বাসায় কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ছিল। ওয়েবসাইটে ঘুরতে ঘুরতেই খোঁজ পান আউটসোর্সিংয়ের। শেখানোর কেউ ছিল না আশপাশে। কিন্তু নিবন্ধন করে ফেললেন ফ্রিল্যান্সার ডটকমে। প্রথমে ইচ্ছা ছিল লেখালেখি করার। তাই করতেন। বিভিন্ন পণ্যের পরিচিতি বা সেটার বর্ণনা লেখার কাজ দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরু তাঁর।
বলছিলাম নারী ফ্রিল্যান্সার মারজান আহমেদের কথা। শুরুটা যেভাবেই হোক না কেন, কাজ করতে করতে এক সময়ে ফ্রিল্যান্সিং দুনিয়ায় এমনভাবে মিশে যান যে এক সময়ে এটা তার নেশায় পরিণত হয়। ফ্রিল্যান্সিং কাজের জন্য জাতীয় পুরস্কারও পান তিনি।
মা মাকসুদা আহমেদ আর বাবা মকবুল আহমেদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে মারজান চতুর্থ। ২০০৫ সালে বাবা মারা যান। সে বছরই বিয়ে হয় মারজানের। ব্যবসায়ী স্বামী আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে চলে যান যশোর। সেখানেই উচ্চমাধ্যমিক, তারপর ইংরেজি নিয়ে এমএম কলেজে স্নাতক পাস করেন। এর মধ্যেই মারজানের কোলজুড়ে আসে সন্তান আইমান। যার বয়স এখন সাত বছর। তারা এখন থাকেন রাজধানী ঢাকার উত্তর বাড্ডা এলাকায়।
কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই৷ তাই অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই কম্পিউটারের উপর প্রথম প্রশিক্ষণ নেন তিনি৷ এরপর মাধ্যমিকের পর করেন ডিপ্লোমা৷ ডিজাইনিংয়ের প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে এই বিষয়টা ভালভাবে শেখার চেষ্টা করেছেন৷ আর ইন্টারনেটে সময় কাটাতে গিয়েই ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা৷ সেখান থেকেই শুরু৷
মারজান কাজ করেন ফ্রিল্যান্সিং সাইট ওডেস্ক আর ফ্রিল্যান্সার ডটকমে৷ শুরু করেছিলেন ডাটা এন্ট্রি দিয়ে৷ এরপর ডিজাইনিং, প্রবন্ধ লেখা এসব কাজও করেছেন৷ তিনি বলেন, ডাটা এন্ট্রি দিয়ে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, ছোট ছোট লোগো ডিজাইন এসব কাজ করেছি৷ আর আমি যেহেতু ইংরেজির ছাত্রী তাই লেখালেখির কাজও করছি৷ আসলে যখন যেটা ভাল লাগে তখন সেটাই করি৷
এখন মারজান ফ্রিল্যান্সারডটকমে ইন্টারনেট মার্কেটার হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিপণনের কাজ করেন। বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য বা সেবার বিপণন করতে হয় সফলভাবে। তাঁর ভাষায় এ কারণেই অলওয়েজ অনলাইনে থাকতে হয় আমাকে।
ফ্রিল্যান্সার ডটকমে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮৩ হাজার ৮শ ৯জন ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে তাঁর অবস্থান ১৩তম। বাংলাদেশে দ্বিতীয়। ফ্রিল্যান্সার ডটকমে নারীদের মধ্যে বিশ্বে তাঁর অবস্থান এক নম্বর। কাজের পর্যালোচনা বা রিভিউ মারজানের প্রোফাইলে জমা পড়েছে ৪হাজার ৩৪৫টি। বেশির ভাগ রিভিউতে পাঁচ তারকা (ফাইভ স্টার) পেয়ে থাকেন তিনি।
মারজানের প্রোফাইলে লেখা আছে, প্রতি ঘণ্টা কাজের জন্য তাঁর পারিশ্রমিক ১৩০ মার্কিন ডলার। অথচ এই মারজান ২০১০ সালে যখন আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করেন, তখন প্রথম কাজে নেতিবাচক রিভিউ বা মন্তব্য পেয়েছিলেন। কাজের পারিশ্রমিকও পাননি। মারজান বলেন, যখন ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি তখন রিভিউ কি জিনিস তা একদমই জানতাম না। ওই সুযোগে ক্লায়েন্টরা কাজ করিয়ে নিয়ে নেতিবাচক রিভিউ দিয়ে চলে গেছে। ৫টা খারাপ রিভিউ দিয়েই আমার কাজের শুরু। শুরুতে ভাল রিভিউ ছিল দুর্লভ বস্তু। কিন্তু আমি প্রোফাইলটা বন্ধ করিনি। মনে মনে সংকল্প করি আমার কাজের যোগ্যতা দিয়ে এই প্রোফাইলটা আমাকে ভাল একটা প্লাটফর্মে দাঁড় করাতে হবে। প্রথম দুই মাস এভাবেই চলেছিল। তারপর ফ্রিল্যান্সার ডটকমে নিজের প্রোফাইলটা আকর্ষণীয় করে সাজাই। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে অনেকের মনে একটা ভয় কাজ করে৷ সেটা হচ্ছে কাজ শেষে টাকা না পাওয়ার ভয়৷ মারজান বলছেন, ভয়টা একদম সত্যি৷ তিনি নিজেও তাঁর প্রথম কাজের টাকাটা পান নি বলে জানান৷ তাই একটা উপদেশ দিলেন তিনি৷ কখনোই কোনো ক্লায়েন্টকে বিশ্বাস করা যাবে না৷ কাজ শুরুর আগেই অর্ধেক টাকা নিয়ে রাখতে হবে৷ এমনকি যে ক্লায়েন্টের সঙ্গে আপনি কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন তাকেও বিশ্বাস করা যাবে না৷
কিন্তু যে নতুন ফ্রিল্যান্সার, যার কাজ সম্পর্কে ক্লায়েন্টের কোনো ধারণা নেই, তাকে কেন কাজের আগেই টাকা দেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মারজান বলেন, কেউ যদি কাজ জানেন তাহলে সে এক সময় না এক সময় কাজ পাবেনই৷ তাকে ধৈর্য ধরতে হবে৷ কাজের কোয়ালিটি ভাল হলে, ক্লায়েন্টের চাহিদানুসারে কাজ করে দিতে পারলে কাজ পাওয়া কঠিন কিছু না। কিন্তু একের পর এক কাজ করে যদি টাকা না পাওয়া যায় তাতে কাজের আগ্রহ শেষ হয়ে যায়৷ এর চেয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করাটা ভাল৷
ফ্রিল্যান্সিয়ের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে মারজান বলেন, যখন ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি তখন অনলাইনে মেয়েদের নানানভাবে হ্যারেজমেন্ট করা হতো। মার্কেটপ্লেসে আমার ছবি ব্যবহার করে আমার নামে প্রোফাইল তৈরি করে ক্লাইয়েন্টকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হতো যাতে আমি কাজ না পাই। তখন নিজে আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম যে থেমে গেলে চলবে না। এগুলোকে মোকাবেলা করে আমাকে এগিয়ে যেতেই হবে। আমি সব সময় ব্যাক স্টেজে কাজ করে যেতে চাইছি যাতে আমার প্রোফাইল দেখে সবাই অনুপ্রেরণা পায়।
ছাত্রজীবনে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে তার শখ ছিল ভীষণ। বিয়ের পরেও সময় পেলেই হ্যান্ডি ক্র্যাপ্ট তৈরি করতেন। বেশ ভালই কাজ করতেন। শুরুটা ছিল সুই-সুতা দিয়ে। সুতার কাপড়ে নানান রকমের নক্সি বুনতেন। আর সেগুলো সেল করতেন। ওই সময়েও তিনি কাজ নিয়ে অনেক হ্যাপী ছিলেন। কারণ যখন যা করেছেন তা শ্রদ্ধা নিয়েই করেছেন। কাজকে আন্তরিকভাবে ভালবেসে করেছেন।
একটা সময় সুই-সুতাই তার কাছে ম্যাজিকের মতো লাগতো, যখন কার্ড পাঞ্চ করলে ডলার আসতো। এখন ডলার আসে ফ্রিল্যান্সিংয়ে। মারজানের ভাষ্য মতে, কি কাজ করতে চান তা আগে ঠিক করতে হবে। সে কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কাজকে আপন করে নিতে হবে, কাজকে ভালবাসতে না পারলে সে কাজে সফল হওয়া অনেক কঠিন। আর ফ্রিল্যান্সিংয়ে ধৈর্যের কোনে বিকল্প নাই। অদম্য মনোবল, শেখার আগ্রহ, ধৈর্য আর আন্তরিকতা থাকলে যে কেউ সফল হবেনই। তবে যোগাযোগ করার ক্ষমতা আর ইংরেজিতে সাবলীল দক্ষতাটা ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।
আয়ের বিষয়ে মারজানের ভাষ্য, ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়টা নির্ভর করে নিজের ওপর৷ কে কতটা সময় দিতে পারছেন, এছাড়া কে কোন কাজ করছেন এসবের উপর ভিত্তি করে আয়ের পরিমাণ কমবেশি হয়ে থাকে৷ আমার কাছে কোনো হিসেব নেই আমি এখন পর্যন্ত কতটা আয় করেছি৷ তবে যা আয় করেছি মন্দ না।
ফ্রিল্যান্সিং করে আয়ের স্বীকৃতিও মিলেছে তার।বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস এর পক্ষ থেকে বেস্ট ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড ২০১২ পান এই ফ্রিল্যান্সার।
চলতি বছরে ফিব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সফটওয়্যার মেলা ‘সফটএক্সপো’তে ১৫ জন ফ্রিল্যান্সারকে ন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড ২০১৭ দেয়া হয়৷ তাদের মধ্যেও একজন ছিলেন মারজান৷
এই সফলতার পেছনের কারণ হিসেবে মারজান বলেন, রাতে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে না পড়লে কখনো ঘুমাতাম না। সব সময় টিম মেন্টেইন করে কাজ করেছি। তবে শত কাজের ভিড়েও সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি আমার পরিবারকে। কারণ আমার সব কাজের মূলে রয়েছে পরিবার। তাই জীবনকে উপভোগ করতে কখনো কাজকে কম্প্রোমাইজ করিনি।
মারজান মনে করেন, নারীদের জন্য আউটসোর্সিংয়ের কাজ সব দিক থেকে সুবিধাজনক। সাহস করে কাজ শুরু করে দিলেই হলো। জাস্ট স্টার্ট ইট।
বাবা-মার উদ্দেশে মারজান বলেন, আমার একটা বান্ধবী ছিল সে সবসময় পরীক্ষায় ফেল করতো। এসএসসি, এইচএসসি কোনোটাই সে একবারে পাস করতে পারেনি। কারণ সে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। তার বাবা-মা ছিল নাছোরবান্ধা। একবার না পারলে আবার চেষ্টা করো। তবে যে কোনো মূল্যে তোমাকে পাস করতেই হবে। বান্ধবী চেষ্টা করেছে। সে এখন ম্যাজিস্ট্রেট। তাই বাবা-মাকে বলবো আপনারা সন্তানকে বিশ্বাস করে তাদের পাশে থাকেন। সব ধরণের সাপোর্ট করেন। দেখবেন তারা অনেক ভাল কিছু করবেই। যেমন আমি হয়েছি। আমার এ পর্যন্ত আসার পেছনে সব সময় আমার পরিবার পাশে ছিল। আমাকে সবাই উৎসাহ, অনুপ্রেণাসহ সব ধরণের সাপোর্ট দিয়েছে।
প্রযুক্তির এই যুগে স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন কারণে এডিকশনের দিকে চলে যাচ্ছে। ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ুয়া মেয়েরা এখন শিসা পার্টি করে বেড়ায়। শুধু অশিক্ষত ও অবভাবিদের নিয়ে পড়ে না থেকে উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের প্রতি নজর দিতে হবে। শুধু তাদের আয়ের ব্যাপারে না কিন্তু তাদের মানসিক গুণাবলীর বিকাশে, উদ্ভাবক হতে সর্বোপরী একজন ভাল ও আদর্শ মানুষ হতে। তাই দেশের তরুণ-তরুণীদের সুন্দরভাবে চলার জন্য চাকরির পেছনে না ঘুরে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করলে নিজে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। সেইসাথে পরিবারকেও ভাল রাখতে পারবে