এই ব্যবস্থার বড় সুবিধা হলো, লেনদেনের তথ্য হারিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্লকচেইনের প্রতিটি লেনদেন স্থায়ীভাবে নথিভুক্ত থাকে এবং তা পরিবর্তন বা মুছে ফেলার সুযোগ নেই।
সময়ের পরিক্রমায় প্রযুক্তির অগ্রগতি বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবনধারার প্রতিটি দিক। বর্তমান যুগের অন্যতম আলোচিত উদ্ভাবন হলো ব্লকচেইন। এই প্রযুক্তি শুধু আর্থিক লেনদেনকেই নয়, বরং ব্যাংকিংসহ অনলাইনভিত্তিক নানা কার্যক্রমের ধারণা আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এর স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা, এবং বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামো ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করছে।
প্রযুক্তিবিদরা জানান, এই ব্যবস্থার বড় সুবিধা হলো, লেনদেনের তথ্য হারিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্লকচেইনের প্রতিটি লেনদেন স্থায়ীভাবে নথিভুক্ত থাকে এবং তা পরিবর্তন বা মুছে ফেলার সুযোগ নেই। একবার কোনো তথ্য ব্লকে যুক্ত হলে, তা চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয়। ফলে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো তথ্য বিকৃত করতে কিংবা মুছে ফেলতে পারবে না। এই অমোচনীয় বৈশিষ্ট্যই ব্লকচেইনকে তথ্যের নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতার নতুন মানদণ্ডে নিয়ে গেছে।
ব্লকচেইনকে একটি বিপ্লবী উদ্ভাবন হিসেবে দেখেন কানাডার শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাবিষয়ক পরামর্শক ডন ট্যাপস্কট। তাঁর ভাষায়, ‘ব্লকচেইন এমন একটা প্রযুক্তি, যেটা কোনো সত্তাকে বিশ্বাস করা ছাড়াই লেনদেনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। এটি একটি আস্থাকে একটি কোডে রূপান্তর করে ফেলে।’
ব্লকচেইন প্রযুক্তির আরেকটি অনন্য দিক হলো এর ‘হ্যাশ’ ফাংশন, যা প্রতিটি ডেটার জন্য একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি বা ‘আইডেন্টিফায়ার’ তৈরি করে। কোনো ডেটার একটি অক্ষর পরিবর্তন হলেও তা সম্পূর্ণ নতুন ‘হ্যাশ’ উৎপন্ন করে। এই প্রক্রিয়ায় ডেটা একটি জটিল এবং বিশাল শব্দমালায় রূপান্তরিত হয়, যা থেকে মূল ডেটা উদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব।
এ প্রযুক্তির নিরাপত্তা এতটাই শক্তিশালী যে, কোনো হ্যাকার ব্লকচেইন সার্ভারে অনুপ্রবেশ করলেও গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য বা লেনদেনের সঠিক বিবরণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি, ব্লকচেইনের বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামোর কারণে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে সরাসরি লেনদেন করা যায়, যেখানে কোনো মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয় না। এর ফলে, লেনদেন হয় তাৎক্ষণিক এবং সহজতর, যা বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে।
বৈশ্বিক বাজার গবেষণা ও পরামর্শক সংস্থা প্রেসিডেন্স রিসার্চের আগস্টের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক ব্লকচেইনের বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ৭৬০ কোটি ডলার। ২০২৪-এ প্রযুক্তির বাজার দাঁড়াবে ২ হাজার ৬৯১ কোটি ডলারে, যা ২০৩৪ সালের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারে পৌঁছানোর ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-৩৪ সাল পর্যন্ত বাজারের প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ।
অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস (এডব্লিউএস) বলছে, প্রথাগত ডাটাবেজ সিস্টেম একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়। একজন ব্যবহারকারী সে ডাটাবেজে নির্দিষ্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে অ্যাকসেস করেন। এ ডাটাবেজের একটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইউনিট থাকে, যা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ অ্যাডমিন চাইলেই ডাটাবেজে পরিবর্তন আনতে পারে। এখানে ব্যবহারকারীর হাতে কিছু করার নেই। কিন্তু ব্লকচেইন প্রযুক্তি যে উন্নত ডাটাবেজ সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তা একটি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয় না। অর্থাৎ এ সিস্টেম বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতিতে কাজ করে।
একটি কম্পিউটার বা কেন্দ্রের পরিবর্তে একাধিক কম্পিউটারের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ফলে তথ্যের পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব। কারণ ব্লকচেইন হচ্ছে অসংখ্য তথ্যের ব্লকের সমন্বয়ে গঠিত চেইন। প্রতিটি ব্লকে তথ্য সংরক্ষিত থাকে। প্রতিটি ব্লক ক্রমান্বয়ে একটির পর একটি সংযুক্ত। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে ব্লকচেইন শুরু করলে প্রথম যে তথ্য দিয়ে ব্লক তৈরি করতে হয় তাকে জেনেসিস ব্লক বলে। এরপর থেকে যখন ব্লক তৈরি হতে থাকবে, তখন প্রতিটি ব্লকে একটি করে কোড (হ্যাশ) থাকে। যার মাধ্যমে ওই ব্লক স্বতন্ত্র পরিচয় পায়। আবার একই সঙ্গে ব্লকগুলোয় আগের ব্লকের তথ্য (প্রিভিয়াস হ্যাশ) থাকে।
দ্রুতবর্ধনশীল ডিজিটাল বিশ্ব ভবিষ্যতে অনেক শিল্পে ব্লকচেইন প্রযুক্তির চাহিদা বাড়াবে বলে আশা করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা। এছাড়া এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমগুলো আরো জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এডব্লিউএস বলছে, মিডিয়া জগতে বিশেষ করে কপিরাইট, তথ্য সংরক্ষণ ও যাচাইয়ে স্বচ্ছতা আনতে ব্লকচেইন বেশ কার্যকর। এ প্রযুক্তিতে কনটেন্টের ক্ষেত্রে কপিরাইট হস্তান্তর খুব সহজ ও নিরাপদে করা যায়। সনি মিউজিক এন্টারটেইনমেন্ট বর্তমানে ব্লকচেইনের মাধ্যমে তাদের কাজ পরিচালনা করছে। ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে এবং কপিরাইট প্রসেসিং ফিও কমেছে।