নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, শেকড় থেকে শিখরে
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৪ জুলাই, ২০১৮
ছবি:
সংগৃহীত
তখন গ্রামে থাকতেন তিনি। বয়স মাত্র ছয় বছর। বাবা জেলখানায়। কেনো বাবাকে জেলে নেয়া হল, সেটাও বুঝতেন না তিনি। যখন হাইস্কুলে পড়েন, তখন রাজনীতির বিষয়গুলি আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেন। কেনো দিন-রাত বাবার কাছে এত মানুষজন আসা-যাওয়া করতেন। আলোচনা সভা করতেন। তখন থেকে বাবার মতো দেশ ও মানুষের সেবার কথা ভাবতে শুরু করেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। বাবার মতো জনপ্রিয় নেতা এবং তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। সময়ের পালাক্রমে নানা ভাঙা-গড়া ও কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে কেটে যায় প্রায় সাড়ে তিন যুগ। পরে দেশের মানুষের ভালোবাসায় বসেন নেতৃত্বের আসনে। আজ তিনি নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। বিশ্বনেত্রী, বাঙালি জাতির আলোর দিশারী।
এতক্ষণ যার কথা বলেছি তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মানবতার মা। বর্তমান বিশ্বে সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠতম সম্মানজনক স্থান অর্জনকারী একজন বিশ্বনেতা। গ্রামের ওই সহজ-সরল কিশোরীটি নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠার পেছনে রয়েছে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর গল্প। তার জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নানান ঘটনা।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় মুজিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ডাক নাম হাসু। বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। অন্যরা হলেন শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেল। বর্তমানে ভাই-বোনদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া কেউই বেঁচে নেই।
শেখ হাসিনার শৈশবের স্বর্ণালী দিনগুলি কেটেছে গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর তীর ঘেঁষা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। মেয়ের প্রথম সন্তান হওয়ায় দাদা শেখ লুৎফর রহমান ও দাদি সাহেরা খাতুনের অতি আদরের নাতনি ছিলেন তিনি। দাদা-দাদির অকৃত্রিম স্নেহ-মায়া, মমতা ও ভালোবাসায় কোলে-পিঠে চড়ে শৈশবের দিনগুলি কাটে তাঁর।
‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ প্রবন্ধে শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার শৈশবের স্বপ্ন-রঙিন দিনগুলি কেটেছে গ্রাম-বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে। জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে। তাল-তমালের ঝোপে বৈচি, দিঘির শাপলা আর শিউলি-বকুল কুড়িয়ে মাথা গেঁথে, ধুলোমাটি গায়ে মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে।
টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর পড়ালেখার হাতেখড়ি। বাল্যশিক্ষা নেন বাড়িতেই। পরিবারের ছোটদের পড়ানোর জন্য সবসময় বাড়িতে মৌলভী, পণ্ডিত ও মাস্টার রাখা হত। সব ছেলে-মেয়েরা সকাল-সন্ধ্যা তাঁদের কাছে পড়ালেখা শিখত। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন শেখ হাসিনা।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তখন পুরনো ঢাকার মোগলটুলির রজনী বোস লেনে ভাড়া বাসায় উঠেন তাঁরা। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টু রোডের বাসায় তাঁরা বসবাস শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনাকে ঢাকা শহরে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করানো হয়। এখন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শেরেবাংলা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে পরিচিত। শুরু হয় তাঁর শহুরে তথা নগর জীবন।
নানা ভাঙা-গড়ায় ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ৬৭৬ নম্বরের তিন কামরার বাড়িতে উঠেন। শ্রমিকের টাকা বাঁচানোর জন্য মা তাদের নিয়ে দেয়ালে পানি দিতেন, ইট বিছাতেন। বাবা জেলে থাকতেন বলে ঈদের সময় কাপড়-চোপড় নতুন তেমন কিছু পেতেন না। বাসায় ছিল সেলাই মেশিন। তাই মা কাপড় সেলাই করতেন। একসময় শেখ হাসিনাও কাপড় সেলাই করা শুরু করেন। নিজের বাড়ির সদস্যদের এবং পাড়া-পড়শিদের কাপড়ও বানিয়ে দিতেন। প্রতি রবিবার ফুফাতো ভাই-বোনরা বেড়াতে আসতেন। তারা আসলে বাড়িটি যেনো আনন্দ-উৎসবে পরিণত হত।
বাবা রাজনীতি করার সুবাদে বাড়িটিতে সব সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আসা-যাওয়া করতেন। বলা যায় বাড়িটি ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একটা আড্ডা ও বৈঠকখানা। বিষয়গুলি বিচক্ষণতার সাথে খেয়াল করতেন কিশোরী শেখ হাসিনা। ছোটবেলা থেকেই তার অন্তদৃষ্টি ছিল খুব প্রখর। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যখন বাবার কাছে দেখা করতে আসতেন, তখন তিনি বাড়ির দোতলার সিঁড়িতে বসে কখনো বই পড়তেন, কখনো ফুফাতো বোনের সাথে চা পান করতেন আর গল্প করতেন। বাসায় প্রচুর ভিড় হত বলে তিনি এবং তাঁর খালাতো বোন ছাদের উপর বসে পড়তেন। অনেক সময় পানির টাংকির উপর পা ঝুলিয়ে গলা ছেড়ে জোরে জোরে পড়তেন। তিনি ঘুম তাড়ানোর জন্যেও জোরে পড়তেন। ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনের সময় তিনি এইচএসসির শিক্ষার্থী। বাসা ভর্তি মানুষ। পড়তে বসলেও মন পড়ে থাকত তাঁর সভায়। জানালার পাশে বসে ঘরে কি আলোচনা করা হচ্ছে, সেগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। মাঝে মাঝে সবাইকে চা বানিয়েও দিতেন।
১৯৪৭ সালের উত্তাল সময়ে শেখ হাসিনার জন্ম। জন্মের সময় তাঁর বাবা ছিলেন কলকাতায়। রাজনীতির অগ্নিঝরা দিনগুলিতে বঙ্গবন্ধু পিতৃত্বকে সবসময়ই বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রথম কন্যা শেখ হাসিনা জন্মের অনেক দিন পরে তাঁকে ছুঁয়ে দেখার সুভাগ্য হয় বঙ্গবন্ধুর। এভাবে বার বার জেলে বিন্দি জীবন কাটানোর সময় বঙ্গমাতার আদর-শাসন ও স্নেহসান্নিধ্যেই শেখ হাসিনার বেড়ে উঠা। মায়ের সীমাহীন আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সার্বক্ষণিক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা বাবা-মায়ের প্রতিটি সংগ্রাম-আন্দোলন কাছে থেকে দেখেছেন। স্কুলজীবনে রাজনীতির নিয়ে মনে যত প্রশ্ন জাগত, সব তিনি বাবার কাছ থেকে জেনে নিতেন। বাবার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। বাবাই ছিলেন তার রাজনীতির শিক্ষাগুরু। আর মা তাঁকে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছেন ছাত্রাবস্থাতেই আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে যেতে।
১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ) থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। শৈশব-কৈশোরে বাবার জেলখানায় বন্দিজীবন দেখতে দেখতে তার শিশুমনে প্রতিবাদের স্পৃহা জেগে উঠে। তাই আজিমপুর গার্লস স্কুলে পড়ার সময়ে ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছাত্রমিছিলে নেতৃত্ব দেন তিনি। ওই মিছিল নিয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
জন্মগতভাবে শেখ হাসিনা বাবার নেতৃত্বের গুণাবলী পেয়েছেন। তাই স্কুলজীবন থেকেই তার নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৬৬-১৯৬৭ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। একই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উঠেন রোকেয়া হলে। তখন ঢাবি ছাত্রলীগের সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির এক উত্তাল সময়। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সেনানিবাসে (ক্যান্টনমেন্ট) নিয়ে যাওয়া হয়। এই মামলাকে (আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা) ঘিরে সারাদেশ তখন আন্দোলনের অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছিল। ওই আন্দোলনে তখনকার রোকেয়া হল শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসিনা ছিলেন আন্দোলনে একজন অকুতোভয় নেত্রী।
১৯৬৯ সাল। সারাদেশে চলছিল গণ আন্দোলন। ছাত্রনেতা হিসেবে ওই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছিলেন শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে তাঁর জীবনে যোগ হয় নতুন অধ্যায়। বাবা তখনো জেলে। বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফজলুল হক হলের সহ সভাপতি মেধাবী ছাত্র পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। বাবা-মায়ের সম্মতিতে ১৭ নভেম্বর পবিত্র শবই বরাতের রাতে বিয়ে করেন তাঁরা। বাবার দোয়া নিতে দুজনে জেলখানায় গেলে তখন মেয়ের জামাইকে জেল গেটে একটি রোলেক্স ঘড়ি উপহার দেন বঙ্গবন্ধু। যা আজীবন সযতনে ছিল পরমাণু বিজ্ঞানীর কাছে। তখন দেশে চলছিল আন্দোলন। এমনই রাজনৈতিক বৈরি পরিস্থিতিতে তাদের শুরু হয় নতুন জীবন। দুজনই ঢাবির শিক্ষার্থী। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, অন্যদিকে গণ আন্দোলন, স্বামী-সংসার, সব সমতালে সুদক্ষ হাতে চালিয়ে যান আত্মপ্রত্যয়ী ও অকুতোভয় এই ছাত্রনেত্রী। তাদের জীবন চলছিল আপন গতিতে।
১৯৭১ সালের জুলাই মাস। দেশে চলছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন। দেশের মানুষ সবসময় আতঙ্কে থাকতো, কখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এসে আঘাত হানে। এভাবে যখন দিনগুলি অতিবাহিত হচ্ছিল জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে শেখ হাসিনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. ওয়াদুদের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করানো হয়। সমস্যা দেখা দেয় সেখানে থাকবেন কে। বেগম মুজিব তখনো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি। তখন বন্দিশালার দায়িত্বে থাকা মেজর হোসেনের কাছে বেগম মুজিবকে শেখ হাসিনার সাথে থাকার অনুমতি দেয়ার কথা বললে, অনুমতি দেননি। বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন এবং এটিএম সৈয়দ হোসেনের স্ত্রী লিলি হোসেন নিজেই সেবিকা সেজে এসে শেখ হাসিনার সাথে থাকেন। ২৭ জুলাই রাত ৮টার দিকে নির্ধারিত সময়ের ৬ সপ্তাহের আগেই শেখ হাসিনার কোল আলো করে আসে তাঁদের ভালোবাসার ফসল। ছেলে সন্তানের মা হন তিনি। নাতিকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হন বেগম মুজিব। প্রথম নাতি। কী নাম রাখা যায়? তখন শেখ হাসিনা জানান, আব্বা আমাকে বলেছিলেন, ছেলে হলে জয় বাংলার ‘জয়’ আর মেয়ে হলে ‘জয়া’ নাম রাখতে। বেগম মুজিব সঙ্গে সঙ্গে নাতিকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন, সত্যিই এ আমার জয়। আর কোন ভাই নেই। জয় আমার সত্যিই ভাই। তাই মুজিব নামের সাথে মিলিয়ে আসল নাম রাখলাম সজিব। সেই থেকে সজিব ওয়াজেদ জয় বাংলার বিজয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দলমত নির্বিশেষে সকলের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ একই সূত্রে গাঁথা এক অচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জন্মের সময় পরিস্থিতির জন্য সয়েছেন সীমাহীন যাতনা। দুশ্চিন্তায় রাত কাটিয়েছেন। খেয়ে না খেয়ে থেকেছেন। সন্তান হওয়ার পর কোন উল্লাস-উচ্ছ্বাসের সুযোগ মেলেনি। আধপেটা থেকে জন্ম দিয়েছেন নিজের আদরের সন্তান জয়কে। জন্মের পর সেই সন্তানের গায়ে জড়াতে পারেননি একটা নতুন জামাও। একজন মা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হৃদয়ে যুদ্ধের সময়ে দুঃসহ জীবনে ছেলের মা হওয়া যে কতটা আনন্দ একইসাথে কতটা বেদনার ছিল তা অনুভব করা সত্যিই অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধু তখন জেলখানায় বন্দি। এভাবে কেটে যায় দিন, সপ্তাহ ও মাস। বছর গড়িয়ে ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় সন্তানের মা হন তিনি। নাম রাখেন সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল। এমনই সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন শেখ হাসিনা।
তিনি আরও বলেছেন, ঘটনার আকস্মিকতায় আমি শোকাহত এবং বিমূঢ় হয়ে পড়ি। আমার মুখ থেকে তখন একটি কথাই বের হয় শুধু, তাহলো, যদি কোনো অভ্যুত্থান হয়ে থাকে, তাহলে আমি সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি। এরপর আমরা জার্মানির বনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে যাই। তখনই জানতে পারি হৃদয়বিদারক ঘটনাটির কথা। আমার বাবা-মা, নতুন বিয়ে করা দুই ভাই ও তাদের স্ত্রী, এমনকি আমার শিশু-ভাই রাসেলকেও হত্যা করা হয়েছে। সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ ১৮ জনের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে আমার হৃদয় এখনো কান্নায় ভিজে যায়।এরপর খুনিরা রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করায়, আমি ও আমার বোনের দেশে ফেরার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন দুই শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দীর্ঘ ছয় বছর মানবেতর পরিস্থিতিতে নির্বাসিত জীবনযাপন করি। ঘাতকদের গুপ্ত হামলার আতঙ্ক বুকে চেপে প্রতিনিয়তই শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে ছুটতে হয়েছে আমাদের।
পরিস্থিতির কারণে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে অনেকটা একা হয়ে যান শেখ হাসিনা। কাছের বলতে ছিলেন তার ছোট বোন রেহানা। তিনিও থাকতেন যুক্তরাজ্যে। এই নির্বাসিত জীবনে ১৯৭৮ সালে দিল্লিতে ছুটে যান খান সাহেব ওসমান আলী এম এল এ’র ছেলে ও তখনকার জাতীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম শামসুজ্জোহা এবং তার পরিবারে। সেদিন তিনি ছিলেন বিমর্ষ এবং তাদের পেয়ে শুধুই কেদেঁছিলেন। পরে ১৯৮১ সালে ৯ এপ্রিল দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করতে যান শেখ হাসিনা। সেখানে মাজারের খাদেম বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি কাগজ তাকে দেখান, যেখানে তারিখ উল্লেখ করা ছিল ৯ এপ্রিল, ১৯৪৬ সাল। বাবার হাতের স্বাক্ষর দেখে শেখ হাসিনা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন দেশে ফেরার।
দীর্ঘ সময় মানবেতর নির্বাসন শেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা ওই প্রবন্ধে বলেছেন, ১৯৮১ সালে নির্বাসিত জীবনের অন্ধকার-সুরঙ্গের শেষপ্রান্ত থেকে যেনো একটুখানি আলোর রেখা দেখলাম। ১৯৫০-এর দশকে আমার বাবা যে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই দল আমাকে তাদের সভাপতি নির্বাচিত করলো। সারাদেশের মানুষ স্বাগত জানালো দলের এই সিদ্ধান্তকে। ওই সময়কার সামরিক সরকারের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এরপর আমি (১৯৮১ সালের ১৭ মে) বাংলাদেশে ফিরে এলাম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার কন্যা হওয়ার পরেও, দেশে ফেরার পর আমার রাজনৈতিক পদচারণা সহজ ছিল না। প্রতিটি ধাপে ধাপে ছিল বিভিন্ন সমস্যা, ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা। তবুও ওই ভয়াবহ সময়ে আমি আমার যাবতীয় আবেগ এবং শক্তিকে এক করে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করি। ঝুঁকি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর বিকল্প কিছু ভাবিনি।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বীরের বেশে দেশে আসেন বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী শেখ হাসিনা। বাবার দেখা স্বপ্ন সোনার বাংলাকে বাস্তবায়ন ও হারানো গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তখন পদে পদে তাকে নানান বাধা ও ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়েছে। নিজের বাবার বাড়িতে ঢুকার অনুমতি দেয়া হয়নি তাঁকে। হাজারো স্মৃতিবিজরিত বাড়িতে যেতে পারেননি। কোনো স্মৃতি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাননি। রাস্তার পাশে বসেই মিলাদ পড়ান। পরে ১২ জুন নিজের বাড়িতে ঢুকার অনুমতি দেয়া হয়। শত শত স্মৃতিমাখা, ধুলোবালি, ময়লা নিজ হাতে পরিষ্কার করেন। আর চোখের জলে বুক ভাসান তিনি। বাড়িজুড়ে ছিল প্রিয় মানুষদের ছোপ ছোপ রক্ত! না দেখা হলো বাবাকে, না মা, না ভাইদেরকে! না কোনো প্রিয়জনকে। নিজ হাতে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করলেন প্রাণপ্রিয় মানুষগুলোর রক্ত।
একদিকে দুই সন্তান, অন্যদিকে দেশ। এদিকে বোন শেখ রেহানা দেশে এসে দেখেন বড় বোন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। বাচ্চা দুটোকে সময় দেবার মতো সময়ই তিনি করতে পারেন না। তখন তিনি শেখ হাসিনার দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে।
দিনে দিনে তিনি হয়ে যান নিজ বৈশিষ্ট্যে একজন আপসহীন নেত্রী এবং একজন শক্তিমান লেখক। অকপটে নিজের কথা, দেশের কথা লিখতে থাকেন। সেই সাথে ছুটে বেড়ান গণ মানুষের কাছে। প্রিয় বই ‘পথের পাঁচালী’ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা মুখস্থ করা মানুষটি হয়ে যান পুরোদস্তুর একজন লেখক। তবে তাঁর লেখনী শক্তিশালী হবার একটি কারণও ছিল। সেটি হল তাদের বাড়িতে বই পড়ার একটি পরিবেশ ছিল। তাঁর বাবা ও মা একটু সুযোগ পেলেই বই পড়তেন। মায়ের সাথে বই কিনতে নিউমার্কেট যেতেন। তাঁর শাড়ি গহনার শখ ছিল না। শখ ছিল বইপড়া। তাঁর বেশকিছু বই সেই ভয়াল রাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় এখনও তিনি কষ্ট পান।
শেখ হাসিনা তাঁর ওই প্রবন্ধে আরো লিখেছেন, দেশে ফেরার পর সময়টা ছিল অনেক কঠিন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে যাই। গ্রামের সংখ্যা গরিষ্ঠ সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের জীবন ও মনকে জানার জন্য আমি গ্রামের পর গ্রামে যেতে থাকি। গ্রামের বাজার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমি প্রথমবারের মতো গ্রামীণ অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সঙ্গে পরিচিত হই। তাদের প্রয়োজনগুলো বুঝতে পারি। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়; যেমন- বন্যা, সাইক্লোন প্রভৃতির সময় তাদের কী দরকার, তা উপলব্ধি করি।
এই সময়েই আমি মঙ্গা কবলিত এলাকাগুলো চষে বেড়াই (বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের স্থানীয় দুর্ভিক্ষকে মঙ্গা বলা হয়, যার প্রভাব পড়ে পুরো উত্তরবঙ্গের মানুষের উপর)। এবং প্রতিবছর এই মঙ্গা সৃষ্টির প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা করি। আমার স্মৃতিজুড়ে আলোড়ন তুলে যায় বাবার স্বপ্নের কথা, এই দেশের উন্নয়নের জন্য বাবার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাগুলোর কথা। বাবা প্রায়ই আমাদের সঙ্গে তার পরিকল্পনাগুলো শেয়ার করতেন। তিনি বলতেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক আমল থেকে সৃষ্ট দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত দেশ থেকে দারিদ্র্য মুক্ত করা যাবে। এটি নিয়ে তাঁর অনেক বড় পরিকল্পনা ছিল।
আমি এটাও বুঝতে পারি যে, দলের অনেক নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এরপর ১৯৭৫ সালের পর থেকে দল পড়ে গেছে নেতৃত্ব সংকটে। ফলে দেশ পুনর্গঠনের জন্য শেখ মুজিবের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে পদ্ধতিগতভাবে একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। একারণে আমি আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। অনেকে আমাকে বলতে শুরু করেন, যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। আমাদের অতো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নাই।
আমি বিশ্বাস করতাম, রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে দলটিকে আরো শক্তশালী করা প্রয়োজন। তাই তৃণমূলের সবচেয়ে ছোট ইউনিট থেকে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করি আমি। তবে এটি ছিল যথেষ্ট কঠিন, শ্রমসাধ্য এবং একটি প্রতিষ্ঠান নবনির্মাণের কাজ। দলকে এই পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রেও শেখ মুজিবের আদর্শ, দর্শন এবং আকাঙ্ক্ষাগুলো অনেক সাহায্য করেছে। তৃণমূলের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততার কারণেই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশের সংবিধানের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু করার সাথে সাথেই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন শেখ হাসিনা। তাঁকে বারবার কারাবন্দি ও অন্তরীণ জীবনযাপন করতে হয়। বাবার মতো তাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে তাঁর উপরে ২২ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়।
দেশে ফেরার পর নানান প্রতিকূল ও বৈরি পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে এবং ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুর হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ১৯৯৬-২০০১ সালের মেয়াদ সফলতার সাথে শেষ করেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময়ে দেশে অনেকগুলি বড় বড় কাজ সম্পন্ন হয়। মেয়াদের পূর্ণতায় ২০০১ সালের ১৩ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম একটি সরকার মেয়াদ উত্তীর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। পরে ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০০৯-২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা করেন। অত্যান্ত দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু করে সফলতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যান দেশনেত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে এবং দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। ২০১৪ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ আর স্বপ্ন নয়, সেটি এখন বাস্তব। সারাদেশের মানুষ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন। এছাড়াও বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাস, ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প, দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুকেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরসহ মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশি কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। আরও বাকিগুলির কাজ চলছে।
তিনি একজন সফল ও নন্দিত রাষ্টনায়ক। তাঁর সফল রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিনি খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, শান্তি, জঙ্গি দমন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বহু মর্যাদা সম্পন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ২০১১ সালে স্বাস্থ্যখাতে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করায় আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন এবং সাউথ-সাউথ নিউজ ও জাতিসংঘের আফ্রিকা সংক্রান্ত অর্থনেতিক কমিশনের পক্ষ থেকে ‘সাউথ-সাউথ পুরস্কার’ পান তিনি। ২০১১ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দূরদর্শী নেতৃত্ব, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য ‘গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০১৪ সালে নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে অবদানের জন্য ইউনেস্কো কর্তৃক ‘শান্তিবৃক্ষ পুরস্কার’-এ ভূষিত হন। ২০১৬ সালে ইউনাইটেড নেশনস্ উইমেন-এর পক্ষ থেকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘প্লানেট ৫০: ৫০ চ্যাম্পিয়ন’ অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮ সালে নারীদের বৈশ্বিক সম্মেলনে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’, ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য ২০১৮ সালে জাতিসংঘ সদর দফতরের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ইন্টারন্যাশনাল এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হয়। ২০১৯ সালে বার্লিনে নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের জন্য ‘লাইফ টাইম কন্ট্রিবিউশন ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হন দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি ডক্টর অব লজ, ডক্টর অব লিবারেল আর্টস, ডক্টর অব হিউমেন লেটার্স, ডক্টর অব সায়েন্স প্রভৃতি সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি মাদার তেরেসা পদক, সেরেস পদক, পার্সন অব দ্য ইয়ার, পার্ল এস বাক পদক, ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক, নেতাজী মেমোরিয়াল পদক, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ফেলিক্স হোফে বোইনি শান্তি পুরস্কার, এম কে গান্ধী পদক লাভ করেন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেবল সফলভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বই পালন করেন না; রান্না, সংগীত ও বই পড়ার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। তিনি রাষ্ট্রপরিচালনার ফাঁকে এসব গ্রন্থ লিখেছেন। তার লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘ওরা টোকাই কেন?’, ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘দারিদ্র্য বিমোচন, কিছু ভাবনা’, ‘আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম’ ‘বিপন্ন গণতন্ত্র’ ‘আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি’, ‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’, ‘সাদা কালো’, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ এবং ‘Miles to Go, The Quest for Vision-2021’ (two volumes)। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরও বেশ কয়েকটি রচিত গ্রন্থ রয়েছে। প্রকাশ করেছেন বাবার লেখা গ্রন্থ। এছাড়াও সিক্রেট ডকুমেন্টস প্রকাশ করে জাতির কাছে তুলে ধরেছেন সত্যিকারের ইতিহাস।
আওয়ামী লীগকে তৃণমূল বিস্তৃত জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর নির্বাসিত কন্যা শেখ হাসিনা চরম দুঃসময়ে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে হাল ধরেছেন। গণতন্ত্রের সংগ্রামে দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় দল হিসেবে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এনেছেন এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য নিরলস কাজ করছেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে গড়তে চেয়েছিলেন, আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে সেই অবস্থানে পৌঁছে গেছে দেশ। ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত, মানবিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী সমাজ গঠনই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। যেজন্য দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণকে রাজনৈতিক মুক্তি দেন, আর বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে দেশের জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে উন্নয়নশীল এবং মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২১০০ সালের বাংলাদেশ নির্মাণের কথা ভেবে ‘ডেল্টা প্ল্যান’ মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানব উন্নয়ন সূচকে দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তিনি। সারাবিশ্ব দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করছে ও প্রশংসা করছে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি বিশ্বমঞ্চের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীতে এবং নন্দিত সফল রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন।
এতক্ষণ যার কথা বলেছি তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মানবতার মা। বর্তমান বিশ্বে সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠতম সম্মানজনক স্থান অর্জনকারী একজন বিশ্বনেতা। গ্রামের ওই সহজ-সরল কিশোরীটি নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠার পেছনে রয়েছে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর গল্প। তার জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নানান ঘটনা।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় মুজিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ডাক নাম হাসু। বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। অন্যরা হলেন শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেল। বর্তমানে ভাই-বোনদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া কেউই বেঁচে নেই।
শেখ হাসিনার শৈশবের স্বর্ণালী দিনগুলি কেটেছে গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর তীর ঘেঁষা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। মেয়ের প্রথম সন্তান হওয়ায় দাদা শেখ লুৎফর রহমান ও দাদি সাহেরা খাতুনের অতি আদরের নাতনি ছিলেন তিনি। দাদা-দাদির অকৃত্রিম স্নেহ-মায়া, মমতা ও ভালোবাসায় কোলে-পিঠে চড়ে শৈশবের দিনগুলি কাটে তাঁর।
‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ প্রবন্ধে শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার শৈশবের স্বপ্ন-রঙিন দিনগুলি কেটেছে গ্রাম-বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে। জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে। তাল-তমালের ঝোপে বৈচি, দিঘির শাপলা আর শিউলি-বকুল কুড়িয়ে মাথা গেঁথে, ধুলোমাটি গায়ে মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে।
টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর পড়ালেখার হাতেখড়ি। বাল্যশিক্ষা নেন বাড়িতেই। পরিবারের ছোটদের পড়ানোর জন্য সবসময় বাড়িতে মৌলভী, পণ্ডিত ও মাস্টার রাখা হত। সব ছেলে-মেয়েরা সকাল-সন্ধ্যা তাঁদের কাছে পড়ালেখা শিখত। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন শেখ হাসিনা।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তখন পুরনো ঢাকার মোগলটুলির রজনী বোস লেনে ভাড়া বাসায় উঠেন তাঁরা। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টু রোডের বাসায় তাঁরা বসবাস শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনাকে ঢাকা শহরে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করানো হয়। এখন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শেরেবাংলা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে পরিচিত। শুরু হয় তাঁর শহুরে তথা নগর জীবন।
নানা ভাঙা-গড়ায় ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ৬৭৬ নম্বরের তিন কামরার বাড়িতে উঠেন। শ্রমিকের টাকা বাঁচানোর জন্য মা তাদের নিয়ে দেয়ালে পানি দিতেন, ইট বিছাতেন। বাবা জেলে থাকতেন বলে ঈদের সময় কাপড়-চোপড় নতুন তেমন কিছু পেতেন না। বাসায় ছিল সেলাই মেশিন। তাই মা কাপড় সেলাই করতেন। একসময় শেখ হাসিনাও কাপড় সেলাই করা শুরু করেন। নিজের বাড়ির সদস্যদের এবং পাড়া-পড়শিদের কাপড়ও বানিয়ে দিতেন। প্রতি রবিবার ফুফাতো ভাই-বোনরা বেড়াতে আসতেন। তারা আসলে বাড়িটি যেনো আনন্দ-উৎসবে পরিণত হত।
বাবা রাজনীতি করার সুবাদে বাড়িটিতে সব সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আসা-যাওয়া করতেন। বলা যায় বাড়িটি ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একটা আড্ডা ও বৈঠকখানা। বিষয়গুলি বিচক্ষণতার সাথে খেয়াল করতেন কিশোরী শেখ হাসিনা। ছোটবেলা থেকেই তার অন্তদৃষ্টি ছিল খুব প্রখর। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যখন বাবার কাছে দেখা করতে আসতেন, তখন তিনি বাড়ির দোতলার সিঁড়িতে বসে কখনো বই পড়তেন, কখনো ফুফাতো বোনের সাথে চা পান করতেন আর গল্প করতেন। বাসায় প্রচুর ভিড় হত বলে তিনি এবং তাঁর খালাতো বোন ছাদের উপর বসে পড়তেন। অনেক সময় পানির টাংকির উপর পা ঝুলিয়ে গলা ছেড়ে জোরে জোরে পড়তেন। তিনি ঘুম তাড়ানোর জন্যেও জোরে পড়তেন। ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনের সময় তিনি এইচএসসির শিক্ষার্থী। বাসা ভর্তি মানুষ। পড়তে বসলেও মন পড়ে থাকত তাঁর সভায়। জানালার পাশে বসে ঘরে কি আলোচনা করা হচ্ছে, সেগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। মাঝে মাঝে সবাইকে চা বানিয়েও দিতেন।
১৯৪৭ সালের উত্তাল সময়ে শেখ হাসিনার জন্ম। জন্মের সময় তাঁর বাবা ছিলেন কলকাতায়। রাজনীতির অগ্নিঝরা দিনগুলিতে বঙ্গবন্ধু পিতৃত্বকে সবসময়ই বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রথম কন্যা শেখ হাসিনা জন্মের অনেক দিন পরে তাঁকে ছুঁয়ে দেখার সুভাগ্য হয় বঙ্গবন্ধুর। এভাবে বার বার জেলে বিন্দি জীবন কাটানোর সময় বঙ্গমাতার আদর-শাসন ও স্নেহসান্নিধ্যেই শেখ হাসিনার বেড়ে উঠা। মায়ের সীমাহীন আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সার্বক্ষণিক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা বাবা-মায়ের প্রতিটি সংগ্রাম-আন্দোলন কাছে থেকে দেখেছেন। স্কুলজীবনে রাজনীতির নিয়ে মনে যত প্রশ্ন জাগত, সব তিনি বাবার কাছ থেকে জেনে নিতেন। বাবার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। বাবাই ছিলেন তার রাজনীতির শিক্ষাগুরু। আর মা তাঁকে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছেন ছাত্রাবস্থাতেই আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে যেতে।
১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ) থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। শৈশব-কৈশোরে বাবার জেলখানায় বন্দিজীবন দেখতে দেখতে তার শিশুমনে প্রতিবাদের স্পৃহা জেগে উঠে। তাই আজিমপুর গার্লস স্কুলে পড়ার সময়ে ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছাত্রমিছিলে নেতৃত্ব দেন তিনি। ওই মিছিল নিয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
জন্মগতভাবে শেখ হাসিনা বাবার নেতৃত্বের গুণাবলী পেয়েছেন। তাই স্কুলজীবন থেকেই তার নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৬৬-১৯৬৭ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। একই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উঠেন রোকেয়া হলে। তখন ঢাবি ছাত্রলীগের সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির এক উত্তাল সময়। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সেনানিবাসে (ক্যান্টনমেন্ট) নিয়ে যাওয়া হয়। এই মামলাকে (আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা) ঘিরে সারাদেশ তখন আন্দোলনের অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছিল। ওই আন্দোলনে তখনকার রোকেয়া হল শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসিনা ছিলেন আন্দোলনে একজন অকুতোভয় নেত্রী।
১৯৬৯ সাল। সারাদেশে চলছিল গণ আন্দোলন। ছাত্রনেতা হিসেবে ওই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছিলেন শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে তাঁর জীবনে যোগ হয় নতুন অধ্যায়। বাবা তখনো জেলে। বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফজলুল হক হলের সহ সভাপতি মেধাবী ছাত্র পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। বাবা-মায়ের সম্মতিতে ১৭ নভেম্বর পবিত্র শবই বরাতের রাতে বিয়ে করেন তাঁরা। বাবার দোয়া নিতে দুজনে জেলখানায় গেলে তখন মেয়ের জামাইকে জেল গেটে একটি রোলেক্স ঘড়ি উপহার দেন বঙ্গবন্ধু। যা আজীবন সযতনে ছিল পরমাণু বিজ্ঞানীর কাছে। তখন দেশে চলছিল আন্দোলন। এমনই রাজনৈতিক বৈরি পরিস্থিতিতে তাদের শুরু হয় নতুন জীবন। দুজনই ঢাবির শিক্ষার্থী। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, অন্যদিকে গণ আন্দোলন, স্বামী-সংসার, সব সমতালে সুদক্ষ হাতে চালিয়ে যান আত্মপ্রত্যয়ী ও অকুতোভয় এই ছাত্রনেত্রী। তাদের জীবন চলছিল আপন গতিতে।
১৯৭১ সালের জুলাই মাস। দেশে চলছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন। দেশের মানুষ সবসময় আতঙ্কে থাকতো, কখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এসে আঘাত হানে। এভাবে যখন দিনগুলি অতিবাহিত হচ্ছিল জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে শেখ হাসিনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. ওয়াদুদের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করানো হয়। সমস্যা দেখা দেয় সেখানে থাকবেন কে। বেগম মুজিব তখনো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি। তখন বন্দিশালার দায়িত্বে থাকা মেজর হোসেনের কাছে বেগম মুজিবকে শেখ হাসিনার সাথে থাকার অনুমতি দেয়ার কথা বললে, অনুমতি দেননি। বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন এবং এটিএম সৈয়দ হোসেনের স্ত্রী লিলি হোসেন নিজেই সেবিকা সেজে এসে শেখ হাসিনার সাথে থাকেন। ২৭ জুলাই রাত ৮টার দিকে নির্ধারিত সময়ের ৬ সপ্তাহের আগেই শেখ হাসিনার কোল আলো করে আসে তাঁদের ভালোবাসার ফসল। ছেলে সন্তানের মা হন তিনি। নাতিকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হন বেগম মুজিব। প্রথম নাতি। কী নাম রাখা যায়? তখন শেখ হাসিনা জানান, আব্বা আমাকে বলেছিলেন, ছেলে হলে জয় বাংলার ‘জয়’ আর মেয়ে হলে ‘জয়া’ নাম রাখতে। বেগম মুজিব সঙ্গে সঙ্গে নাতিকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন, সত্যিই এ আমার জয়। আর কোন ভাই নেই। জয় আমার সত্যিই ভাই। তাই মুজিব নামের সাথে মিলিয়ে আসল নাম রাখলাম সজিব। সেই থেকে সজিব ওয়াজেদ জয় বাংলার বিজয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দলমত নির্বিশেষে সকলের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ একই সূত্রে গাঁথা এক অচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জন্মের সময় পরিস্থিতির জন্য সয়েছেন সীমাহীন যাতনা। দুশ্চিন্তায় রাত কাটিয়েছেন। খেয়ে না খেয়ে থেকেছেন। সন্তান হওয়ার পর কোন উল্লাস-উচ্ছ্বাসের সুযোগ মেলেনি। আধপেটা থেকে জন্ম দিয়েছেন নিজের আদরের সন্তান জয়কে। জন্মের পর সেই সন্তানের গায়ে জড়াতে পারেননি একটা নতুন জামাও। একজন মা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হৃদয়ে যুদ্ধের সময়ে দুঃসহ জীবনে ছেলের মা হওয়া যে কতটা আনন্দ একইসাথে কতটা বেদনার ছিল তা অনুভব করা সত্যিই অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধু তখন জেলখানায় বন্দি। এভাবে কেটে যায় দিন, সপ্তাহ ও মাস। বছর গড়িয়ে ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় সন্তানের মা হন তিনি। নাম রাখেন সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল। এমনই সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ শেখ হাসিনা স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তাঁর ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে যান। যেদিন চলে যাচ্ছিলেন, সেদিন তাঁর মা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব ভীষণ কেঁদেছিলেন। বড় মেয়েকে চোখের আড়াল করার আগে দুই ছেলেকে বিয়ে করানো হয়। পরের পাঁচ মাসের ঘটনাগুলো ঘটে ছবির মতো। বঙ্গবন্ধুর যাদুকরি নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন দুর্বারগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার। দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেদিন জার্মানিতে থাকার কারণেই শেখ হাসিনা ও বোন রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। দেশের জন্য প্রাণ দেয়ার জন্য তাঁর পিতা হয়ে যান বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মা সর্বংসহা নারী, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা ‘স্ট্রাইভিং টু রিয়ালাইজ দ্য আইডিয়ালস অব মাই ফাদার’ শিরোনামে লেখা এক প্রবন্ধে ১৯৭৫ সালের সেই ট্রাজেডির কথা স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, সেই ট্রাজেডি এখনো আমাকে শোকাহত করে রাখে। সেই নির্মম অমানবিক ঘটনাটির রেশ এখানো আমাদের মন থেকে কাটেনি। সেই সময় পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে আমার স্বামী ড. ওয়াজেদ জার্মানিতে কর্মরত ছিলেন। সেকারণে আমার ছোট বোন রেহানা এবং আমার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম। পরিবারের সবাই মিলে ছোট্ট একটি ট্রিপ দিতে তখন অবস্থান করছিলাম বেলজিয়ামে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে টেলিফোনের কর্কশ শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। যাদের বাসায় আমরা উঠেছিলাম, তিনি ফোনটি ধরলেন। কিন্তু এরপর তিনি আমার সঙ্গে আর কথা বলতে চাইলেন না। আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বললেন তিনি। আমার স্বামী তখন আমার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর আমার স্বামী আমার দিকে ঘুরে তাকালেন এবং বললেন, বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থান হয়েছে। তখন এর বেশি আর কিছুই বললেন না তিনি। কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমি অনুভব করলাম, ঢাকায় আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে।
তিনি আরও বলেছেন, ঘটনার আকস্মিকতায় আমি শোকাহত এবং বিমূঢ় হয়ে পড়ি। আমার মুখ থেকে তখন একটি কথাই বের হয় শুধু, তাহলো, যদি কোনো অভ্যুত্থান হয়ে থাকে, তাহলে আমি সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি। এরপর আমরা জার্মানির বনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে যাই। তখনই জানতে পারি হৃদয়বিদারক ঘটনাটির কথা। আমার বাবা-মা, নতুন বিয়ে করা দুই ভাই ও তাদের স্ত্রী, এমনকি আমার শিশু-ভাই রাসেলকেও হত্যা করা হয়েছে। সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ ১৮ জনের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে আমার হৃদয় এখনো কান্নায় ভিজে যায়।এরপর খুনিরা রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করায়, আমি ও আমার বোনের দেশে ফেরার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন দুই শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দীর্ঘ ছয় বছর মানবেতর পরিস্থিতিতে নির্বাসিত জীবনযাপন করি। ঘাতকদের গুপ্ত হামলার আতঙ্ক বুকে চেপে প্রতিনিয়তই শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে ছুটতে হয়েছে আমাদের।
পশ্চিম জার্মানি থেকে সেই সময় ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া । ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদের ফাঙ্কফুট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লি পৌঁছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, স্বামী ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান। বিমানবন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। সেখানে কারো সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরিচয় না দেয়ার পরমর্শ দেয়া হয়েছিল তাদের। দিল্লিতে পৌঁছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানেই তারা ১৫ আগস্টের পুরো ঘটনার কথা বিস্তারিতভাবে জানতে পারেন।
১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ফলে শেখ হাসিনা হয়ে যান এতিম এবং ভাই হারা বোন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। যে বয়সে নিজের জীবনের সকল আনন্দকে একটি মানচিত্রে করে শান্তির পায়রার মতো উড়ার কথা। হঠাৎ এক কালবৈশাখী ঝড়ে সেই সাজানো সুন্দর জীবনটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। জার্মানি থেকে তিনি যুক্তরাজ্য এবং দিল্লিতে ছয় বছর নিবার্সিত জীবনযাপন করেন। দিল্লিতে দুই বোন ছদ্মনামে থাকতেন। এক সময় শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যে যান এবং সেখানে তিনি বিয়ে করেন।
পরিস্থিতির কারণে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে অনেকটা একা হয়ে যান শেখ হাসিনা। কাছের বলতে ছিলেন তার ছোট বোন রেহানা। তিনিও থাকতেন যুক্তরাজ্যে। এই নির্বাসিত জীবনে ১৯৭৮ সালে দিল্লিতে ছুটে যান খান সাহেব ওসমান আলী এম এল এ’র ছেলে ও তখনকার জাতীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম শামসুজ্জোহা এবং তার পরিবারে। সেদিন তিনি ছিলেন বিমর্ষ এবং তাদের পেয়ে শুধুই কেদেঁছিলেন। পরে ১৯৮১ সালে ৯ এপ্রিল দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করতে যান শেখ হাসিনা। সেখানে মাজারের খাদেম বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি কাগজ তাকে দেখান, যেখানে তারিখ উল্লেখ করা ছিল ৯ এপ্রিল, ১৯৪৬ সাল। বাবার হাতের স্বাক্ষর দেখে শেখ হাসিনা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন দেশে ফেরার।
দীর্ঘ সময় মানবেতর নির্বাসন শেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা ওই প্রবন্ধে বলেছেন, ১৯৮১ সালে নির্বাসিত জীবনের অন্ধকার-সুরঙ্গের শেষপ্রান্ত থেকে যেনো একটুখানি আলোর রেখা দেখলাম। ১৯৫০-এর দশকে আমার বাবা যে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই দল আমাকে তাদের সভাপতি নির্বাচিত করলো। সারাদেশের মানুষ স্বাগত জানালো দলের এই সিদ্ধান্তকে। ওই সময়কার সামরিক সরকারের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এরপর আমি (১৯৮১ সালের ১৭ মে) বাংলাদেশে ফিরে এলাম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার কন্যা হওয়ার পরেও, দেশে ফেরার পর আমার রাজনৈতিক পদচারণা সহজ ছিল না। প্রতিটি ধাপে ধাপে ছিল বিভিন্ন সমস্যা, ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা। তবুও ওই ভয়াবহ সময়ে আমি আমার যাবতীয় আবেগ এবং শক্তিকে এক করে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করি। ঝুঁকি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর বিকল্প কিছু ভাবিনি।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বীরের বেশে দেশে আসেন বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী শেখ হাসিনা। বাবার দেখা স্বপ্ন সোনার বাংলাকে বাস্তবায়ন ও হারানো গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তখন পদে পদে তাকে নানান বাধা ও ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়েছে। নিজের বাবার বাড়িতে ঢুকার অনুমতি দেয়া হয়নি তাঁকে। হাজারো স্মৃতিবিজরিত বাড়িতে যেতে পারেননি। কোনো স্মৃতি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাননি। রাস্তার পাশে বসেই মিলাদ পড়ান। পরে ১২ জুন নিজের বাড়িতে ঢুকার অনুমতি দেয়া হয়। শত শত স্মৃতিমাখা, ধুলোবালি, ময়লা নিজ হাতে পরিষ্কার করেন। আর চোখের জলে বুক ভাসান তিনি। বাড়িজুড়ে ছিল প্রিয় মানুষদের ছোপ ছোপ রক্ত! না দেখা হলো বাবাকে, না মা, না ভাইদেরকে! না কোনো প্রিয়জনকে। নিজ হাতে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করলেন প্রাণপ্রিয় মানুষগুলোর রক্ত।
একদিকে দুই সন্তান, অন্যদিকে দেশ। এদিকে বোন শেখ রেহানা দেশে এসে দেখেন বড় বোন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। বাচ্চা দুটোকে সময় দেবার মতো সময়ই তিনি করতে পারেন না। তখন তিনি শেখ হাসিনার দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে।
দিনে দিনে তিনি হয়ে যান নিজ বৈশিষ্ট্যে একজন আপসহীন নেত্রী এবং একজন শক্তিমান লেখক। অকপটে নিজের কথা, দেশের কথা লিখতে থাকেন। সেই সাথে ছুটে বেড়ান গণ মানুষের কাছে। প্রিয় বই ‘পথের পাঁচালী’ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা মুখস্থ করা মানুষটি হয়ে যান পুরোদস্তুর একজন লেখক। তবে তাঁর লেখনী শক্তিশালী হবার একটি কারণও ছিল। সেটি হল তাদের বাড়িতে বই পড়ার একটি পরিবেশ ছিল। তাঁর বাবা ও মা একটু সুযোগ পেলেই বই পড়তেন। মায়ের সাথে বই কিনতে নিউমার্কেট যেতেন। তাঁর শাড়ি গহনার শখ ছিল না। শখ ছিল বইপড়া। তাঁর বেশকিছু বই সেই ভয়াল রাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় এখনও তিনি কষ্ট পান।
শেখ হাসিনা তাঁর ওই প্রবন্ধে আরো লিখেছেন, দেশে ফেরার পর সময়টা ছিল অনেক কঠিন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে যাই। গ্রামের সংখ্যা গরিষ্ঠ সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের জীবন ও মনকে জানার জন্য আমি গ্রামের পর গ্রামে যেতে থাকি। গ্রামের বাজার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমি প্রথমবারের মতো গ্রামীণ অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সঙ্গে পরিচিত হই। তাদের প্রয়োজনগুলো বুঝতে পারি। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়; যেমন- বন্যা, সাইক্লোন প্রভৃতির সময় তাদের কী দরকার, তা উপলব্ধি করি।
এই সময়েই আমি মঙ্গা কবলিত এলাকাগুলো চষে বেড়াই (বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের স্থানীয় দুর্ভিক্ষকে মঙ্গা বলা হয়, যার প্রভাব পড়ে পুরো উত্তরবঙ্গের মানুষের উপর)। এবং প্রতিবছর এই মঙ্গা সৃষ্টির প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা করি। আমার স্মৃতিজুড়ে আলোড়ন তুলে যায় বাবার স্বপ্নের কথা, এই দেশের উন্নয়নের জন্য বাবার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাগুলোর কথা। বাবা প্রায়ই আমাদের সঙ্গে তার পরিকল্পনাগুলো শেয়ার করতেন। তিনি বলতেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক আমল থেকে সৃষ্ট দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত দেশ থেকে দারিদ্র্য মুক্ত করা যাবে। এটি নিয়ে তাঁর অনেক বড় পরিকল্পনা ছিল।
আমি এটাও বুঝতে পারি যে, দলের অনেক নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এরপর ১৯৭৫ সালের পর থেকে দল পড়ে গেছে নেতৃত্ব সংকটে। ফলে দেশ পুনর্গঠনের জন্য শেখ মুজিবের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে পদ্ধতিগতভাবে একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। একারণে আমি আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। অনেকে আমাকে বলতে শুরু করেন, যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। আমাদের অতো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নাই।
আমি বিশ্বাস করতাম, রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে দলটিকে আরো শক্তশালী করা প্রয়োজন। তাই তৃণমূলের সবচেয়ে ছোট ইউনিট থেকে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করি আমি। তবে এটি ছিল যথেষ্ট কঠিন, শ্রমসাধ্য এবং একটি প্রতিষ্ঠান নবনির্মাণের কাজ। দলকে এই পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রেও শেখ মুজিবের আদর্শ, দর্শন এবং আকাঙ্ক্ষাগুলো অনেক সাহায্য করেছে। তৃণমূলের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততার কারণেই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশের সংবিধানের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু করার সাথে সাথেই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন শেখ হাসিনা। তাঁকে বারবার কারাবন্দি ও অন্তরীণ জীবনযাপন করতে হয়। বাবার মতো তাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে তাঁর উপরে ২২ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়।
দেশে ফেরার পর নানান প্রতিকূল ও বৈরি পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে এবং ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুর হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ১৯৯৬-২০০১ সালের মেয়াদ সফলতার সাথে শেষ করেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময়ে দেশে অনেকগুলি বড় বড় কাজ সম্পন্ন হয়। মেয়াদের পূর্ণতায় ২০০১ সালের ১৩ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম একটি সরকার মেয়াদ উত্তীর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। পরে ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০০৯-২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা করেন। অত্যান্ত দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু করে সফলতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যান দেশনেত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে এবং দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। ২০১৪ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ আর স্বপ্ন নয়, সেটি এখন বাস্তব। সারাদেশের মানুষ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন। এছাড়াও বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাস, ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প, দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুকেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরসহ মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশি কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। আরও বাকিগুলির কাজ চলছে।
তিনি একজন সফল ও নন্দিত রাষ্টনায়ক। তাঁর সফল রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিনি খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, শান্তি, জঙ্গি দমন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বহু মর্যাদা সম্পন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ২০১১ সালে স্বাস্থ্যখাতে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করায় আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন এবং সাউথ-সাউথ নিউজ ও জাতিসংঘের আফ্রিকা সংক্রান্ত অর্থনেতিক কমিশনের পক্ষ থেকে ‘সাউথ-সাউথ পুরস্কার’ পান তিনি। ২০১১ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দূরদর্শী নেতৃত্ব, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য ‘গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০১৪ সালে নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে অবদানের জন্য ইউনেস্কো কর্তৃক ‘শান্তিবৃক্ষ পুরস্কার’-এ ভূষিত হন। ২০১৬ সালে ইউনাইটেড নেশনস্ উইমেন-এর পক্ষ থেকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘প্লানেট ৫০: ৫০ চ্যাম্পিয়ন’ অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮ সালে নারীদের বৈশ্বিক সম্মেলনে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’, ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য ২০১৮ সালে জাতিসংঘ সদর দফতরের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ইন্টারন্যাশনাল এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হয়। ২০১৯ সালে বার্লিনে নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের জন্য ‘লাইফ টাইম কন্ট্রিবিউশন ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হন দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি ডক্টর অব লজ, ডক্টর অব লিবারেল আর্টস, ডক্টর অব হিউমেন লেটার্স, ডক্টর অব সায়েন্স প্রভৃতি সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি মাদার তেরেসা পদক, সেরেস পদক, পার্সন অব দ্য ইয়ার, পার্ল এস বাক পদক, ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক, নেতাজী মেমোরিয়াল পদক, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ফেলিক্স হোফে বোইনি শান্তি পুরস্কার, এম কে গান্ধী পদক লাভ করেন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেবল সফলভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বই পালন করেন না; রান্না, সংগীত ও বই পড়ার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। তিনি রাষ্ট্রপরিচালনার ফাঁকে এসব গ্রন্থ লিখেছেন। তার লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘ওরা টোকাই কেন?’, ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘দারিদ্র্য বিমোচন, কিছু ভাবনা’, ‘আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম’ ‘বিপন্ন গণতন্ত্র’ ‘আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি’, ‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’, ‘সাদা কালো’, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ এবং ‘Miles to Go, The Quest for Vision-2021’ (two volumes)। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরও বেশ কয়েকটি রচিত গ্রন্থ রয়েছে। প্রকাশ করেছেন বাবার লেখা গ্রন্থ। এছাড়াও সিক্রেট ডকুমেন্টস প্রকাশ করে জাতির কাছে তুলে ধরেছেন সত্যিকারের ইতিহাস।
আওয়ামী লীগকে তৃণমূল বিস্তৃত জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর নির্বাসিত কন্যা শেখ হাসিনা চরম দুঃসময়ে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে হাল ধরেছেন। গণতন্ত্রের সংগ্রামে দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় দল হিসেবে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এনেছেন এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য নিরলস কাজ করছেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে গড়তে চেয়েছিলেন, আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে সেই অবস্থানে পৌঁছে গেছে দেশ। ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত, মানবিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী সমাজ গঠনই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। যেজন্য দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণকে রাজনৈতিক মুক্তি দেন, আর বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে দেশের জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে উন্নয়নশীল এবং মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২১০০ সালের বাংলাদেশ নির্মাণের কথা ভেবে ‘ডেল্টা প্ল্যান’ মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানব উন্নয়ন সূচকে দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তিনি। সারাবিশ্ব দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করছে ও প্রশংসা করছে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি বিশ্বমঞ্চের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীতে এবং নন্দিত সফল রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন।