''ছোটবেলায় বাবা-মা চাইতেন, বড় হয়ে আমি যেন ডাক্তার হই। আমি চাইতাম বিজ্ঞানী হতে আর স্বপ্ন দেখতাম নিজের একটা ল্যাব প্রতিষ্ঠার। ল্যাবে নতুন নতুন উদ্ভাবন করবো। সেখানে অনেক তরুণ-তরুণী এসে এক সাথে উদ্ভাবনী কাজ করবে।''
কথাগুলো বলেন প্রেনিউরল্যাবের প্রধান নির্বাহী আরিফ নিজামী।
হয়েছেও তাই। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তরুণ এই প্রকৌশলী নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন প্রেনিউরল্যাব। অর্থ, মেধা, ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের প্রযুক্তি খাতে অবদান রাখতেই তিনি গড়েছেন এ ল্যাব। এর মধ্য দিয়ে শৈশবের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এই তরুণ উদ্যোক্তার। আর এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন হাজার তরুণকে।
সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডিতে প্রেনিউরল্যাবের প্রধান কার্যালয়ে কথা হয় এই সফল উদ্যোক্তার সাথে। একান্ত আলাপে জানালেন তার উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প। এই পর্বে টেকভয়েস২৪-এর পাঠকদের শোনাবো আরিফ নিজামীর সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার কথা।
১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে পুরান ঢাকায় জন্ম আরিফ নিজামীর। বাবা রাজু আহমেদ ও মা জোহরা বেগমের এক ছেলে, এক মেয়ে। বাবা ব্যবসায়ী ও মা গৃহিনী। মেয়ে ফারিয়া নিজামী রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন। আরিফ নিজামীর সহধর্মিণী রাখশান্দা রুখাম, গুগল উইমেন টেকমেকারসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আরিফ নিজামী পড়াশোনা করেছেন আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি কলেজ এবং ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়ই নতুন কিছু করার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন তিনি।
ছাত্রজীবন থেকেই মাইক্রোসফট স্টুডেন্ট পার্টনারস, মজিলা ফায়ারফক্স, স্টার্টআপ গ্রিন্ড বাংলাদেশ বিভিন্ন কমিউনিটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এক সময় প্রযুক্তি-বিষয়ক সাইট টেক টিউনসে নিয়মিত লেখা এবং এ খাতের বড় উদ্যোক্তাদের সাক্ষাৎকার নেয়াও শখ ছিল তাঁর।
উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর প্রথম আয় ছিল এটুআই-বেসিস জয়েন্ট ইনিশিয়েটিভ কো-অরডিনেটর হিসেবে। তারপর কাজ করছেন গুগল বাসের কমিউনিটি অ্যাংগেজমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে। সেই সাথে পালন করেছেন ফায়ারফক্সের রিজিওনাল মার্কেটিং অ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব এবং হয়েছেন গুগল ডেভেলপার গ্রুপ ঢাকার (জিডিজি ঢাকা) ম্যানেজারও।
'টেক ফর সোশ্যাল গুড’ স্লোগান নিয়ে ২০১৩ সালে একক প্রচেষ্টায় পথ চলা শুরু হয় তরুণ এ উদ্যোক্তার। সমাজ উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে কাজে লাগানোর চিন্তা থেকেই শুরু হয় তাঁর স্বপ্নের প্রেনিউরল্যাবের যাত্রা। এ বিষয়ে আরিফ নিজামী বলেন, আমি ২০১০ সালে বিভিন্ন কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই। তখন কাছে থেকে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম দেখে মানুষের কল্যাণে কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। এই ভাবনা থেকে সমাজের সমস্যা নিয়ে কাজ করে এমন কতগুলো এনজিওর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম এসব এনজিওর বেশিরভাগই ঠিকভাবে সমাজের সমস্যা সমাধান করতে পারছে না। সামাজিক সমস্যা তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে সমাধানের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করি প্রেনিউরল্যাব।
প্রেনিউরল্যাবের মূল কাজই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিপণন। এছাড়াও প্রেনিউরল্যাব উদ্ভাবন সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজ করে থাকে। বিভিন্ন প্রযুক্তি-বিষয়ক ইভেন্ট আয়োজন, যেমন হ্যাকাথন, স্টার্টআপ-বিষয়ক কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্ভাবনে উৎসাহ দিতে কাজ করে থাকে এই ল্যাব। গুগল টেক উইম্যানের সঙ্গেও কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। ন্যাশনাল অ্যাপ অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল হ্যাকাথন, ইনোভেশন এক্সট্রিম, স্টার্টআপ কাপের মতো আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত প্রেনিউরল্যাব। এগুলোর মাধ্যমে বেশ সাড়া জাগিয়েছে নতুন এ উদ্যোগটি। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ইভেন্টে বিনামূল্যে ও অর্থের বিনিময়ে পেশাদার কর্মশালাও পরিচালনা করে থাকে। তরুণদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করাই এ উদ্যোগের প্রধান উদ্দেশ্য বলে জানান তরুণ এ উদ্যোমী প্রকৌশলী।
আরিফ নিজামী বলেন, দেশের অনলাইন কমিউনিটিতে এখন পরিচিত একটা নাম প্রেনিউরল্যাব। তরুণ উদ্যোক্তাদের হাতেকলমে প্রযুক্তির নতুন সব শাখার সঙ্গে পরিচিতি করাতে এর জুড়ি নেই। অথচ শুরুটা অতটা মসৃণ ছিল না। পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। একদিকে পারিবারিক চাপ, অন্যদিকে নিজস্ব উদ্যোগের চেয়ে চাকরিতেই বেশি সফলতা আসবে এমন প্রচলিত ভাবনার বিষয়গুলো এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। সঙ্গে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয়, টিম ধরে রাখাসহ প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার আরও অনেক বিষয়। এতো বাধা আর হোঁচট খেয়েও পিছিয়ে যাইনি। সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছি। বর্তমানে রাজধানীতে তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তোলার পেছনে অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির একটি ডিজিটাল শাখা খোলা হয়েছে। এতে অ্যাপ তৈরি, ওয়েবসাইট তৈরি ও ডিজাইন, সোশ্যাল মিডিয়া ও ই-কমার্সকেন্দ্রিক ব্যান্ডদের ডিজিটালাইজেশনে সহায়তা করা হয়। মাত্র দুই বছরে প্রেনিউরল্যাব বড় মাপের অনেক কাজ করেছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ওপেন স্ট্রিট ম্যাপ ও প্ল্যান, সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্র্যাকের সাথে শিক্ষার্থীদের কোডিং শিক্ষা, গ্রামীণফোনের সাথে স্মার্ট সিটি হ্যাকাথন অন্যতম।
ওয়ার্ল্ড সামিট অ্যাওয়ার্ড-২০১৬ এর স্মার্ট সেটেলমেন্ট এবং আরবানাইজেশন বিভাগে সেরা অ্যাপ নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশের ‘পাবলিক টয়লেট অ্যাপ’। ওয়ার্ল্ড সামিট অ্যাওয়ার্ড সাধারণত বৈচিত্র্যপূর্ণ মোবাইল কনটেন্ট এবং সামাজিক উন্নয়নে এটি কতটুকু অবদান রাখতে পারবে তার ওপর ভিত্তি করে দেয়া হয়। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়ার্ল্ড সামিট অ্যাওয়ার্ডটি পেয়েছে প্রেনিউরল্যাব। পাবলিক টয়লেট অ্যাপ উদ্যোগের জন্য বাংলাদেশ থেকে এই পুরস্কারটি পায় প্রতিষ্ঠানটি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে তিনি বলেন, উদ্ভাবন নিয়ে অনেক কাজ করতে চাই। কোটি মানুষের সমস্যা সমাধানের প্রযুক্তি বানানোর স্বপ্ন দেখছি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশের প্রযুক্তিক্ষেত্রে আরও বেশি অবদান রাখতে চাই, যার মাধ্যমে দেশে প্রযিুক্তিবিদ তৈরি হবে। প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে তরুণদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে। যাদের মধ্য থেকে সৃষ্টিশীল উদ্ভাবন বের হয়ে আসবে আর গড়ে উঠবে আরও নতুন সব উদ্যোগ। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটি উদ্ভাবনী স্কুল করারও পরিকল্পনা করেছেন তরুণ এ উদ্যোক্তা।