বলতেই হয়, আনন্দ উঠান নামটি বেশ আকৃষ্ট করেছে দর্শনার্থী ও ক্রেতাদেরকে। তাই তো শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১১ টায় মেলা শুরু হতে না হতেই বহুদিন ধরে গুমোট সময়ের কবলে পড়া মানুষ এখানে ভীড় জমিয়েছেন আনন্দের প্রত্যাশায়।
মেলার দ্বিতীয় দিন শনিবারেও একই চিত্র দেখা গেল মাইডাসে সেন্টারের ১২ তলায় পা রাখতেই। এই আনন্দ সবার সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ, একই ছাদের নিচে বন্ধু-পরিজন নিয়ে বা একাই কেনাকাটা করার আনন্দ আর একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর আনন্দ। আনন্দ আসলে এক বড় শক্তি। সেটাই প্রমাণ করলেন আমাদের বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।
এ কথা সবারই জানা যে সময়টা ভীষণ প্রতিকূল যাচ্ছে। এর মাঝে জীবন ও জীবিকার চাকা সচল রাখতে আর দেশ গড়তে এ দেশেরই পণ্য নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলা এক দল উদ্যমী ও প্রত্যয়ী উদ্যোক্তা 'আনন্দ উঠান' নামের বাৎসরিক আয়োজনের ব্যানারে একত্রিত হয়েছেন।
এই আনন্দ আয়োজনের আয়োজক ছিল সুপরিচিত ফ্যাশন উদ্যোগ পটের বিবি। ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ধানমন্ডি ২৭-এর মাইডাস সেন্টারে চলেছে এই মেলা।
এখানে বৈচিত্র্যময় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে ৩২ টি উদ্যোগ। এক ছাদের নিচে এসেই সকলে পেয়েছেন বৈচিত্র্যময় সব পোশাক, গয়না, ব্যাগ, ঘর সাজানোর সামগ্রী, ধূপসহ অ্যারোমাটিক সব পণ্য, সৌন্দর্য সামগ্রী আর মজার মজার খাবার।
পরিবারের সবাই বা বন্ধুরা মিলে ছুটির দিন দুটিতে দারুণ সময় কাটাতে দেখা গেছে অনেককেই। আর সেই সঙ্গে চালু ছিল কেনাকাটার ধুম। চলুন এক নজরে দেখে নিই এবারের আনন্দ উঠানের বিশেষ আকর্ষণগুলো, যা সকলকে বেশি আকৃষ্ট করেছে।
পূজার থিমের পোশাক ও গয়না
এবার দুর্গাপূজায় অনেক ফ্যাশন উদ্যোক্তা বিশেষ ডিজাইনের শাড়ি ও গয়না এনেছেন। দিশা'স রোড ব্লকের পূজা থিমের ডিজিটাল প্রিন্টের শাড়ি ও কুর্তি বেশ নজর কেড়েছে। লাল ও সাদা রঙে পুরোপুরি পূজার আমেজ দিচ্ছে এটি।
বিজেন্স-এর লালপেড়ে সোনালি অ্যাকুয়া সিল্কের পূজার শাড়ির প্রতি অনেকের আগ্রহ দেখা গেল। ছিল তেরো পার্বণের প্রিয় সঞ্চারী শাড়ি।খয়েরি,মেরুন, লালের শেডে ডাই করা অফ হোয়াইট সুতির শাড়িটি পূজার জন্যই আনা।
দেশী বুননের জামদানিসহ তাঁতের শাড়িগুলো নজর কেড়েছে। পূজা আসলে এই শাড়িগুলোর কদর বাড়ে এমনিতেই। ক্যানভাসের গয়নাগুলো যেকোনো উৎসবের আমেজ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো।
সেই সঙ্গে পূজার থিমে লালের ছোঁয়ায় গয়না এনেছে বিজেন্স। মল্লিকার পলা আর চন্দন কাঠের বিডসের গয়নাগুলোও কিন্তু পূজার ভাইব দিচ্ছে। একই কথা বলা যাচ্ছে আট কুঠুরি নয় দরজার ট্র্যাডিশনাল গয়নাগুলোকে নিয়ে।
ডিক্লাটার কর্নার
আনন্দ উঠানে এবার ব্যতিক্রমী ডিক্লাটার কর্নার নিয়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে আগ্রহ একেবারে তুঙ্গে দেখা গেছে। সচরাচর আসলে দেখা যায় না এমন আয়োজন এসব মেলায়। অনেকেই নিজেদের বাছা বাছা শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক নিয়ে এসেছেন স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করার জন্য। পছন্দের পণ্য কম দামে পেয়ে ক্রেতারাও খুশি।
বৈচিত্র্যময় পোশাকের সম্ভার
দিশা'স রোড ব্লক এনেছে দারুণ সব মজার ব্লক আর ডিজিটাল প্রিন্টের শাড়ি, কুর্তি। পটের বিবির রয়েল বেঙ্গল টাইগার, পাতা, বেড়াল, পাখি ব্লক আর রাধা শাড়িসহ নিজেদের ডিজাইনের সিগনেচার হাতে বোনা তাঁতের শাড়িগুলো বরাবরের মতোই ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
একই কথা বলা যায় খুঁত-এর শাড়ি, ব্লাউজ, কুর্তি নিয়ে। গথিয়ার শাড়ি ও শার্টের প্রতি সকলের আগ্রহ ছিল। তানি'স বাংলাদেশে ছিল ন্যাচারাল ও অ্যাজো ফ্রি ডাই করা পোশাক, যা বেশ সাড়া জাগিয়েছে।
এদিকে রংধনু ক্রিয়েশনসের হ্যান্ড পেইন্টের সিগনেচার শাড়িগুলো নজর কেড়েছে বেশ। সম্পূর্ণা, তেরো পার্বন, সুতলি আর দিশাস রোড ব্লকের ব্লাউজের জন্য ভীড় করেছেন অনেকে। আর্টেমিসের স্কার্টগুলো সবার চোখে পড়েছে। সুতলির সিগনেচার পোশাকগুলোর জন্য তো আগ্রহ থাকেই সবার। পোশাক বাই তাননাস, শখের ডিব্বা আর অন্দরের সুন্দর সব শাড়িগুলো দেখতে ও কিনতে দেখা গেছে ক্রেতাদের। শাড়ি কথনের পাট আর ডেনিমের বর্ডারের শাড়িগুলোও খুব নজরকাড়া।
গয়নার ব্যতিক্রমী আয়োজন
আমাদের দেশে এখন গয়নার উদ্যোগগুলোর সৃজনশীলতা প্রশংসার দাবী রাখে। আর সেই সঙ্গে দেশের ফ্যাশনিস্তারা টিপিকাল গয়নার বদলে একটু নতুন কিছু পছন্দ করেন বেশি। সেদিক থেকে আনন্দ উঠান একেবারেই নিরাশ করেনি ক্রেতাদেরকে।
বাঙুরির বুনন আর মিক্সড মিডিয়ামের নিরীক্ষাধর্মী সব গয়না ছিল এখানে। ঋ এর বীজের সঙ্গে অন্যান্য উপকরণের ফিউশনে তৈরি গয়নাও নজর কেড়েছে। নয়া ছিল তাদের সিগনেচার ক্লে আর পেইন্ট করা নান্দনিক সব গয়না নিয়ে।
মিথ আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটসের ফেব্রিক, পাট আর এমব্রয়ডারির গয়না ও ওয়ালপিস কিনেছেন অনেকেই। দয়ীতার সিগনেচার পুঁতির বর্ণিল গয়না আর জামদানি ও হাতের কাজের স্টেটমেন্ট পিসের প্রতি সবার আগ্রহ দেখা গেছে। রংধনু ক্রিয়েশনসও ছিল হ্যান্ডপেইন্ট করা ও পুঁতির গয়না নিয়ে। পৌরাণিকের ব্যতিক্রমী জুট আর পার্লের গয়নাগুলোও বেশ নজর কেড়েছে।
অনুষঙ্গ ও অন্যান্য
কালিন্দীর ছোট ও বড় চামড়ার ব্যাগ ও টোটব্যাগ বিক্রি হয়েছে হটকেকের মতো। সবসময় ভীড় দেখা গেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপণ্য নিয়ে দীঘল আর অর্গ্যানিক খাবারের উদ্যোগ আঁচারির সামনে। এই দুটি উদ্যোগই একজনের। পূজার সামগ্রী সাজানোর অনুষঙ্গ ও তৈজস আর সেই সঙ্গে ধূপসহ অন্যান্য সুগন্ধী সামগ্রীর পসরা নিয়ে নজর কেড়েছে বোকা বাক্স।
আরুণিকার সম্ভারে ছিল অনেক কিছু। হোম ডেকোর, গয়না এমনকি ব্যতিক্রমী লুডু বোর্ডও দেখা গেছে এই স্টলে। হোম ডেকোর আর অনুষঙ্গের উদ্যোগ মিন্ডালা ডট কমের সানগ্লাসে রিকশা পেইন্ট দেখা গেল। হাতে আঁকা হারিকেনও আছে তাদের। মাইডাস সেন্টার দুটি হলের মেলার স্টলের মাঝের লবিতে ছিল সুন্দর আড্ডার জায়গা।
জিবে জল আনা খাবারদাবার
চিয়ারি শেফের বেকড খাবারের জন্য ভীড় লেগে ছিল সবসময়। জাপানিজ কটন চিজকেক, প্যাটিস, ব্যানানা ব্রেড, জিলাপি, গোলাপজাম, চাওমিন, চিকেনের স্টাফিং দেওয়া পিঠা পকেটের স্বাদ নিয়েছেন সবাই। এদিকে এন'স কিচেনের তেহারি, খিচুড়ি, মোমো, ফলের জুস আর চা ছিল সকলের পছন্দের শীর্ষে।
এমন আনন্দঘন পরিবেশে এক ছাদের তলায় কেনাকাটা করতে আর দেশি পণ্যের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি দেখা গেছে দর্শনার্থীদের এই আনন্দ উঠানের আয়োজনে। এসেছেন এখানে অংশ নেওয়া উদ্যোক্তারা বাদে অন্যান্য বন্ধু উদ্যোক্তারা।
অনেকেই জানিয়েছেন, কেবল অনলাইনে যোগাযোগ হয় বলে শুধু উদ্যোক্তাদের সঙ্গে দেখা করতেই দূর থেকে এসেছেন অনেকে। আর বিভিন্ন স্টল ঘুরে কথা বলে জানা গেল, কেনাবেচা ভালোই হয়েছে এবারে। বেশ দোলাচল ছিল মেলা নিয়ে সকলের মনে। তবে সব আশংকা ভেসে গেছে বৃষ্টি আর চলমান অস্থির সময় থাকা স্বত্বেও এভাবে দলে দলে সবার উপস্থিতিতে।
বহুদিন পরে এমন একটি সফল আয়োজন আমাদের দেশের অনলাইন ইন্ডাস্ট্রি তথা সমগ্র ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য স্বস্তির সুবাতাস নিয়ে এসেছে, বলাই যায়। আয়োজন পটের বিবির কর্ণধার ফোয়ারা ফেরদৌসের বয়ানেও সেই স্বস্তির সুর শোনা গেল।
তিনি বলেন, শুধু কেনাবেচা নয়, উদ্যোক্তা বন্ধুদেরকে চলমান সব ধরনের নেতিবাচকতা থেকে টেনে তোলার ব্যাপারটি তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এবারের আনন্দ উঠানের আয়োজনে। আর সেই সঙ্গে মেলার ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়েও তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।
মেলায় অংশগ্রহণকারী পোশাকের উদ্যোগ দিশা'স রোড ব্লকের স্বত্বাধিকারী সায়কা শাহরিন দিশা বললেন, অনেক ঝুঁকি নিয়ে এবার অনলাইন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছেন আর নিজেদের পসরা সাজিয়েছেন। আর মেলায় আশাতীত সাড়া পেয়েছেন তাঁরা। একই রকম প্রতিক্রিয়া মিলল রংধনু ক্রিয়েশনসের শাহনাজ সুলতানা, তানি'স বাংলাদেশের তানিয়া নাজনিন আর আর্টেমিসের ফায়জা আহমেদের সঙ্গে কথা বলে।
মিথ আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটসের বেচাকেনা বেশ ভালো বলে জানা গেল। এদিকে দয়ীতার কর্ণধার সৈয়দা সুলতানা মিলি জানালেন, তিনি যা ভেবেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি দর্শনার্থী হয়েছে আর সেই সঙ্গে বিক্রিও।
কালিন্দীর কর্ণধার মুনিয়া জামানের বয়ানে, 'এমন একটি মেলা আসলে খুব দরকার ছিল এখন। আর এতে প্রমাণ হয়েছে, মানসম্পন্ন দেশি পণ্য সুন্দর পরিবেশনার মাধ্যমে ক্রেতাদের সামনে আনতে পারলে তাঁরা ঠিকই কিনবেন তা'। সামনেই শারদীয় দুর্গাপূজা। সেজন্যও অনেকে কেনাকাটা করেছেন এবারের আনন্দ উঠানে। আমাদের নিজেদের পণ্যেই আমাদের উৎসব হোক, এটাই সকলের চাওয়া।