আহ্বানে সাড়া না দিলে এনবিআর ও সচিবালয় ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি

প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png টেকভয়েস২৪ রিপোর্ট
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
ইন্টারনেটকে সামাজিক পণ্য বিবেচনা করে এই সেবাকে নাগরিক মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির দাবি জনিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে এর ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপে মনোনিবেশ না করে সুলভে সকল নাগরিকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। আর এই আহ্বানে সাড়া না দিলে এনবিআর এবং সচিবালয় ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ভোক্তা সমাজ।

বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ইন্টারনেট প্রাপ্তির নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ে (এনসিওরিং ইন্টারনেট অ্যাক্সেস ফর এভরিওয়ান চ্যালেঞ্জেস এন্ড রিফর্ম) গোলটেবিল আলোচনায় এই দাবি জানান বক্তারা। সেমিনারের শুরুতেই দেশের ইন্টারনেট খাতে করভার তুলে ধরেন ভয়েস ফর রিফর্মের সহ-সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর।

টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রি পলিসি অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্ম (টিপ্যাপ)-এর আয়োজনে সভায় কেন দেশে ইন্টারনেটের দাম বেশি সেই পর্যালোচনা তুলে ধরেন তিনি। এ সময় ডেটা ট্রান্সমিশনে সরকার দুটি প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়েও কিভাবে ইন্টারনেটের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তা তুলে ধরা হয়। পরামর্শ দেওয়া হয় অব্যবহৃত তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়ে এবং অবকাঠামো ভাগাভাগি করার ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়ার। একই সঙ্গে সেবা গ্রাহকের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রয়োজনে ক্যাবল টানার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা উঠিয়ে নেওয়ার।

তিনি বলেন, আমার মনে হয়, সরকার ইন্টারনেটকে তাদের দার্শনিক চিন্তার জায়গা থেকে বিলাসী পণ্যের জায়গা থেকে বাদ দিয়ে সামাজিক অন্য হিসেবে বিবেচনা করা। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা এই দর্শন ধারণ করলেও দ্বিতীয় স্তরের কর্মকর্তারা তা বুঝতে চাচ্ছেন না। ফলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে জুলাই বিপ্লবের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা ইন্টারনেট।

ফাহিম মাশরুর বলেন, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে প্রতিমাসে একজন ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী গড়ে ১০০ গিগাবাইট ডেটা ব্যবহার করে, গ্রামে এর পরিমান মাত্র ৬ গিগাবাইট। ভারতে গড়ে একজন মোবাইল ডাটা ব্যবহারকারী বাংলাদেশ থেকে ৩ গুন বেশি ডাটা ব্যবহার করে। মোবাইল ডাটা চার্জ এত বেশি হওয়াতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রয়োজনীয় সেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আমরা পার্শবর্তী দেশগুলো থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ছি।

বক্তব্যে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার আশা প্রকাশ করে বলেন, বছরের পর বছর এই খাতের উপরে কর আরোপ না করে মানুষের মধ্যে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখার সুযোগ করে দিতে সরকার পুরনো কর কমাবে। সরকার যেন মোবাইল টেলিকম নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা করেন। কেননা অতীতে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে অনেক বড় বড় কথা শুনেছি। কিন্তু সত্যি কারের ইন্টারনেট ভিত্তিক উন্নয়ন হয়নি।

বেসিস সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির ইন্টারনেটের দাম বাড়ালে সমাজে এবং অর্থনীতিতে কি কি ধরনের বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইন্টারনেটের দাম বাড়ার ফলে ই-লার্নিং, ডিসটেন্স লার্নিং, টেলিমিডিসিন সেবা ব্যাহত হবে। এ ছাড়াও বিশ্ববাজারে ফ্রিল্যান্সাররা প্রতিযোগিতার বাজার হারাবে। বিষয়গুলো সরকারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া দরকার। আমি মনে করি, টেলিকম অপারেটরদের সঙ্গে সঙ্গে এমবিএনও চালু করা দরকার। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং গ্রাহকেরা লাভবান হবেনা। এই খাত থেকে মধ্যস্বত্বভোগী কমাতে হবে। দুই বা চারটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়ায় তাদের বাঁচিয়ে রাখতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা করা যাবে না।

ইন্টারনেট না থাকলে জুলাই বিপ্লব ইফেক্টিভলি সম্ভব হতো না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ইন্টারনেটের দাম বাড়ানোর ফলে সমাজে নাগরিক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। ডেটার দাম বাড়লে ই-কমার্সে এর প্রভাব পড়বে। এ খাতে ভ্যাট মওকুফ করলে ডিজিটাল ইকোনোমি আরও বাড়বে।

মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার অপারেটরদের কাছ থেকে শতকরা ৭০-৮০ টাকা নিয়ে যাওয়ায় দেশে ইন্টারনেটের সেবা মান একেবারে নেমে গেছে। কর্মকর্তার কারণেই দেশে রাজস্ব বাড়ছে না। যেভাবে এসআরও জারি করা হয়েছে তা প্রত্যাহার করা না হলে আমরা সোম অথবা মঙ্গলবার এনবিআর ঘেরাও করবো। প্রয়োজনে সচিবালয়কেও ছাড়বো না। অর্থ উপদেষ্টা কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করেছেন। এর জন্য সম্পূর্ণভাবে উনি দায়ী।

এ সময় গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় করলেও তাদের অধিকার রক্ষায় মাঠে না আসায় মোবাইল অপারেটরদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, আপনারা যদি ফকিরের কাছে সংযোগ দেন। তার কাছে লাইন দিয়ে পয়সা নিতে পারেন। তাহলে গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় মাঠে নামতে হবে।

টেলিকম বিশেষজ্ঞ ও বিল্ডকনের প্রধান মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ইন্টারনেটের উপর আরোপিত করতে ধনী-গরি সবার উপরেই সমান হারে পড়ছে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থায় এটা একটা বৈষম্য সৃষ্টি করছে। সোনার ডিম পাড়া এই হাঁসটি নাম মরা পর্যন্ত এনবিআর যেন এই ভ্যাট চালিয়ে যাচ্ছে। সহজেই গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করতে পারায় এমনটা করছে। এতে গ্রামীণফোন সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে এই শিল্পটি ভেঙে পড়বে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার আগের সরকারের চিন্তা-ভাবনাতেই এগিয়ে চলছে। যারা সৎভাবে ট্যাক্স পে করে এনবিআর তাদের ওপর আরও বেশি ট্যাক্স আরোপ করে। সামনের দিনে মোবাইল ও ইন্টারনেটের ওপর আরও ট্যাক্স আরোপ করা হবে, কারণ এটা করা সহজ। এটা শুধু গ্রাহকদের ওপর নয় বরং অপারেটরদের মধ্যেও বৈষম্য সৃষ্টি করবে।

সরকার কর বাড়ানোর পরও আমাদের দাম কমাতে বলে। আমরা ঠিক দামটা কোথায় কমাবো?- প্রশ্ন রাখেন রবির কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার শাহেদ আলম।

আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, আমাদের সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই এনবিআর কর বাড়িয়েছে। এতে অবৈধ আইএসপি বাড়বে। কমবে মানসম্মত সেবা। তবে এতে প্রকারান্তরে সরকারের রাজস্ব কমবে।

আইজিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, ওই সময় বিরোধী গণ আন্দোলনের পরে বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা গত ৯ তারিখে নতুন করা রোগের পর আমাদের হতাশ করেছে। কেননা ইন্টারনেট এখন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। সরকার বই দিতে না পারলেও আমরা ইন্টারনেট থেকে টা ডাউনলোড করতে পেরেছি। বাংলাদেশের কোন খাতই ইন্টারনেট ছাড়া তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ধরে রাখতে পারবে না। মানুষের কর্ম ঘন্টা বাঁচছে। কর বাড়ানোর ফলে কর্পোরেট এবং প্রান্তিক পর্যায়ে প্যাকেজ ডাউনলোড করছে। এতে কর্ম ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি কমছে। এটা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার এটা বুঝতে পারছে কিনা জানিনা। ৯ তারিখের পর থেকেই ইন্ডিয়া থেকে অধিকাংশ আইএসপিকে নক করা শুরু করেছে। তারা অফিসে আসতে চাচ্ছে। এটা বৈষম্য বিরোধী সরকারের কাছে কোনভাবেই আশা করা যায় না।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ এখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহৃত হচ্ছে এক কোটি থেকে ৮০ লাখ। অর্থাৎ এটা খুব একটা বেশি নয়। ইন্টারনেটের দাম বাড়ালে এই পেনিট্রেশন আরো কমবে। কেননা, আইআইজি’রা এনটিটিএন এর মাধ্যমে আইএসপির কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়। এতে আইজিদের শতকরা ৩৩ টাকায় সরকারকে দিতে হচ্ছে। দেশ চালানোর জন্য ইন্টারনেটের গলা টিপে ধরা ঠিক হবে না। এটা করা হলে তার ফল ভালো হবে না।

গোলটেবিল আলোচনায় আরো বক্তব্য রাখেন- বাংলালিংকের চিফ রেগুলেটরি অফিসার তাইমুর রহমান, রাষ্ট্র চিন্তার সদস্য দিদারুল ভূঁইয়া প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে বক্তারা আরো বলেন, ইন্টারনেটের দাম কমানোর ক্ষেত্রে কর ছাড়াও আরও একটি বড় বাধা সরকারি পৃষপোষকতায় এনটিটিএন লাইসেন্সধারী দুইটি কোম্পানির চাঁদাবাজি। এনটিটিএন-এর মনোপলি ব্যবসার জন্য গ্রামেগঞ্জে ইন্টারনেট ডাটা ট্রান্সমিশন কম খরচে করা যাচ্ছে না। এ সময় অবিলম্বে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও টেলিকম কোম্পানিগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাহক পর্যায়ে দাম কমাতে নিজেরা যাতে সারা দেশে ট্রান্সমিশন করতে পারে সেই অনুমোদন বিটিআরসিকে দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
image

আপনার মতামত দিন