দেশে গার্মেন্টের পর সম্ভাবনাময় খাত বিপিও: আহমাদুল হক ববি

প্রকাশ: শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১৮
Image উজ্জ্বল এ গমেজ
news-banner
  ছবি: সংগৃহীত
২০০৮ সাল থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশে যে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) সেক্টরের সূচনা হয়েছিল তা এরইমধ্যে একটি সম্মানের জায়গা তৈরি করতে পেরেছে। আইসিটিতে বর্তমানে বাংলাদেশের যে পরিবর্তনের গল্প, তার উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে এই খাতের। সরকার আইসিটি সেক্টর থেকে ২০২১ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, আশা করা যায় তার সিংহভাগ অংশই আসবে বিপিও থেকে।

সম্ভাবনাময় এ খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) প্রেসিডেন্ট আহমাদুল হক ববি। তাঁর সাথে একান্ত আলাপের কিছু চুম্বক অংশ টেকভয়েস২৪-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। 

টেকভয়েস২৪: বাংলাদেশে কি আউটসোর্সিংয়ের মানসম্মত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে?
আহমাদুল হক ববি : কল সেন্টার এবং ডাটা এন্ট্রি কাজের মধ্য দিয়ে দেশে বিপিও ধারণাটির যাত্রা শুরু। প্রথমে ছোট আকারে শুরু হলেও সময়ের পরিক্রমায় এখন এটি বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটির পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে। আরেকটা বড় বিষয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে বিপিওর অন্যতম সফল দেশ ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি। তাদের সফলতার দৃষ্টান্তও আমাদের অনেক উদ্যোক্তাকে অনুপ্রাণিত করছে।

বাংলাদেশের বিপিও খাত এখন একটা সম্ভাবনাময় শিল্প। আন্তর্জাতিকভাবে বিপিও বা আইটিওতে বাংলাদেশের স্থান ২৬তম। সম্প্রতি দ্বিতীয় ফাইবার অপটিক্স সংযোগের জন্য স্বাক্ষরিত চুক্তিটি দেশের উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরিতে এবং উচ্চ মানসম্পন্ন বিপিও কাজের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। বিপিওশিল্প ইতোমধ্যেই ৩০ হাজারের বেশি তরুণদের জন্য মধ্যম আয়ের টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।

আশার কথা হলো, বিপিওশিল্পের উন্নয়নে সরকারের নীতিমালার সংস্কার করছে। যেমন, ২০২৪ সাল পর্যন্ত আইটিইএস কোম্পানির জন্য অফিস ভাড়ায় ভ্যাট ও ট্যাক্স দিতে হবে না। সারাদেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক তৈরি করছে, সরকারি অর্থায়নে বিভিন্ন ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

টেকভয়েস২৪: শুরুতে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কলসেন্টার লাইসেন্স নিয়েছিল। সম্প্রতি ১৫৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হলো কেন?
আহমাদুল হক ববি : বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাব অনুযায়ী দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত কল সেন্টারের সংখ্যা ২০৩টি। ২০০৮ সালে কল সেন্টারের লাইসেন্স নেয়ার সময় শর্ত হিসেবে বলা ছিল কেউ আপারেশনে না গেলে তার লাইসেন্স বাতিল করা হবে। লাইসেন্স নিয়েও বিভিন্ন করণে দেশের এক-তৃতীয়াংশ কল সেন্টার কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। শুরুতে লাইসেন্স কম দামে পাওয়ায় অনেকে না বুঝেই লাইসেন্স নিয়ে রেখেছিল।

গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর ১৬০টি কল সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন করার জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কমিশন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কল সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন না করায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি ১৫৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে বিটিআরসি।

টেকভয়েস২৪:  বাংলাদেশে আউটসোর্সিংয়ের ভবিষ্যত কেমন?
আহমাদুল হক ববি : বাংলাদেশের বিপিও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বছরে শতকরা ১০০ ভাগের বেশি। এদিক থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে, বিপিও খাতে একটা বিশাল বাজার পড়ে আছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিপিওর বাজার ৫০০ বিলিয়ন ডলার। সেখানে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ দখল করতে পেরেছে মাত্র ১৮০ মিলিয়ন ডলার। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২ মিলিয়ন ছেলেমেয়ে এ খাতে কাজ করে আয় করেছে ৮০ বিলিয়ন ডলার। 

ফিলিপিন্স ২০০৯ সালে ২ বিলিয়ন আয় করতো আর এখন করে ১৮ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলংঙ্কায় শুধু এসএসিএ গ্রাজুয়েটই আছে ৫০ হাজার। শ্রীলংঙ্কা ২ বিলিয়ন ডলার শুধু ফাইন্যান্স এবং ব্যাক অফিসের কাজ করে আয় করে। আমাদের জনগোষ্ঠির প্রায় ৬০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের নিচে, এই জনগোষ্ঠি একটা বড় রিসোর্স। এখন যদি বাংলাদেশ এই খাতে নজর দেয় তাহলে তৈরি পোশাক শিল্পের পরই বিপিও হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত।

বিপিও সেক্টরে আগামী ৭-১০ বছরের মধ্যে আড়াই লাখ তরুণ-তরুণীর জন্য মধ্যম আয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। আগামী ২০২১ সাল নাগাদ আমরা প্রায় এক লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়ার পরিকল্পনা করছি।

টেকভয়েস২৪:  বিপিও খাতে এখন কি ধরনের সমস্যা আছে?
আহমাদুল হক ববি : বিপিও খাতে বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও রয়েছে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। এ সেক্টরে কাজ করার জন্য আমরা যে সকল তরুণ-তরুণীকে পাচ্ছি, তাদের শিক্ষাগত অনেক অসম্পূর্ণতা আছে। অনেক শিক্ষার্থীই ভালো করে কথা বলতে পারে না, কেউবা আবার কম্পিউটারে দক্ষ না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে তা এ সেক্টরের উপযোগী না। দক্ষতা অর্জনের দিকে তরুণদের নজর দিতে হবে। আউটসোর্সিংয়ে ভালো করতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষতা বাড়াতে হবে।

বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ গভর্নেন্স (এলআইসটি) প্রকল্পের ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের আওতায় সরকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও এডিবির অর্থায়ানে বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের আয়োজন করছে। আমরা এসব দক্ষ মানুষকে নিয়ে কাজ শুরু করেছি। সরকারের এলআইসিটি প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরাও আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছে।

টেকভয়েস২৪:  বিপিও খাতে কাজের ক্ষেত্রগুলো কি কি?
আহমাদুল হক ববি : বিপিও খাতের পরিধি বিশাল, কাজেই একটা-দুটো কাজের কথা বলা কঠিন। ডমেস্টিক মার্কেটে আমরা সবচেয়ে বেশি কাজ করছি টেলকো সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। এছাড়াও ব্যাংকিং, ইনসুরেন্স, হাসপাতাল, পাবলিশিং, হোটেলের বিভিন্ন ব্যাক অফিস সেবা দিচ্ছি। সবারই কমবেশি ব্যাক অফিস সেবার প্রয়োজন হয়। যদিও আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এ জন্য অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করে। আর এর ফলে তাদের খরচ অনেক বেড়ে যায়।

বিপিওতে মোবাইল ডিভাইসকে কেন্দ্র করে আরেকটি বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংক ও বড় কোম্পানিগুলো মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা দেয়া শুরু করেছে। এসব কাজে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে, যা বিপিওর মাধ্যমে জোগান দেয়া যেতে পারে। এছাড়া বিগ ডাটা অ্যানালাইসিস, সিটি থ্রিডি মডেলিংসহ জিও লোকেশনভিত্তিক নানা কাজে বিপিওর প্রচুর সম্ভাবনা আছে। আমরা যদি সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনার আওতায় এ নিয়ে কাজ করতে পারি তাহলে অল্প কয়েকদিনে বাংলাদেশকে বিপিওর বিশ্ববাজারে আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

টেকভয়েস২৪:  বিপিও খাতে আউটসোর্সিং বিকাশে আপনার পরামর্শ কি?
আহমাদুল হক ববি : বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার ১১ কোটির বেশি তরুণ (অনূর্ধ্ব-৩৫)। মোট জনসংখ্যার হিসাবে এ সংখ্যা ৬৫ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশের একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, আমাদের এই বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু কোথাও সুযোগ করে উঠতে পারছে না। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, এসব উজ্জ্বল তরুণের জন্য সঠিক কাজের সুযোগ করে দেয়া। এ জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ অনেক সৃজনশীল কাজ করে চলেছে। পাশাপাশি বিটিআরসিও এই সেক্টরের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে আসছে। এর পাশাপাশি দরকার বেসরকারি উদ্যোগ। এখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত, তরুণ প্রজন্মের কাছে বিপিওকে আরো জনপ্রিয় করা। ফিলিপাইনের মতো দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকেও বিপিওবান্ধব করতে হবে। বিভিন্ন সামিট আয়োজনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের প্রযুক্তি খাতকে প্রচার করতে হবে।

image

আপনার মতামত দিন