ছোটবেলায় আর পাঁচটা মেয়ের মতো তার চোখে স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে আইটিতে ক্যারিয়ার গড়ে সম্মানজনক একটা চাকরি করার। বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল তার প্রতিকূলে। যে সময়টাতে স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, বন্ধুদের সাথে হেসে-খেলে আনন্দে জীবন কাটানোর কথা ওই সময়টাতে বিয়ে হয়ে যায় নিশা জাহানের। তবে বিয়ে নামক সামাজিক প্রথা তার পড়াশোনা, স্বপ্নের ক্যারিয়ারকে আটকে রাখতে পারেনি। -এভাবেই জীবন সংগ্রামের গল্প বলছিলেন অদম্য নারী নিশা জাহান।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন নিশা। কথায় কথায় জানালেন তার জীবনের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার নিয়ে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের কথা।
বগুড়ার গাবতলীতে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিশা জাহানের। গ্রামের সাধারণ পরিবেশেই তার বেড়ে ওঠা।
বাবা আব্দুল খালেক। দীর্ঘ ১১ বছর ধরে মালেশিয়াতে চাকরি করছেন। মা গৃহিনী। তিন বোনের মধ্যে নিশা দ্বিতীয়। তার বাবার স্বপ্ন ছিল একজন ছেলের। ছেলে থাকলে তার মনের কষ্টগুলো বুঝতে পারতো। নিশার মনেও বাবার সেই স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছা ছিল ছোটবেলা থেকেই। এর জন্যই মূলত তিনি সংগ্রাম করে নিজেকে তৈরি করছেন। যাতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তিনি বাবাকে সাপোর্ট দিতে পারেন।
বাবা চাকরি করতে যাবেন মালেশিয়াতে। নিশা তখনো সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছিলেন। তিন বোনের মধ্যে দেখতে বেশ সুশ্রী হওয়াতে নিশার দাদি বাবাকে বললেন, মালেশিয়াতে যাওয়ার আগে যেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যান। ছেলে মায়ের কথাও ফেলতে পারেননি। মেয়েকে গ্রামে রেখে গেলে যদি কোনো অঘটন ঘাটে যায়। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সংসার জীবনের মানে বোঝার আগেই স্কুলে পড়া মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন আব্দুল খালেক। শুরু হয় নিশার নতুন জীবন। অন্যদিকে বাবা পাড়ি জমান মালেশিয়াতে।
ব্যক্তিগত জীবনে নিশার স্বামী সুমন চাকরি করেন একটা বেসরকরি প্রতিষ্ঠানে। মেয়ে মুমতাহিনা পড়ে ক্লাস থ্রিতে। ছেলে তনয়। বয়স দুই বছর।
বিয়ের পরে ক্লাসমেট, বন্ধু-বান্ধবীদের স্কুলে যেতে দেখে নিশার খুব আফসোস হতো। তারও একটা স্বপ্ন ছিল আইটিতে ক্যারিয়ার গড়ে সম্মানজনক একটা চাকরি করার। তিনি যখন দেখতেন তার বয়সের ছেলে-মেয়েরা কলেজে যাচ্ছে, পড়াশোনা করে ভাল চাকরি করছে এগুলো তাকে ভীষণ কষ্ট দিতো। হতাশ করতো।
ছাত্রী হিসেবে মেধাবী ছিলেন নিশা। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের চেষ্টায় কম্পিটার চালানোও শেখেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভাল মতো ক্যারিয়ার গড়তে লিড জেনারেশন প্রতিষ্ঠান থেকে এডমিন সাপোর্ট, এসইও, ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ডেটা অ্যান্ট্রি, ওয়েব রিসার্চ, ইমেল মার্কেটিং বিষয়গুলো নিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কিন্তু ইংরেজিতে দুর্বল থাকায় ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিংয়ের কাজটাগুলোও ভাল মতো তার করা হয়ে ওঠেনি। কারণ অনলাইনে কোনো কাজের জন্য আবেদন করলে কাজটি নিয়ে বায়ারের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে হতো। বায়ার ইন্টারভিউতে ইংরেজিতে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতেন। তখন তার এক মামাতো ভাইয়ের সাহায্যে ওই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। এভাবে কিছুদিন কাজ করার পরে মামাতো ভাই নিশার উপরে খুব বিরক্ত হন। একদিন তাকে বললেন, আপনি ইংরেজি জানেন না তাহলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করেন কেন? কথাটা নিশাকে খুব আঘাত করে। এরপরে ওই ভাইয়ের কাছে আর যাননি তিনি।
কোথা থেকে, কীভাবে ইংরেজি শেখা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকেন নিশা। একদিন ফেসবুকিং করার সময় অনলাইনে একটা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে তার। প্রশিক্ষণটার বিষয় ছিল অ্যাডমিন সাপোর্ট। এখানে ইংরেজিতে কথা বলা ও কাজ করার হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে নিশা কোর্সটা করতে গেলে বাধে বিপত্তি। যে ফরমটা তাকে পূরণ করতে দেয়া হয় ওই কোর্সের নাম ইংরেজিতে ‘Admin’ শব্দটা লিখতে পারলেও ‘Support’ ঠিক মতো লিখতে পারেননি। বিষয়টা তাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলেছিল। পরের অংশে শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস লিখতেও তার অস্বস্তি লাগছিল। ওই দিন থেকে ইংরেজি শেখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন নিশা। সেই সাথে সিদ্ধান্ত নেন স্কুলে ভর্তি হয়ে পুনরায় লেখাপড়া শুরু করার। ওখান থেকে বাড়িতে ফিরে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। অন্যদিকে, ইংরেজি শেখার জন্য বেশ কয়েকটা কোচিং সেন্টারে যোগাযোগ করেও পছন্দ না হওয়ায় আর ভর্তি হননি।
অ্যাডমিন সাপোর্ট ট্রেনিংয়ের ক্লাসে একদিন সবার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষক বললেন, তোমাদের যদি ইংরেজিতে সমস্যা থাকে তাহলে ‘সার্চ ইংলিশ’ নামে একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে যেখানে তোমরা যুক্ত হতে পার। ওখানে কেউ তোমাদের ভুল ধরবে না, কেউ তোমাদের ভুল দেখে হাসাহাসি করবে না, লজ্জায় ফেলবে না, তোমরা তিনমাসেই তোমাদের ইংরেজির দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
সময়টা ছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বাসায় গিয়ে ‘সার্চ ইংলিশ’ গ্রুপের সাথে যুক্ত হন নিশা। শুরুতে দিন-রাত শুধু গ্রুপের পোস্ট পড়ে কমেন্ট লেখার চেষ্টা করতেন। দুই মাসের মধ্যেই তিনি ইংরেজি লেখাতে ভাল উন্নতি করতে সক্ষম হন। ওই সময়ে ‘সার্চ ইংলিশ’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রাজিব আহমেদকে উদ্দেশ করে একটা পোস্ট লেখেন। ওই পোস্টে নিশা লেখেন, স্যার আমি শুধু এতটুকুই লেখাপড়া করেছি। আমি কিছু একটা করতে চাই। আমাকে সাহায্য করুন। ওই পোস্টটা রাজিব আহমেদের নজরে পড়েনি। আবারো হতাশ হন এই উদ্যোমী নিশা।
সার্চ ইংলিশ গ্রুপ থেকেই নিশা ফেসবুকে ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ (ডিএসবি) গ্রুপে যুক্ত হন। একদিন তার চোখে পড়ে ডিএসবি গ্রুপে আড্ডা হচ্ছে। পরের দিন থেকে নিয়মিত ওই আড্ডায় যোগ দেন। আস্তে আস্তে আড্ডা পোস্টগুলো উপভোগ করতে থাকেন। ডিএসবি গ্রুপ থেকে তার স্বপ্ন পূরণের সব কিছুই শেখার গাইডলাইন তিনি পেয়ে যান। দিন-রাত অনলাইনে সময় দিয়ে ওই সব বিষয়গুলো পড়তে থাকেন। নিজের উদ্যোগে গ্রুপ মডারেটর রাজিব আহমেদের সাথে যোগাযোগ করে উনার গাইড লাইনগুলো আন্তরিকতার সাথে পালন করে যেতে থাকেন। এক সময় সার্চ ইংলিশ গ্রুপের নিয়মিত ওয়ার্কশপে যোগ দেন। প্রথম তিনদিন ওয়ার্কশপে নিশা কিছুই করেননি। শুধু মেন্টরদের (অনু সরকার, জান্নাত কাদের চৌধুরি, ফারজানা তামান্না) কথোপকথন সবকিছু শুনেছেন। চতুর্থ দিনের মাথায় তিনি ইংরেজিতে কথোপকথন করেন। ওই ওয়ার্কশপে এক ঘন্টার মতো কথা বলেছিলেন নিশা। ওটা ছিল তার জীবনের প্রথম ইংরেজিতে কথোপকথন। প্রথমে কথা বলতে অস্বস্তি লাগলেও পরে ঠিক মতো কথা বলতে সক্ষম হন। এভাবেই ধীরে ধীরে তার জার্নিটা শুরু হয়।
ওয়ার্কশপে যুক্ত হবার পরে প্রথমদিকে অনেক কষ্ট করতে হতো নিশাকে। তার স্বামী জানতেন না যে তিনি ফেসবুকে কি করেন। দিনের বেশির ভাগ সময়ে স্ত্রীর ফেসবুকে থাকাটা তার কাছে একটা দৃষ্টিকটু ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। একদিন স্বামী তার কাছে সারাক্ষণ ফেসবুকে থাকার কারণ জানতে চাইলেন। কিন্তু নিশা স্বামীকে সঠিকভাবে বিষয়টা বোঝাতে ব্যর্থ হন। তাই প্রথমদিকে তাদের মধ্যে এ নিয়ে একটু ঝামেলা হয়। কারণ তখন ছেলেটা অনেক ছোট। এক সময় তার পরিবার এবং স্বামীকে বোঝাতে সক্ষম হন। তারপর থেকে নিশার ইংরেজি চর্চার পথচলাটা আরো সুন্দর হয়ে উঠে।
স্বামী, সন্তান, পরিবার স্কুলের পড়াশোনা সব সামলে দীর্ঘ এক বছর রাজিব আহমেদের গাইডেন্স অনুসরণ করে ইংরেজি নিয়ে নিশার মনে যে ভয়টা ছিল সেটা এখন একেবারেই নেই। নিশা এখন সবার সামনে কথা বলতে পারেন।
সার্চ ইংলিশ গ্রুপের অন্য সদস্যদের ভিডিও দেখতে দেখতে আত্মপ্রত্যয়ী নিশা সিদ্ধান্ত নেন নিজে ভিডিও বানানোর। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথমে স্ক্রিপ্ট লেখেন। ১০০ বারেরও বেশি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রিহার্সাল করেন। পরে তা রেকর্ড করেন এবং গ্রুপে পোস্ট করেন। ওই দিনটা ছিল তার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন।
স্পোকেন ইংলিশে উন্নতি করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিও বানাতে শুরু করেন নিশা। এর জন্য তিনি বেশি বেশি ইংলিশ কথোপকথন শুনতেন আর রিডিং প্র্যাকটিজ করতেন। শুদ্ধ উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি বিষয়ে কিছু স্টাডি করেন অধ্যবসয়ী নিশা। দীর্ঘ সময়ে চেষ্টা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি সার্চ ইংলিশ গ্রুপে ১০ হাজার ভিডিও আপলোড করেছেন।
নিজের অর্জন সম্পর্কে নিশার ভাষ্য, আলহামদুলিল্লাহ আমি এখন বাইরের আর্টিকেল পড়ে বুঝতে পারি। ইংরেজিতে যে কোনো ভিডিও করতে পারি। ইংরেজি সংবাদপত্র পড়তে পারি। অনুবাদ করতে পারি। নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারি। এমনকি আমার মধ্যে এতটুকু আত্মবিশ্বাস আছে যে, বাইরের যে কোনো লোকের সাথে আমি কোনো ভয়ভীতি, অস্বস্তি ছাড়াই কথা বলতে পারব ইনশাল্লাহ। আর এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে শুধু রাজিব আহমেদ স্যারের জন্যে। আমি আল্লাহর পরে স্যারের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ যে, স্যার আমাকে উনার দুইটি গ্রুপের মাধ্যমে ইংরেজিতে দক্ষ হতে সুযোগটা দিয়েছেন এবং নিজের হাতে আমাকে তৈরি করেছেন।
জীবনের মানে বোঝার আগেই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। পরে মাঝে বেশ কিছুদিন আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু আবার পড়ালেখা শুরু করেছি, তাই এটা আগে ভালভাবে শেষ করতে চাই। এরপরে আইটিতে ক্যারিয়ার গড়তে চাই। সার্চ ইংলিশ গ্রুপ ও ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ গ্রুপের সাথে যোগ হয়ে অসংখ্য উদ্যোক্তাদের নিয়ে লেখা পড়ে এখন উদ্যোক্তা হতে ইচ্ছা হচ্ছে মনে। স্বপ্ন দেখি উদ্যোক্তা হিসেবে মেয়েদের নিয়ে, মেয়েদের কল্যাণে কিছু কাজ করার। বিশেষ করে গ্রামের গরিব-অসহায় মেয়ের জন্য কিছু কাজ করার। এর জন্য আগে আমাকে তৈরি হতে হবে।