লেখার নেশায় ডাক্তার থেকে সাংবাদিক নুরুল ইসলাম হাসিব

প্রকাশ: বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png উজ্জ্বল এ গমেজ
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
কাকা ডাক্তার, বাবা শিক্ষক। ছোটবেলায় তাদের দেখে কখনো ইচ্ছে হতো শিক্ষক হবো। আবার কখনো মনে হতো ডাক্তার হবো। সময়ের রঙ বদলের সাথে সাথে ইচ্ছেগুলোও যায় বদলে। যখন স্কুলে পড়ি, তখন মনে হলো, না ডাক্তারই হই। মানুষের সেবা করে কাকার মতো জীবন কাটাবো। ডাক্তারি পড়াশোনা করে এমবিবিএস ডিগ্রিও নিয়েছি। মেডিকেলে পড়ার সময় ভাবনায় যোগ হয় নতুন পালক। শুরু করি লেখলেখি। সেই লেখার নেশায় ছেড়ে দেই ডাক্তারি পেশা। শুরু করি সাংবাদিকতা। প্রথমে পেশা। এখন সেটি পরিণত হয়েছে নেশায়।
 
এভাবেই নিজের ক্যারিয়ার জীবনের কথা  বললেন ঢাকার সাংবাদিকদের অন্যতম পেশাদারী সংগঠন  ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাধারণ সম্পাদক ডা. নুরুল ইসলাম হাসিব।

 
শৈশবের পড়াশোনার জীবনের কথা বলতে গিয়ে হাসিব বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই কোনো বিষয়ে তেমন সিরিয়াস ছিলাম না। জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে কোনটাই সিরিয়াসভাবে নেইনি। করতে হবে করেছি। চলতে হবে, চলেছি। নিয়ম পালন করতে হবে, করেছি। তবে মজার বিষয় হলো, ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত প্রত্যেকটা ক্লাসে আমি প্রথম হয়েছি। খুব বেশি যে সিরিয়াস স্টুডেন্ট ছিলাম, তাও না। খেলা-ধুলা, আড্ডাবাজি সবই করেছি। ছোটবেলা থেকে জীবনের প্রত্যোকটা ধাপে যা করার সবই করেছি।

কথায় কথায় জানা গেল, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম ডা. নুরুল ইসলাম হাসিবের। বাবা পেশায় শিক্ষক। বর্তমানে অবসরে আছেন। মা গৃহিণী।  তিন ভাই ও চার বোনের বড় পরিবারের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

মঠবাড়িয়ার কে এম লতিফ ইনস্টিটিউশন থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর জীবনের ক্যারিয়ারের সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। হাসিব চিন্তা করেন জীবনের ক্যারিয়ার হিসেবে ডাক্তারি পেশাকে বেছে নিলে মন্দ হয় না।

জীবনের ক্যারিয়ার নিয়ে হাসিব বলেন, এইচএসসি পাস করার পর ডাক্তারি নিয়ে পড়ার ইচ্ছে হলো। চাচা ডাক্তার। তিনি মানুষের চিকিৎসাসেবা করেন। যশ, সুনাম, খ্যাতি, অর্থ সবই আছে। আমার মাথায় চিন্তা হলো জীবনের ক্যারিয়ার হিসেবে এ পেশাকেই  বেছে নেই। সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকা যাবে। মানুষের সেবাও করা যাবে। ভাল সময় কাটবে। তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি পরীক্ষা দেই। চান্স পেয়ে ভর্তি হয়ে যাই।

হাসিব ঢামেক-এ পড়ার সময় হাসপাতালে নানান ধরনের রোগীদের সাথে পরিচয় হয়। ঢামেক সরকারি হাসপাতাল হওয়াতে ঢাকা জেলার সব এলাকা থেকে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগীরা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য আসেন। যেমন, ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে, বিষ খেয়ে, মারামারি করে বা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত, ফাঁসি ঝুলানো রোগী, আগুনে পুড়ে গেলে এসব হরেক রকমের রোগী নিয়মিত আসতো।

হাসিব বলেন, ডাক্তারি পড়ার সময় থিউরিটিকেল ক্লাসের পাশাপাশি আমাদের প্র্যাকটিকেল করানোর জন্য এসব রোগীদের সাথে নিয়মিত আলাপ হতো। মেডিকেলের জরুরি বিভাগে বিভিন্ন ধরেনের রোগীরা আসতেন। বেশির ভাগ রোগীর দুর্ঘটনা ঘটার পেছনের গল্পগুলো ছিল মর্মান্তিক, বিচিত্র ও রহস্যময়। মানুষের জীবন কত রকম হতে পারে! কত দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকেন! মানুষের জীবন কত বিচিত্র! বিষয়গুলো আমাকে ভাবাতো। চিন্তা করতাম এগুলোকে নিয়ে লেখালেখি করলে কেমন হয়? নিজের বিবেকের তাড়না থেকেই লেখা শুরু করি। নিজের মেডিকেলের রোগীর অবস্থা নিয়ে লিখতাম। কী দুর্ঘটনার কারণে রোগীটা মারা গেলো, কী অপরাধের কারণে তাকে মারা হলো এসব বিষয়গুলো ছিল আমার প্রতিবেদনের মূল বিষয়। অন্যায়, অপরাধ বিষয়গুলো নিয়ে সেই যে লেখা শুরু করি, শুধু লিখতেই থাকি।

২০০২ সালে ঢামেক থেকে এমবিবিএস পাস করেন হাসিব। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পর এখন ডাক্তারি পেশা প্র্যাকটিস করার পালা। তার সহপাঠী বন্ধুরা বিভিন্ন হাসপাতালে ইন্টার্নি শুরু করে দেন। অন্যদিকে লেখালেখি হয়ে ওঠের তার ভালোলাগার বিষয়। ডাক্তারি কাজের চেয়ে লেখালেখির মধ্যে বেশি আনন্দ উপলব্ধি করতে শুরু করেন তিনি।

ডা. হাসিব বলেন, এমবিবিএস পাস করার পর লেখালেখির প্রতি ঝোঁক চলে আসে। ছাত্র অবস্থায় হাসপাতালের যেসব চিত্র কাছে থেকে দেখেছি, যেসব অভিজ্ঞতা করেছি, এসব বিষয়গুলো নিয়ে মিডিয়াতে লেখার তীব্র ইচ্ছে জাগে মনে। তখন ডাক্তারি কাজের প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে মনের ভালোলাগাকে গুরুত্ব দেই। জয়েন করি দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায়।

ভাল ছাত্র হওয়ায় এবং ডাক্তারি পড়ার সুবাদে ইংরেজির ওপর ভাল দখল ছিল ডা. হাসিবের। সে ইংরেজির মেধা ও লেখালেখির দক্ষতাকে পুঁজি করে ইংরেজি পত্রিকায় শুরু করেন সাংবাদিকতা।

ডাক্তারি কাজের প্র্যাকটিস বন্ধ করে সাংবাদিকতার শুরুর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ডা. হাসিব বলেন, ছাত্রাবস্থায় ডাক্তারদের জীবন কাছে থেকে দেখেছি। একজন ডাক্তারকে সকাল থেকে শুরু করে দিন-রাত রুটিন করে রোগী দেখতে হয়। নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়। যখন রোগী খারাপ হবে সাথে সাথে দৌড়ে হাসপাতালে যেতে হয়। ডাক্তারি পেশায় যেনো কোন স্বাধীনতা নেই। অন্যদিকে, সাংবাদিকতায় এসে ভিন্ন স্বাদ উপলব্ধি করেছি। কোন রুটিন মেনে কাজ করতে হয় না। কাজে অবারিত স্বাধীনতা। নিজের অর্পিত দায়িত্ব পালন করে সহপাঠীদের সাথে আড্ডা দেয়া, বিভিন্ন প্রোগ্রামে যাওয়া, সংগঠনের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়া সব কিছুই করার সুযোগ রয়েছে। এদিকে সাংবাদিকতাটা ততদিনে নেশায় পরিণত হয়ে যায়।

ব্যক্তি হিসেবে ডা. হাসিব একটু স্বাধীনভাবে সব কাজ করতে পছন্দ করেন। কোন ধরাবাধা নিয়মের মধ্যে থাকতে তিনি পছন্দ করেন না। তার চিন্তায় জীবনের জন্য কাজ। কাজের জন্য জীবন না। তাই যে কাজ করবো, সেটা মনের আনন্দে উপভোগ করে করবো। স্কুল, কলেজ, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সময় পড়ার পাশাপাশি সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডাবাজি করা, মুভি দেখা, খেলাধুলা করা এসব কিছু জীবনের সাথে মিশে যায়। এর জন্য রুটিন করে ডাক্তারি কাজ করা, নিয়ম মেনে চলা তার হয়ে ওঠেনি। সাংবাদিকতাই তার স্থায়ী পেশা হয়ে যায়।

সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারের শুরুতেই ইংরেজি পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এ যোগ দেন। পরে কাজ করেন দ্য ডেইলি সান ও বিডিনিউজ২৪ডটকমে। এখন কাজ করছেন বাংলাদেশ পোস্টে।

সাংবাদিকতার শুরুতে রোগীদের নিয়ে অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদন লেখা শুরু করেন ডা. হাসিব। পরে ভাবেন হাসপাতালে তো হাজারো রকমের রোগী রয়েছেন। প্রত্যেকজন রোগী ভিন্ন। তাদের জীবনে রয়েছে অব্যক্ত দুঃখ, কষ্টের বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেগুলো নিয়েও লেখা শুরু করি। তখন রোগীদের জীবনের কষ্টের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে লিখতে থাকেন মানবিক আবেদনধর্মী প্রতিবেদন। সেইসাথে লিখেন হাসপতালের যত অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম নিয়ে।

হাসিব বলেন, প্রতিষ্ঠান বদলের সাথে সাথে হাউজের চাহিদা ও নির্দেশনা অনুসারে নিউজের ধরণও বদল হয়। প্রথমে রোগীদের নিয়ে অপরাধমূলক প্রতিবেদন করার পর স্বাস্থ্য বিটের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে অফিসের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের নিউজও করতে হয়েছে। এখন দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক (ডিপ্লোমেটিক) বিটে কাজ করছি।

প্রত্যেকজন সাংবাদিকের প্রতিদিনকার দায়িত্ব পালনকালে নানান ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকামেলা করতে হয়। ডা. হাসিবও এর ব্যতিক্রম না। সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তার ভাষ্য, সাংবাদিকদের প্রতিদিনকার পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ আসে। যেমন, সত্যনিষ্ঠ ও নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করা, সেগুলো সঠিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিবেশন করা, নিজের দায়িত্ব পালনে সৎ, নিষ্ঠাবান, নিরপেক্ষ মানসিকতাসম্পন্ন হওয়া। আর সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জগুলো হলো আমাদের মিডিয়া হাউজগুলো বেশির ভাগই পেশাদার না। কয়েকটা হাউজ ভাল আছে। বাকিগুলোর অবস্থা ভাল না। সাংবাদিকতা পেশায় সম্মান, বেতন কাঠামো, সুযোগ-সুবিধা আজকের সাংবাদিকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকস, ব্রডকাস্ট সব মিডিয়া হাউজের বেশির ভাগ সাংবাদিকরা এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে কাজ করছেন।

আগামীদিনের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব কম থাকায় পেশাদার, স্বাধীন মিডিয়ার অভাব রয়েছে। বর্তমানে টেলিভিশন ও সংবাদপত্র হাউজগুলোর যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।

সাংবাদিকতার জীবনে বিভিন্ন ধরনের অর্জনের মধ্যে মানুষের ভালোবাসা, আন্তরিকতা, সমর্থনকে সবচেয়ে বড় পাওয়া বলেন ডা. হাসিব। তিনি বলেন, আমি আমার সাংবাদিকতার জীবনে অসংখ্য মানুষের সম্মান পেয়েছি। ভালোবাসার স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর নভেম্বরে  ঢাকাস্থ সাংবাদিকদের অন্যতম পেশাদারী সংগঠন ডিআরইউ-এর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে সবাই আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন। সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। এখন দায়িত্ব পালন করছি। যারা আমাকে মূল্যবান ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন তাদেরকে এ লেখার মাধ্যমে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

তরুণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে এ নেতা বলেন,  যারা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চায় তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, সাংবাদিকতা ৯-৫টা কোন অফিসিয়াল ডিউটি না। এখানে কাজের কোন সময় নির্দিষ্ট থাকে না। ১০ টায় অফিস থেকে বের হলেও ১১টায় আবার কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে সেখানে যেতে হয়। তাই এ পেশায় আসতে হলে অবশ্যই কাজটাকে ভালোবাসতে হবে। সাংবাদিকতাকে কেউ ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে সেটা তার মন থেকে আসতে হবে। লেখালেখির প্রতি অদম্য নেশা থাকতে হবে। আর যে বিষয়ে ভাল জানাশোনা আছে, যে বিষয়গুলোতে দখল বেশি, সে বিষয়ে কাজ করলে সেখানে ভাল করা সম্ভব। নিজের কাজের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে সেখানে ভাল করা সম্ভব না।

ডাক্তার হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন না করলেও মানুষের যেকোনো বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ডা. হাসিব। পেশাগত ভাবে মানুষের সেবা না করলেও যাদের প্রয়োজন সেবা দেন তিনি। ভবিষ্যতে ডাক্তারি সেবা নয়, সাংবাদিকতাতেই ভাল ভাবে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। তার মতে, লেখনির মাধ্যমেও মানুষে কাছে স্বাস্থ্য নিয়ে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব। লেখালেখিকে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চান তিনি।
image

আপনার মতামত দিন