে। জরিপে বেরিয়ে আসে ৬৫ ভাগ মানুষ আমার প্রোগ্রাম শোনে।
প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। একশ কিলোমিটার এরিয়ার মধ্যে ২ কোটি মানুষ আমার গ্রোগ্রাম শোনে। এটা বিশাল ব্যাপার। ঠিক পরের দিন প্রতিষ্ঠান আমার বেতন ডাবল করে দিল। যেদিন আমার চাকরি চলে যাওয়ার কথা, সেদিন আমার বেতন হলো ডাবল। এই অনুভূতিটা প্রকাশ করা যায় না। শুধু অনুভবের বিষয়। কারণ আমি সারা রাত জেগে প্রোগ্রাম করছি আর আমি জানি না যে আমার কাজের ফিডব্যাকটা কী।
এরপর আমি রেডিও টুডেতে ছিলাম ৫ বছর। ৫ বছরে ৫টা ঈদ আমি ঢাকায় করেছি। প্রতিদিন আমি অনুষ্ঠান করেছি। আমি একটা দিনও ছুটি নিইনি। আমি শুধু প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে গেছি। আমি কাজকে ভালোবাসি। আমার কাজের যোগ্যতা দেখে মাত্র ২৬ বছর বয়সে এফএম রেডিওতে হেড অব প্রোগ্রামার বা অনুষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছে। এটা আমার জন্য অনেক বড় সম্মানের ছিল।
রেডিও টুডে ছাড়ার পর ৩ বছর নাটক নিয়ে পড়েছিলাম। নাটকের ইন্ধনদাতা হচ্ছেন চয়নিকা চৌধুরী। একটা সিরিয়াল দিয়ে শুরু। ২০০৯ সালের কথা। এন টিভিতে সেটা ছিল আমার প্রথম কাজ। এরপর থেকে তো নাটক করে যাচ্ছি। প্রায় শ’খানেক নাটকে এ পর্যন্ত কাজ করেছি। বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ অভিনেত্রীর বিপরীতে আমি কাজ করেছি।
বর্তমানে আমি আড়ালে-আবডালে কম টাকায় টিভি বিজ্ঞাপন বানাচ্ছি। নাম ছাড়া। কেউ জানে না কে বানাচ্ছে। আমি চাই দর্শকরা দেখুক। প্রচার হোক।
রেডিও টুডে ছাড়ার পর এখানে CITYFM 96 রেডিও এফএম এ জয়েন করি প্রাধন অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে। আমি জোর গলায় বলতে পারি রেডিও এফএম জগতে আমার চেয়ে বড় কেউ আর নেই। কেউ আমার চেয়ে বেশিও জানে না। কারণ এফএম রেডিও শুরু হয়েছে আমার হাতে, পথ চলেছে আমার সাথে আর যত প্যাটার্ন বদল হয়েছে তাও করেছি আমি নিজেই।
ছোট বেলায় আপনি কি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
এরশাদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম আমি। অমি যখন ছোট ছিলাম তখন এরশাদ দেশ পরিচালনা করতেন। তাই আমার খুব শখ হতো রাজনৈতিক নেতা হবো। এরশাদের নীতিটা আমার ভালো লাগতো। একজন ভুল করলে অল্প ভুল। একাই যে সিদ্ধান্ত নেন তাই ঠিক। দেশকে বদলাতে হলে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। পাঁচজনকে খুশি করা যয় না। তাই এক নায়কতস্ত্রের মাধ্যমে দেশে শাসন ব্যবস্থা ভালো থাকে। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। হলাম আরজে।
আরজে বা রেডিও জকি শব্দটির অর্থ কী?
জকি হচ্ছে ড্রাইভ করা। যেমন একজন ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভ করে। জকি হলো ঠিক তেমন বিষয় যে রেডিও ড্রাইভ করে। বংলাদেশ বেতার বা অন্য যে কোনো বেতারে একটা রেডিও চালানোর জন্য ১০০ জন কর্মী দরকার হয়। সেখানে এফএম রেডিও চালায় মাত্র একজন। একজন আরজে টেকনিশিয়ান, গান বাজানো, উপস্থাপনা, শো করা সবই একা করে। তাই একে রেডিও জকি বলা হয়।
আরজে হতে হলে কী কী যোগ্যতা দরকার হয়?
সাবলীলভাবে সঠিক বাংলায় কথা বলা, শুদ্ধ উচ্চারণে গুছিয়ে কথা বলা, মানুষকে কথা দিয়ে মুগ্ধ করার মতো দক্ষতা। আমি এ পর্যন্ত শুধু শেখার জন্য ৫৫টা কোর্স করেছি। শিখেছি কিভাবে কম কথা বলতে হয়। সুন্দর করে বলতে হয়।
এ পর্যন্ত কতগুলো শো করেছেন?
টেলিভিশন শো যদি বলি প্রতি সপ্তাহে থাকে আমার ৩টা। গত ৭ বছরে আমি শো করেছি ১২শ’র মতো।
কতগুলো পুরস্কার পেয়েছেন?
সেরা উপস্থাপক, সেরা আজে, সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছি ৬০টির বেশি।
এই পেশার (আরজে) সম্ভাবনা কেমন?
অনেক ভালো। অন্য পেশায় শুরুতে বেতন দেয় ১০ হাজার টাকা। এখানে শুরু হয় ১৫ হাজার দিয়ে। এখানে কাজ করার অনেক জায়গা রয়েছে। যারা আসতে চায় তাদের আমি আমন্ত্রণ জানাই।
জীবনে কখনও কি খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়েছেন?
অনেকবার পড়েছি। আমি আমার বয়সী অনেক মানুষের চেয়ে অনেক খ্যাতি পেয়েছি। তাতে হয়েছে কি ওই যে একটা জোক বলে না- বাঙালির দোজখের গেটে দারোয়ান লাগে না। কারণ একজন বেরুতে গেলে আরেকজন টান দিয়ে ধরে রাখে। আমার পেছনেও অনেক লেগেছে। এটাকে আমি কিছু মনে করি না। আমার মতো করে আমি চলছি।
ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কী?
বাবা হতে চাই। রিয়েলি বাপ হওয়ার স্বপ্ন দেখি আমি। বাবা হওয়ার বিষয়টা কিন্তু বিশাল একটা দায়িত্বের। আমরা তো মনে করি সংসার করবো, একটা বাচ্চা নেব। বাবা-মায়ের দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। আগামী প্রজন্মের জন্য আদর্শ করে রেখে যাওয়া।
আপনার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
আমার আব্ব-আম্মা, ভাইয়া আর ভাবি। এই নিয়ে আমার পারিবারিক জীবন। আব্বা-আম্মা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আব্বা পাংশা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সভাপতি।