মো. ইকরাম। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ে হাতে খড়ি ২০০৪ সালে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয় নিয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরে শুধু চাকরির আশায় না ঘুরে নিজের উদ্যোগে কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে ঘরে বসে শুরু করেছিলেন অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার। বাংলাদেশের তিনটি সেরা আইটি ব্লগের মধ্যে জেনেসিসব্লগস.কমের প্রতিষ্ঠাতা। একজন সফল আইটি ব্লগার এবং ফ্রিল্যান্সার।বর্তমানে তিনি নেক্সাস আইটি ইনস্টিটিউটের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও কয়েকটি অনলাইন নিউজপোর্টালের এসইও কনসালটেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন।
টেকভয়েস২৪-এর সঙ্গে একান্ত আলাপে কথা বলেছেন নেক্সাস আইটি ইনস্টিটিউটের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট মো. ইকরাম। আলাপে উঠে আসে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরের নানান বিষয়।
টেকভয়েস২৪ : ফ্রিল্যান্সিং কী ক্যারিয়ার না পেশা?
মো. ইকরাম : ফ্রিল্যান্সিংকে আমি ক্যারিয়ার হিসেবেই দেখতে পছন্দ করি। আর সেভাবে দেখতে পারলেই সবাই আরো বেশি ভাল করতে পারবে। এদেশের জন্যও সেটা অনেক বেশি মঙ্গল হবে। দৃষ্টিভঙ্গিটাই মানুষের সফলতা এবং ব্যর্থতার নির্ণায়ক। ক্যারিয়ার হিসেবে আমি দেখছি দেখেই প্রতি নিয়ত প্রচুর পড়াশোনা করছি। আরো শেখার আগ্রহটার জন্ম হয়েছে এ দৃষ্টিভঙ্গিটার কারণে।
টেকভয়েস২৪: আমাদের দেশে ফ্রিল্যান্সিংকে এখনো পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না কেন?
মো. ইকরাম: আমাদের দেশে ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসেবে পরিবার কিংবা সমাজ স্বীকৃতি দেওয়ার আগের স্টেজ হচ্ছে যারা ফ্রিল্যান্সিং করছে, তাদেরই ফ্রিল্যান্সিং বিষয়টার পরিব্যাপ্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়নি। এখনও যদি মার্কেটপ্লেসের বায়ারদেরকেই বাহিরের কাজ পাওয়ার একমাত্র উপায় মনে করেন, তাহলে বলতে হবে, এখনও ফ্র্রিল্যান্সিং কি, সেটা সম্পর্কে ধারণাই তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে অনেকেই আছে ৪-৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ফ্রিল্যান্সার হিসেবে চাকরি করছেন এবং মাস শেষে বেতন নিচ্ছেন। তারা এ চাকরিটা পেতে কিন্তু মার্কেটপ্লেসের দ্বারস্থ হননি।
জব সাইট কিংবা কোন ফোরাম কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর সহযোগীতাতে সেসব জায়গাতে সিভি জমা দিয়েছেন, ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। সেই ছেলেটি যে মাস শেষে নিশ্চিতভাবে স্যালারি পাচ্ছেন, ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সেই পরিবারের কোন সমস্যা নাই। আমরা কাজ খোঁজার গণ্ডিটাকে অনেক ছোট করে ফেলেছি। সেজন্য সব সময় হাতে কাজ থাকছে না। তখন হয়ত বেকার থাকতে হচ্ছে। তাই সামাজিকভাবে এটাকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই।
টেকভয়েস২৪ : উন্নত বিশ্বে ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন?
মো. ইকরাম : মার্কেটপ্লেসের হিসেব অনুযায়ি আমরা একটু তৃপ্তির ঢেকুর তুলি হয়তো। মার্কেটপ্লেসের হিসেব অনুযায়ী আমরা সারাবিশ্বে ৩য় নম্বর অবস্থানে রয়েছি। আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগে এটাকে আরও একটু বিস্তারিতভাবে বলতে চাচ্ছি, তাহলে প্রকৃত অবস্থানটা পরিষ্কার হবে। আমাদের এ দেশে ফ্রিল্যান্সিং ধারণাটা এখন খুব বেশি পরিপক্ক অবস্থানে নাই। তাই সবাই বায়ার খোঁজার জন্য শুধুমাত্র মার্কেটপ্লেসনির্ভর দেখেই এখানের পরিসংখ্যান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছে। ইন্ডিয়াসহ আরো অনেকগুলো দেশেই নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই কাজ জোগাড় করছে। তাই সেই সব দেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ে আমাদের চাইতে পিছিয়ে আছে কিনা, সেটা কিন্তু বলতে পারছেন না।
আরেকটা বিষয়যুক্ত করি। এখনও আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সাররা ছোট ছোট কাজগুলোতে কম সময়ে দক্ষ হওয়াটাকেই টার্গেট করছে। তাই মার্কেটপ্লেসে ছোট ছোট কাজগুলোতেই আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের হায়ার করছে। এবং বায়াররাও আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সারদের ছোট কাজগুলোতেই হায়ার করছে। বড় কাজগুলো যে বাংলাদেশে করা সম্ভব, সেটা তাদেরকে বুঝাতেও অনেক কষ্ট হয়ে যায়। তবে এটা বলবো, দিন দিন আমরা উন্নত হচ্ছি। দেশে এ ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু আরো কিছু বিষয়কে স্পেসিফিকভাবে টার্গেট করে আগালে অনেক ভাল অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ আমাদের রয়েছে।
টেকভয়েস২৪: একজন তরুণ ফ্রিল্যান্সিংকে কেন বেছে নেবেন?
মো. ইকরাম : সবচাইতে বড় কথা হলো- যুগের চাহিদা। আপনার যুগের চাহিদা হচ্ছে আপনি যোগাযোগ করছেন মোবাইলে কিংবা স্কাইপের মাধ্যমে। এটাই যোগাযোগের খুব সহজ মাধ্যম। এ সহজ মাধ্যমটা আসার পর প্রশ্ন হবে, চিঠি দিয়ে আপনি কেন যোগাযোগ করবেন। ঠিক একইভাবে, সারাবিশ্বে এত এত জব রয়েছে অনলাইনে। তার জন্য বিদেশ যেতে হচ্ছে না, চাকরির জন্য পরিবারকে ছেড়ে ঢাকাতে পাড়ি জমাতে হচ্ছে না। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এত সুন্দর সুযোগটা তৈরি হওয়ার পরও কেন আপনি বেকার থাকবেন, কেন পরিবারের মায়া ত্যাগ করে দূরে গিয়ে চাকরি করবেন?
খুব স্বল্প সময়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বেকারত্বের অসহায়ত্বের থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, ঘরে বসেই বিদেশে গিয়ে চাকরির সমান ইনকাম করা যায়, অথচ বিদেশের যাওয়ার জন্য যেই খরচ, সেই খরচ ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য করতে হচ্ছে না। অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এ ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। ঘরে পরিবারের সাথে সময় দিয়েই কাজটা করা যায়, কোথাও ঘুরতে গিয়েও কাজ করা যায়। লাইফটাকে অনেক সহজ করে দেয় এ ফ্রিল্যান্সিং। তাই তরুণরা দেশীয় চাকরির পেছনে না ছুটে ফ্রিল্যান্সিংকে টার্গেট করলেই সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে সক্ষম হবেন।
টেকভয়েস২৪ : বর্তমানে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা কত?
মো. ইকরাম : এটার সঠিক সংখ্যা আসলে কেউ এখনও বলতে পারবে না। সরকারী হিসেব মতে বলা হচ্ছে সাড়ে ৬ লাখ। এটা আসল ফিগার না। কারণ এ সংখ্যাটা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে বাংলাদেশীদের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দেখে। অনেকেই রয়েছে অ্যাকাউন্ট খুলছে। তার মধ্যে হয়ত ২৫% কাজ পাচ্ছে। আর নিয়মিত কাজ করছে এ সংখ্যাটা ১৫% এর বেশি হওয়ার কথা না। আবার অনেকে মার্কেটপ্লেসের বাহিরে গিয়ে প্রচুর কাজ করছে, যাদের হিসেবটা কারও কাছে নাই।
টেকভয়েস২৪: একজন ফ্রিল্যান্সারের মাসিক অায় কত হতে পারে?
মো. ইকরাম : এটা আসলে নির্দিষ্ট করে বলাটা খুব কঠিন কাজ। এক্ষেত্রেও আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটাই আপনার ইনকামের বৃদ্ধির কারন হতে পারে। আপনার ডিজাইনার হিসেবে মার্কেটপ্লেসে হয়ত লোগো ডিজাইনের কাজ করছেন। এ কাজ করেই ৫০হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ইনকাম করছেন। কিন্তু যদি এ ডিজাইন স্কীল দিয়ে টি-শার্ট অ্যাফিলিয়েশনের কাজ করেন, সেক্ষেত্রে হয়ত ইনকাম ৪-৫ লাখ কিংবা ১০-১২ লাখ টাকাও হতে পারে।
আবার যারা অ্যামাজন অ্যাফিলিয়েশনসহ অন্যান্য অ্যাফিলিয়েশন কিংবা সিপিএ নিয়ে কাজ করেন, তাদের ইনকাম ১লাখ হতে ২০লাখ টাকাও হতে পারে, এর চাইতে বেশিও হতে পারে। তবে শুরুতে এত বড় স্বপ্নটা না দেখাই ভালো। ছোট দিয়েই শুরুটা করতে হবে। প্রতিটা ধাপ দেখে দেখে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, ২-৩বছর পর যাতে বড় ইনকামকে টার্গেট করে কাজ করা সম্ভব হয়।
টেকভয়েস২৪: এ পেশার নিশ্চয়তা কতটুকু বলে মনে করেন?
মো. ইকরাম : শুরুতেই অন্যান্য যেকোন পেশার মতই অনিশ্চয়তা এ পেশাতেও রয়েছে। যেকোন পেশাতেই যেরকম ফ্রেশারদের জন্য খুবই অনিশ্চয়তা, একইভাবে ফ্রিল্যান্সিংয়েও শুরুর দিকে অনিশ্চয়তা। আপনি যদি নিজেকে প্রতিনিয়ত বাজার ডিমান্ড অনুযায়ি আরও আপডেট করতে থাকেন, তাহলে অবশ্যই একটা পর্যায়ে অনিশ্চয়তা ঘটে যাবে। স্কীল ডেভেলপে তাই সর্বদা সময় দিতেই হবে।