জীবন সংগ্রামের জন্য আমার মাথাই আমার পুঁজি : তৌহিদ হোসেন

প্রকাশ: মঙ্গলবার, ০৩ জুলাই, ২০১৮
Image উজ্জ্বল এ গমেজ
news-banner
  ছবি: সংগৃহীত
২০০২ সালে ছাত্রজীবনে চার বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করেন তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান ফিফো টেক। কিছু দিন পর উচ্চ শিক্ষার জন্য দু’জন চলে যান ইটালিতে আর একজন আমেরিকায়। তখন তৌহিদ হোসেন একাই হাল ধরেন প্রতিষ্ঠানের। দিনে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে রাতে নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। এভাবে কঠোর পরিশ্রম করে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ ফিফো টেককে দেশের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি গড়ে তুলেছেন। বর্তমান এই প্রতিষ্ঠানে ২২০জনের মতো তরুণ-তরুণী কাজ করছেন।

সম্প্রতি রাজধানীর কারওয়ান বাজারস্থ সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের অফিসে বিবার্তার সঙ্গে কথা বলেন ফিফো টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান তৌহিদ হোসেন। একান্ত আলাপে বেরিয়ে আসে তার জীবনের নানা কাহিনী। সেই গল্প বিবার্তা২৪ডটনেটের পাঠকদের জানাচ্ছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।

তৌহিদ হোসেনের জন্ম ঢাকার মালিবাগে, যদিও গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বাবা মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেন ও মা গৃহিণী ফাতেমা হোসেন। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট।

তৌহিদ হোসেনের স্কুলজীবন শুরু হয় মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। এসএসসি পাস করার পর বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে দ্য ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক থেকে সিএসইতে (কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং) গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।

শৈশব থেকেই তার ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীতে কাজ করার। ১৯৯৭ সালে বাইপাস অপারেশন হলে স্বপ্নটা ভেঙে যায়। তখন চিন্তা করেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবেন। এ লক্ষ্যে ২০০০ সাল থেকে কাজ শুরু করেন।

ক্যারিয়ার শুরুর কথা প্রসঙ্গে তৌহিদ জানালেন, ১৯৯৮ সাল থেকে বিভিন্ন বাসা ও অফিসের কম্পিউটারে হার্ডওয়্যারের সমস্যা ঠিক করে দিতেন। ফ্লপি ডিস্ক, সিডি রম ঠিক করে দিতেন। এসব কাজে ২০০-৩০০ টাকা পেতেন। ২০০০ সালে গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রশিক্ষণ দিতেন। টিউশনি করতেন।

এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় জাহিদ, রেদওয়ান, রাজিব ও তৌহিদ চার বন্ধু মিলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছয় হাজার টাকায় একটা অফিস ভাড়া নিয়ে শুরু করেন ফিফো টেকের কার্যক্রম।

শুরুতে ২০০৩ সালে ক্যাবল টিভির ডিস অ্যারেঞ্জের একটা সফটওয়্যার তৈরি করেন। তখন ইন্ডিয়া থেকে সফটওয়্যারটি বাংলাদেশে আমদানি করা হতো। বিভিন্ন ক্যাবল কোম্পানি ইন্ডিয়া থেকে প্রতিটা সফটওয়্যার কিনে আনতো পাঁচ লাখ টাকায়, আর এটি তারা বিক্রি করতেন মাত্র এক লাখ টাকায়। প্রথম বছরেই তারা প্রায় ২৫টার মতো সফটওয়্যার বিক্রি করেন।

তৌহিদের ভাষায়, বয়স কম। আল্পদিনের মধ্যেই হাতে এতগুলো ক্যাশ টাকা চলে আসে। অল্পদিনের মধ্যেই সব খরচ করে ফেলি। ২০০৪ সালের আগে দেখা গেল সব টাকা শেষ। এদিকে আর নতুন কোনো কাজও পাচ্ছি না। তখন আমরা সিকিউরিটি ক্যামেরা (সিসি) নিয়ে কাজ শুরু করি। বিভিন্ন বাসাবাড়ি, ফ্ল্যাট ৪/৫ ক্যামেরা দিয়ে ডিভিআর কার্ড কম্পিউটারে ব্যবহার করে কীভাবে রেকর্ড রাখতে পারবে, এসব কাজ করি।

তাদের কাজ চলতে থাকে আপন গতিতে। এক সময় কাজে ভাটা পড়ে। ২০০৪ সালে জাহিদ ও রেদওয়ান পিএইচডি করতে চলে যান ইটালি। ওখানে গিয়ে তারা জানান, আর ফিরে আসবেন না। এরপরে রাজিবও চলে যান আমেরিকায়। একা হয়ে যান তৌহিদ। ফিফো টেককে একাই দেখাশুনা করতে হয় তাকে।

তৌহিদ বুঝতে পারেন কোনো কোম্পানিকে একা চালানো অনেক কঠিন। কেননা এটি চালাতে শুধু টেকনিক্যাল নলেজ থাকলেই হবে না, এর জন্য অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ও ম্যানেজমেন্ট নলেজ, অ্যাডমিনের অ্যাকাউন্টস ফাইনান্সিয়াল নলেজ, কাস্টমার সার্ভিস, সেলস এবং ডিস্ট্রিবিউশন নলেজ থাকতে হবে। এসব না থাকলে কোনোমতেই কোম্পানি চালানো সম্ভব না।

২০০৪ সালের শেষের দিকে তিনি নিজের কোম্পানির কাজের পাশাপাশি গ্রামীণফোনে চাকুরি শুরু করেন। দুই বছরে তিনি গ্রামীণফোনের ১৭টি ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। চাকরিতে যে স্যালারি পেতেন তা দিয়ে নিজের পরিবার ও অফিস চালাতেন। গ্রামীণফোনে কমার্শিয়াল ও আইটির কাজ শেখেন।

২০০৬ সালের শেষের দিকে গ্রামীণফোন ছেড়ে তিন মাসের জন্য বাংলালিংকের সেলস ডিস্ট্রিভিউশনে চাকরি নেন। সেখানে কিছু সেলসের কাজ শেখেন। ‘নূর বাংলা’ নামের ইজিপশিয়ান কোম্পানি টাওয়ার বানাতো। সেখানে ফাইনান্স ম্যানেজার হিসেবে ১৭ দিন কাজ করে ফাইনান্স কাজ কিছুটা শেখেন।

ওয়ালটেল নামে বেস্টন কোম্পানি কাজ শুরু করেছিল তখন। সেখানে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ শেখেন। এভাবে একটা কোম্পানিকে চালানোর জন্য যতগুলো সেক্টরে কাজ করতে হয় ২০০৭ সাল পর্যন্ত তার সবগুলোতেই কাজ করা হয়ে যায় তার।

২০০৮ সালে পুরোপুরি নিজের কোম্পানিতে ফিরে আসেন তৌহিদ। তখন রাজধানীতে কল সেন্টার ব্যবসা শুরু হলে বিটিআরসি থেকে ‘এ টু জেড বিক্রয়’ নামে একটা কল সেন্টারের লাইসেন্স নেন। ২০০৯ সাল থেকে ফার্মগেটের কনকর্ড টাওয়ারে কাজ শুরু করেন।

তৌহিদ বলেন, প্রথমে লন্ডন-আমেরিকার কয়েকটা কম্পানির কাজ দিয়েই শুরু করি কল সেন্টারের কাজ। কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় শুরুতে বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে কাজগুলো করি। এদের মধ্যে বেশির ভাগ ব্যক্তি ছিলেন ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি। শুরুতে আমাদের কন্ট্রাক্টগুলো ভাল ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা প্রতারণার শিকার হই। কাজ করি ঠিকই, কিন্তু মাস শেষে কোনো বিল পাইনি। এমনও হয়েছে এক কোটি টাকার বিল পাইনি। এভাবে চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে ২০১০ এসে দেখা গেছে কোম্পানি বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।

প্রতারণার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তৌহিদ বলেন, ২০১০ সালে লন্ডনে একটা ডেটা এন্ট্রির কাজ করি। ওরা সুন্দর করে ভাইবারে, স্কাইপে যোগাযোগ করতো আর আমরা সেইমতো কাজ করতাম। কাজের জন্য আমাদের মধ্যে চুক্তিও হয়। প্রথম মাসে কাজ করে বিল হয় ১৬ লাখ টাকা। সেই টাকা ওরা আমাদের ব্যাংকে ডকুমেন্টস পাঠায় যে, ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার হয়ে গেছে। দুই মাস যায়। সে টাকা তো আসে না। এরপর আমরা ব্যাংকে যাই, ম্যানেজারকে বলি, কিন্তু টাকা আর আসে না। পরে লন্ডনে এক বন্ধুকে ফোন করে ওই কোম্পানির ঠিকানা দিয়ে খোঁজ নিতে বললে ও গিয়ে দেখে, এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানই নাই।

এভাবে বিদেশিদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়ে ২০১১ সালে এসে তৌহিদ বুঝতে পারেন, এভাবে আর বিদেশি কোম্পানি দিয়ে ব্যবসা চালানো সম্ভব না। তখন তিনি বাংলাদেশের ভেতরের কাজ শুরু করেন। কেননা বাংলাদেশে যাদের সাথে কাজ করবেন কাজের মূল্য কম হলেও একটা নিরাপত্তা আছে যে, তাদের কাছ থেকে টাকাটা সংগ্রহ করো যাবে।

২০১১ থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত চার বছরে আকিজ গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, রবি, সিম্ফনি মোবাইল, ইউর ক্যাশসহ আরো কয়েকটা দেশীয় কোম্পানির সাথে সফলভাবে কাজ করেন।

বর্তমানে রাজধানীর কারওয়ান বাজারস্থ জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ফিফো টেকের কাজ করা হচ্ছে। এর প্রধান কার্যালয় রয়েছে তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। এখানে ২২০ জনের মতো কাজ করছেন। এখন দেশের বাইরে কোম্পানির সাথে যৌথভাবে কাজ করছেন। ২০১৪ সাল থেকে ইন্ডিয়ান কোম্পানি লজিটেকের বাংলাদেশের পার্টনার হিসেবে কাজ করছেন। ‘সিএনসি ডেটা’ নামের আামেরিকান কোম্পানির সাথেও চার বছর ধরে কাজ করছেন।

তিন বছর ধরে কিছু মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্টের কাজ করছেন। এর জন্য একটা টিম রয়েছে। স্কিল ডেভেলপমেন্ট একটা টিম আছে, যারা বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং পরিচালনা করছেন। গত ৯ মাস ধরে ‘অ্যাকাউন্টিং প্রসেস আউটসোর্সিং’ নিয়ে এই টিমটা কাজ করছে। যারা ঘরে বসে অনলাইনে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে কাজ করে আয় করতে চান তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

ফিফো টেকে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা বিষয়ে তৌহিদ জানান, সমাজে আমরা যাদের বলি এদের দিয়ে কিছুই হবে না, তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনেকের থেকেও ভালো সাপোর্ট দিচ্ছে আমাদের। যে লোকটা কথা বলতে পারে না, তাকে দিয়ে যদি ডেটা এন্ট্রির কাজ করানো যায়, তাহলে সে ভালো করবে। কারণ, তার হাত ঠিক আছে, ব্রেইন ঠিক আছে। এই লোকটাকে তার মতো করে ট্রেনিং দিলে সে যে সার্ভিস দেবে, সেটা অন্যের চেয়ে অনেকগুণ ভালো হবে। যার একটা হাত নেই কিন্তু কথা বলতে পারে, সেও চাইলেই কল সেন্টারে কাজ করতে পারে। যে এসিড ভিকটিম, সেও চাইলে কল সেন্টারে কাজ করতে পারে। এমন অনেক লোক আমার এখানে কাজ করছেন।

প্রতিষ্ঠানের নাম কেন ‘ফিফো টেক’ এ বিষয়ে তৌহিদ বলেন, ‘ফিফো’ হলো ‘ফার্স্ট ইন, ফার্স্ট আউট’ (FIFO) আর টেক অর্থ টেকনোলজি। আইডিয়াটা হলো কোনো ক্লায়েন্ট যদি আমার কাছে ফার্স্ট আসে তাহলে ফার্স্ট প্রায়োরিটি পাবে। যিনি আগে আসবেন তিনি আগে কাজের সুযোগ পাবেন।

তৌহিদ জানালেন, আমার ইনভেস্টর হলো আমার মাথা, আর পার্টনার হলো দু’টো হাত। কারণ, পার্টনার আর ইনভেস্টরের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পার্টনার মানে হলো যে আপনার সাথে কাজ করবে। তাকে টাকা ও সময় ইনভেস্ট করতে হবে। আর ইনভেস্টর হলো সে টাকা দেবে। ওই টাকা থেকে লাভ হলে তাকে কিছু পার্সেন্টেজ দিতে হবে। আমার পার্টনার নাই, ইনভেস্টরও নাই। তাই আমার পার্টনার হলো আমার দু’টি হাত আর ইনভেস্টর হলো মাথা।

বর্তমানে তৌহিদ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল লেবার ল অর্গানাইজেশন (আইএলও) ইন্ডাস্ট্রির প্যানেলিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। বাংলাদেশ টেকনিক্যাল এডুকেশন বোর্ডের সাথে তাদের কারিকুলাম, মডিউল ও ডেভেলপমেন্টের সাথে তৈরির সাথে যুক্ত আছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং(বাক্য)সেক্রেটারি এবং ফিফো টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ফিফো টেকে যেন পাঁচ হাজার তরুণ-তরুণী কাজ করার সুযোগ পায় এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তৌহিদ। একই সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের একজন সৈনিক হয়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরকে গ্লোবাল পজিশনে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তার।

লেখাটি বিবার্তায় প্রকাশ হয়েছে। মূল লেখাটি দেখতে যেতে হবে এই লিংকে
image

আপনার মতামত দিন