ঢাকায় সেমিনারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এক্সিসেবল ডিজিটাল সেবা নিশ্চিতে জোরালো আহ্বান

প্রকাশ: বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png নিজস্ব প্রতিবেদক
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বাংলাদেশের দ্রুত সম্প্রসারিত ডিজিটাল সেবাসমূহকে সম্পূর্ণ প্রবেশযোগ্য করতে সুস্পষ্ট ও সময়বদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে। বক্তারা বলেন, দেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রা তখনই অর্থবহ ও পরিপূর্ণ হবে, যখন সব নাগরিক বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিরাপদ, স্বচ্ছন্দ ও স্বাধীনভাবে সরকারি ই-সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এ লক্ষ্য অর্জনে সাশ্রয়ী ইন্টারনেট সুবিধা, সরকারি ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপের নিয়মিত প্রবেশযোগ্যতা মূল্যায়ন, এবং বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগকে তারা অত্যাবশ্যক বলে উল্লেখ করেন।

“ইনোভেশন টু ইনক্লুশন ইন দ্য ডিজিটাল এইজ” শীর্ষক সেমিনারটি আগারগাঁওয়ের বিডা অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজন করে এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ। ১৫০ জনের অধিক অংশগ্রহণকারী এ সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন; তাদের মধ্যে ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ, এটুআই, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, সমাজসেবা অধিদফতর, বিভিন্ন জাতিসংঘ সংস্থা, উন্নয়ন অংশীদার, মোবাইল অপারেটর, ব্যাংক, ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, অনলাইন লার্নিং প্লাটফর্ম, সিভিল সোসাইটি, ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের প্রতিনিধি।

সেমিনারে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী, সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান খান, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ, এটুআই এর প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোহা: আব্দুর রফিক, প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট লিড আব্দুল্লাহ আল ফাহিম, ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্ট ম্যানেজার মাহা আবু এমায়ের, হেড অব ইনোভেশন ক্লাস্টার মো. নাহিদ আলম, কনসালট্যান্ট (অ্যাক্সেসিবিলিটি) ভাস্কর ভট্টাচার্য, ইউএনডিপি বাংলাদেশের অ্যাসিস্টেন্ট রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ আনোয়ারুল হক এবং ডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন অফিসার মো. নাজমুস সাকিব।

অনুষ্ঠানে এটুআই ও ইউএনডিপি বাংলাদেশ যৌথভাবে “ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণ: বাংলাদেশের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশযোগ্যতা উন্নয়ন” শীর্ষক নতুন এক গবেষণা ও পলিসি ব্রিফ উপস্থাপন করে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের বিস্তৃত ডিজিটাল রূপান্তর উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে এক হাজারের বেশি ই-সেবা চালু হয়েছে এবং প্রায় ৩৩ হাজার সরকারি ওয়েবসাইটকে সমন্বিত প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাস্তবে বহু প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এসব সেবা ব্যবহার করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেকের জন্য সেবা এখনো কার্যত অপ্রবেশযোগ্য রয়ে গেছে।

গবেষণাটি উপস্থাপন করেন ভাস্কর ভট্টাচার্য। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে পরিচালিত ডেস্ক রিভিউ, সার্ভে, ফোকাস গ্রুপ আলোচনা, কর্মশালা ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষণায় বেশ কিছু পুনরাবৃত্ত চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সহায়ক প্রযুক্তি ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেটের সীমিত প্রাপ্যতা, ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি, নিরাপদ অনলাইন পরিবেশের অভাব এবং ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ উন্নয়নে যথাযথ অ্যাক্সেসিবিলিটি ফিচার অন্তর্ভুক্ত না করা। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, প্রতিবন্ধী নারীরা অনলাইন হয়রানির বিশেষ ঝুঁকির মুখে থাকেন এবং তুলনামূলক কম মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারী হওয়ায় তাদের ডিজিটাল সেবায় প্রবেশাধিকার আরও সংকুচিত হয়।

আলোচনায় বাস্তব অভিজ্ঞতার উদাহরণও শেয়ার করা হয়। যেমন, এক প্রতিবন্ধী নারী জানান, তার ছবি বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে গুরুতর অনলাইন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আরেক অংশগ্রহণকারী বলেন, প্রতিবন্ধী ভাতার আবেদন এখন অনলাইনে করা গেলেও শেষ পর্যন্ত ফরম প্রিন্ট করে হাতে হাতে জমা দিতে হয়, যা ডিজিটালাইজেশনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অতিরিক্ত সময় ও ব্যয়ের চাপ তৈরি করে। এসব উদাহরণ তুলে ধরে উপস্থাপকরা বলেন, নকশা ও বাস্তবায়নের ফাঁকফোকর অনেক সময় সম্ভাবনাময় ডিজিটাল সংস্কারকেও বঞ্চিত মানুষের জন্য নতুন বোঝায় পরিণত করে।

আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, প্রবেশযোগ্যতাকে সেবা ডিজাইনের প্রারম্ভিক স্তর থেকেই বাধ্যতামূলক উপাদান হিসেবে যুক্ত করতে হবে। সরকার সারা দেশে দ্রুতগতিতে ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ করছে; এখন অগ্রাধিকার হওয়া উচিত প্রতিটি নতুন সেবাকে সূচনা থেকেই প্রবেশযোগ্য করে তৈরি করা।

সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান খান বলেন, প্রবেশযোগ্যতা মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত কারণ যারা সহজ একটি অনলাইন কাজও প্রবেশযোগ্যতার জন্য নিজেরা সম্পন্ন করতে পারেন না, তারা প্রায়ই নিজেদের জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত মনে করেন।

এটুআই-এর প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোহা: আব্দুর রফিক সমাপনী বক্তব্যে বলেন, একক কোনো প্রতিষ্ঠান একা ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে পারবে না। বাস্তবভিত্তিক ও ন্যায্য সমাধান তখনই আসে, যখন নীতিনির্ধারক, প্রযুক্তিবিদ ও প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মীরা একসঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করেন।

বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, প্রতিবন্ধিতা-সংক্রান্ত সেবা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে বিচ্ছিন্ন কাঠামোর মধ্যে না রেখে সমন্বিতভাবে পরিচালনা করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা কোনো প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল রূপান্তরের বাইরে থাকতে পারে না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রতিটি মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট ও ডিজিটাল সেবায় শুরু থেকেই অ্যাক্সেসিবিলিটি নিশ্চিত করা জরুরি।

আব্দুল্লাহ আল ফাহিম বলেন, “প্রবেশযোগ্যতাকে আমাদের জনসেবা প্রদানের মূল শর্ত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। একে বাড়তি সুবিধা হিসেবে দেখলে চলবে না। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, যখন আমরা সেবা নকশায় সবচেয়ে প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের চাহিদাকে কেন্দ্রে রাখি, তখন সেই সেবা সবার জন্যই আরও উন্নত ও কার্যকর হয়। এখন প্রয়োজন বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের বদলে সমন্বিত, সিস্টেমভিত্তিক প্রচেষ্টায় অগ্রসর হওয়া। যেখানে নীতি, নকশা, প্রযুক্তি ও সামনের সারির সেবা

প্রদান একই দিকনির্দেশনায় এগিয়ে যায়। তবেই আমরা নিশ্চিত করতে পারব, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আত্মবিশ্বাস ও স্বাবলম্বিতার সঙ্গে ডিজিটাল সেবা ব্যবহার করতে পারবেন।”

আনোয়ারুল হক বলেন, ডিজিটাল অগ্রগতির প্রকৃত মানদণ্ড হলো কতজন মানুষ বাস্তবে সেবা ব্যবহার করতে পারছে, কেবল কতগুলো প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে তা নয়। তিনি বলেন, “ডিজিটাল অগ্রগতি তখনই অর্থবহ, যখন সবাই তার সুফল ভোগ করতে পারে। অন্তর্ভুক্তিকে কোনো অতিরিক্ত ফিচার হিসেবে দেখা যাবে না বরং আমাদের সব ধরনের ডিজিটাল উদ্যোগের সফলতা মাপার প্রধান মানদণ্ড হওয়া উচিত অন্তর্ভুক্তি।”

সেমিনারে উপস্থাপিত নীতি-প্রস্তাবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য একটি রোডম্যাপ প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথম বছরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সাশ্রয়ী ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু, সব সরকারি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অ্যাক্সেসিবিলিটি অডিট, বিদ্যমান ডিজাইন গাইডলাইনসমূহের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ এবং বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী ও তরুণদের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা ও অধিকারের ওপর প্রশিক্ষণ জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ডেভেলপার ও সেবা প্রদানকারীদের জন্য ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি বিষয়ক বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল স্কিলস ট্রেনিং হাব প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় বছরের মধ্যে সরকারি ভাতা ও ভর্তুকি কার্যক্রমে দূরবর্তী পরিচয় যাচাইকরণ ব্যবস্থা চালু করা, সহজে ব্যবহারযোগ্য ন্যাশনাল ডিজেবিলিটি হেল্পলাইন প্রতিষ্ঠা, ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং আর্থিক সেবার প্রবেশযোগ্যতা বৃদ্ধি, সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ এবং দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়তা জোরদারের সুপারিশ করা হয়েছে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্মত ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি অ্যাক্ট প্রণয়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ওয়েব অ্যাক্সেসিবিলিটি মনিটরিং অথরিটি গঠন, মুক্তপাঠ ও নাইসসহ গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মসমূহে পূর্ণ প্রবেশযোগ্যতা নিশ্চিত করা এবং সব ধরনের সরকারি তথ্য জরুরি বার্তাসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রবেশযোগ্য করে তোলার প্রস্তাব রয়েছে।

বক্তা ও অংশগ্রহণকারীরা মত দেন, প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ এমন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল পরিবেশের দিকে এগোবে, যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সরকারি সেবা ও নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে সমান মর্যাদা নিয়ে, পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন।

image

আপনার মতামত দিন