২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে আইসিটি ও টেলিকম সেক্টরের জন্য তেমন সুখবর নেই বলে মত দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। বাজেটে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে উৎসে কর ৫ শতাংশ করা, মুঠোফোন উৎপাদন ও সংযোজনে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) অব্যাহতি সুবিধা কিছুটা কমানো, অনলাইন স্ট্রিমিং ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব বিষয়ে কোন সুখবর দেখছেন না খাত সংশ্লিষ্টরা।
সোমবার (২ জুন) বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে জাতির সামনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের বক্তব্য শুরু করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সংসদ না থাকায় এবারের ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়েছে। এটি দেশের ৫৪তম বাজেট এবং অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট।
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে উৎসে কর ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিপরীতে অনলাইন স্ট্রিমিং ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দেশের ইন্টারনেট সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম টেকভয়েস২৪কে বলেন, ‘‘বাজেটে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে উৎসে কর ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ইকুপমেন্টের উপর যে টেক্স, ভ্যাট করারোপ করেছে, সে বিষয়ে এখনও সঠিক তথ্য পাইনি। উৎসে কর যদি ৫ শতাংশ করা হয়, তাহলে যারা কর্পোরেট লেভেলে ব্যবসা করে তারা কিছুটা সুফল পেতে পারে। তবে ছোট, মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বাজেটে তেমন কিছুই নাই। অন্যদিকে প্রান্তিক পর্যায় গ্রাহকদের জন্য তেমন কোন সুখবর নেই।’’
তিনি বলেন, ‘‘সরকার ইন্টারনেটের দাম কমাতে চায়। কিন্তু ভ্যাট, ট্যাক্সে হাত দেবে না, ইকুইপমেন্টের মধ্যে হাত দেবে না। ফলে কোনও লাভ হবে না। ভ্যাট, ট্যাক্সে হাত না দিলে ইন্টারনেটের দাম কমবে না।’
প্রস্তাবিত বাজেটে ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্ম পরিষেবাগুলোতে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে ওটিটি ব্যবহারকারীদের পরিষেবা ব্যয় বাড়ছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘‘ওটিটি বা ওভার দ্যা টপ প্ল্যাটফর্ম সেবার সংজ্ঞা প্রদানপূর্বক এর উপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।’’
ওটিটি’র ওপর শুল্ক আরোপের প্রস্তাব বিষয়ে আইএসপিএবি সভাপতি বলেন, ‘‘আমাদের দেশীয় ওটিটি ইন্ডাস্ট্রিটা খুব বেশি বিকশিত হয়নি। এটি মাত্র শুরু হয়েছে। আমি মনে করি, অনলাইন স্ট্রিমিং ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলে এটি বিকাশে বাধা হিসাবে কাজ করবে। কেননা, দেশীয় ওটিটি প্লাটফর্ম যেমন, বঙ্গ, চরকি এরা বিদেশি প্লাটফর্মের তুলনায় খুব একটা ভাল করতে পারছে না। বিদেশি ওটিটি প্লাটফর্ম যেমন, জি ফাইভ, সনিলিভ, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই দর্শকদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। তাই, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলে এটা বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মেরই প্রমোট করা হবে। যারা চরকি দেখছে তাদের ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হবে। আবার যারা সনিলিভ দেখছেন তাদের সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ পড়ছে না। আমি মনে করি, দেশীয় ওটিটি ইন্ডাস্ট্রির বিকাশের জন্য শুরুতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত যেসব ওটিটি প্লাটফর্ম রয়েছে সেগুলোকে শুল্ক মুক্ত হওয়া উচিত।’’
অনলাইনে পণ্য বিক্রির কমিশনের ওপর ভ্যাট তিনগুণ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ প্রসঙ্গে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিল-এর প্রধান নির্বাহী পরিচালক ও বেসিস সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর টেকভয়েস২৪কে বলেন, ‘‘অনলাইন সেলস কমিশনের ওপর এই ভ্যাট বৃদ্ধি দেশের অনলাইনে কেনাবেচাকে অনেকটা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বড় একটা কেনাবেচা হয় ফেসবুকের মাধ্যমে, সেখানে এটার খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে এর প্রভাব ফেলবে বড় বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোতে। যেমন দারাজ, ফুডপান্ডার মতো কমিশনভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্রের দামে বেশি প্রভাব পড়বে। প্রতিষ্ঠান পরিচালানায় বাড়তি খরচ তারা আসলে ক্রেতাদের কাছ থেকেই আদায় করবে। তাই, দিন শেষে ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাবটা সেই ক্রেতাদের উপরেই বর্তাবে।’’
প্রিয়শপের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও আসিকুল আলম খান বলেন, ‘‘এই প্রস্তাবটি দেশের ই-কমার্স খাতে একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। ভ্যাট ৫% থেকে সরাসরি ১৫% করায় ডেলিভারি খরচ বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। এতে ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমে যাবে এবং ডিজিটাল কমার্সের গতি মন্থর হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো GST রেট ই-কমার্স লজিস্টিকের ক্ষেত্রে সহনীয় রাখা হয়েছে যাতে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ত্বরান্বিত হয়।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি, দেশের ডিজিটাল ইকোনমি ও ফিনটেক খাতের বিকাশে এমন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। একটি ইনক্লুসিভ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে অনলাইন খাতকে সাপোর্ট দেওয়া জরুরি।’’
এছাড়াও প্রস্তাবিত বাজেটে মুঠোফোন উৎপাদন ও সংযোজনে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) অব্যাহতি সুবিধা কিছুটা কমানো হয়েছে। এছাড়াও বাজেটে অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কমানোয় বাড়তে পারে মুঠোফোনের দাম।
বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘‘বাজেটে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কিছুটা কমানো হয়েছে। আর সুবিধাটি কমিয়ে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই সুবিধা কমানো হয়েছে। তবে কতটুকু কমানো হয়েছে, তা এখনও জানানো হয়নি।’’
এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে শাওমি বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘‘ উৎপাদন পর্যায়ে মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারকদের লাভের পরিমাণ কিছুটা কমে যেতে পারে। তবে সেটাও খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভোক্তা পর্যায়ে এর কোন প্রভাব পড়বে না। বেশিরভাগ মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক প্রায় ৩০% মূল্য সংযোজন করে এবং ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে এত বেশি ব্যয় হয় না। আমার ধারণা, ব্যবসায়িক পর্যায়ে এর কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে না।’’