এক সংযোগের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগের একাধিক সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। সেবাগুলোর মধ্যে আছে মোবাইলে ভয়েস, ডেটা, উচ্চগতির ইন্টারনেট ও স্ট্রিমিং। বিটিসিএল এই সেবাগুলোকে নাগরিকের হাতের মুঠোয় আনতে চায়।
কিন্তু বিটিসিএল এমভিএনও, ট্রিপল প্লে ও কোয়াড প্লের মতো যেসব সেবা চালু করতে চাইছে, তার জন্য এখনো কোনো নির্দেশিকা (গাইডলাইন) নেই। তা ছাড়া এসব সেবা দেওয়ার জন্য বিটিসিএলের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়েও।
বিটিসিএলের এসব উদ্যোগের কথা ফেসবুকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব লেখেন, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ট্রিপল প্লে ও কোয়াড প্লে নিয়ে আসছে বিটিসিএল। এতে মোবাইল ভার্চ্যুয়াল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমভিএনও), মোবাইল সিম, আলাপ ও জিপন সেবা থাকবে। পাশাপাশি পাওয়া যাবে আনলিমিটেড ভয়েস ও ডেটা। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ওটিটি সেবা বা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সেবা পাওয়া যাবে।
চলতি মাসেই বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বিস্তারিত গণমাধ্যমে জানাবে বলে পোস্টে উল্লেখ করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি তাঁর পোস্টে আরও লেখেন, দেশের বৃহত্তম সরকারি টেলিযোগাযোগ কোম্পানি বিটিসিএল মানুষের জীবনকে সহজ করতে ডিভাইস, ভয়েস, ডেটা ও বিনোদনপ্রাপ্তি (এন্টারটেইনমেন্ট অ্যাকসেস) নিশ্চিত করে যোগাযোগব্যবস্থায় একটা নতুন আলোড়ন আনার চেষ্টা করবে।
এমভিএনও কী
এমভিএনও হলো একধরনের মোবাইল অপারেটর, যাদের নিজস্ব কোনো নেটওয়ার্ক অবকাঠামো নেই। তবে তারা অন্যান্য মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সিম, ডেটা ও ভয়েস-সুবিধা দেয়। অর্থাৎ বিটিসিএল যদি এমভিএনও হিসেবে বাজারে আসতে চায়, তাহলে তাকে দেশে বিদ্যমান মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। নেটওয়ার্ক ভাড়া নিতে হবে। ডেটা, ভয়েসসহ বিভিন্ন সেবা কিনে বিটিসিএল তা নিজেদের নামে গ্রাহকদের কাছে ‘নিজস্ব প্যাকেজ’ বানিয়ে বিক্রি করতে পারবে।
ট্রিপল প্লে ও কোয়াড প্লে কী
‘ট্রিপল প্লে’ বলতে এক সংযোগের মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট, ভয়েস কল (টেলিফোন) ও ভিডিও স্ট্রিমিং সেবাকে বোঝায়। এই তিনটির সঙ্গে মোবাইল (সিম কার্ড) সেবা যুক্ত হলে, তাকে ‘কোয়াড প্লে’ বলে।
বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, সেবাগুলো চালুর উদ্যোগটি একেবারেই প্রাথমিক আলোচনার পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে আপাতত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর টেলিটকের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
এমভিএনও চালুর লক্ষ্যে গত ২৭ আগস্ট বিটিসিএল ও টেলিটকের কর্মকর্তাদের নিয়ে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে আছে পরীক্ষামূলকভাবে তিন মাসের মধ্যে আলাপ, জিপন ও আইপিটিভি সেবার বান্ডল চালু করা। সেবার একটি ব্র্যান্ড নাম ঠিক করা। পরীক্ষামূলকভাবে এমভিএনও চালুর অনুমতির জন্য বিটিআরসির কাছে চিঠি পাঠানো। এ ছাড়া ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং নীতি প্রণয়ন। অবশ্য ২০১৭ সালেও বিটিসিএল নিজস্ব ‘ডিজিটাল সংযোগের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ’ প্রকল্পের আওতায় ট্রিপল প্লে চালুর উদ্যোগের কথা জানিয়েছিল। তবে পুরোপুরি চালু হয়নি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রণীত ‘টেলিকমিউনিকেশনস নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং পলিসি-২০২৫’-এর গেজেট গত মাসে প্রকাশ করে সরকার। এই নীতিমালায় এমভিএনও লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলা আছে। তবে এর জন্য আলাদা নির্দেশিকা করতে হবে।
এমভিএনওর জন্য এখনো কোনো নির্দেশিকা হয়নি বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী বলেন, নতুন নীতিমালায় (লাইসেন্সিং) এমভিএনও সেবার সুযোগের কথা বলা হয়েছে। এর জন্য আলাদা নির্দেশিকা হবে। এরপর সেবা চালুর বিষয়টি আসবে। বিটিসিএল হয়তো আগে থেকে বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে রাখছে।
ট্রিপল প্লে ও কোয়াড প্লে প্রসঙ্গে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, এখানে টিভি-ওটিটির ব্যাপার আছে। তাই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়েরও বিষয় আছে। এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে।
মোবাইল অপারেটর সূত্র বলছে, পশ্চিমা বিশ্বে এই সুবিধা আছে। এই সুবিধা চালুর বিষয়টি নির্ভর করে বাজারের আকার, বাস্তবতাসহ বিভিন্ন নির্ণায়কের ওপর। বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরের সংখ্যা কম। লাভজনক অবস্থায় আছে মাত্র দুটি অপারেটর। বাংলাদেশে এ ধরনের সুবিধা চালুর জন্য বাজার গবেষণা জরুরি। তা ছাড়া বিটিসিএল এমভিএনও সেবা কত টাকায় কিনবে, আর তা কত টাকায় গ্রাহকের কাছে বিক্রি করবে, সেসব ঠিক করতে হবে। কারণ, কোনো পক্ষই নিজেদের ক্ষতি চাইবে না। আবার গ্রাহকের ওপরও বাড়তি চাপ দেওয়া যাবে না। সরকারের ঘোষণার পর অপারেটরগুলো এরই মধ্যে এমভিএনওর জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে আগ্রহ দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সরকারি কোনো নির্দেশিকা না থাকায় এ ব্যাপারে তারা সাড়া দিতে পারছে না।
বিনিয়োগের প্রশ্ন
দেশের সরকারি কোম্পানিগুলো নানা সময় নীতিগত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। এর সর্বশেষ উদাহরণ ‘টেলিকমিউনিকেশনস নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং পলিসি-২০২৫’-এ দেখা গেছে। এতে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোকে কিছু নীতগত শর্তে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বছরের পর বছর সরকারি পাওনা পরিশোধ না করেও তারা কোম্পানি চালিয়ে থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকে নানা খড়্গ। এরপরও সরকারি কোম্পানিগুলো দাঁড়াতে পারছে না। এর অন্যতম বড় কারণ বিনিয়োগ। বিটিসিএল এমভিএনও, ট্রিপল প্লে ও কোয়াড প্লের মতো সেবা চালু করতে গেলে এখানে বিনিয়োগের বিষয় আছে।
খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এমভিএনওর মতো সেবা চালু করতে গেলে বিটিসিএলকে বেসরকারি মোবাইল অপারেটরদের মতো মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং, সেলস প্রভৃতি বিষয় দেখতে হবে। এর সঙ্গে গ্রাহকসেবার বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এসব ক্ষেত্রে টেলিটকের সেবা নিয়ে গ্রাহকদের নানা অভিযোগ আছে।
প্রযুক্তি নীতিমালা পরামর্শক আবু নাজম মো. তানভীর হোসেন বলেন, এ ধরনের সেবা চালুর আগে দেখতে হয়, বাজারে কোন ধরনের সেবার চাহিদা-জোগানের ফারাক আছে, কী প্রয়োজন। এর ওপর ভিত্তি করে সেবা আসে। এমভিএনও নানা ধরনের হয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এয়ারটেল, রাইজ বা স্কিটোকেও এমভিএনও বলে ধরা যেতে পারে। টেলিটকের সঙ্গে মিলে বিটিসিএল কোন ধরনের সেবা দিতে চায়, তা দেখার বিষয়। সে ক্ষেত্রে বিষয়টা যদি নিছক প্যাকেজিংয়ের পার্থক্য হয়, তাহলে বিটিসিএল আলাদা করে এমভিএনও চালু না করলেও পারে। তারা টেলিটকের সেবাও চুক্তির মাধ্যমে প্যাকেজ করে দিতে পারে।
তানভীর হোসেন আরও বলেন, যেখানে টেলিটকসহ সব মোবাইল অপারেটরের সেবার সক্ষমতা গ্রাহক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, সেখানে এমভিএনওর সম্ভাবনা আশাব্যঞ্জক নয়। এ ছাড়া অ্যাকটিভ শেয়ারিং নীতি করা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। সেখানে এমভিএনও সফল হবে কি না, তা একটা প্রশ্ন। ট্রিপল প্লে ও কোয়াড প্লের মতো সেবা মোবাইল অপারেটররা দিচ্ছে। কল, ইন্টারনেট, ওটিটিসহ কারও কারও ফিক্সড ওয়্যারলেস-সুবিধাও আছে। বিটিসিএলের ব্রডব্যান্ড সেবার সক্ষমতা সর্বোচ্চ। কিন্তু সেবার মানের দুর্বলতার কারণে বিটিসিএলের গ্রাহক তুলনামূলক কম। তারা নতুন কোনো সেবা আনতে চাইলে সেখানে বিনিয়োগের প্রশ্ন আসে। বিটিআরসিসহ অন্য অংশীজনদের পাওনা বাকি রেখে নতুন বিনিয়োগ করার আগে সরকারি কোম্পানিগুলোর গ্রাহকসেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক মনোভাব আনাটা বেশি জরুরি। সূত্র: প্রথম আলো