তথ্যযুদ্ধে নতুন ফ্রন্টলাইন: ক্লাউড-নেটিভ অ্যাপ্লিকেশন সিকিউরিটি ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই, ২০২৫
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png টেকভয়েস২৪  ডেস্ক
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত

একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় এখন আর যুদ্ধ হয় না শুধু মাটিতে, আকাশে কিংবা সমুদ্রপথে। এখন যুদ্ধ হয় তথ্য দিয়ে, সফটওয়্যারের ভিতর দিয়ে, আর সবচেয়ে বেশি হয় অদৃশ্য এক পরিসরে, যার নাম ক্লাউড। বাংলাদেশ যখন “ডিজিটাল বাংলাদেশ” থেকে “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এর দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এক ভয়ঙ্কর বিপদ ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে, নিরাপত্তাহীন ক্লাউড-নেটিভ অ্যাপ্লিকেশন। এই বিপদ দেখা না গেলেও, তা বাস্তবে ভয়াবহতা ডেকে আনতে পারে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, আর্থিক স্থিতিশীলতা, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার উপর।

ক্লাউড-নেটিভ অ্যাপ্লিকেশন মূলত সেই ধরনের সফটওয়্যার যেগুলো ক্লাউড প্ল্যাটফর্মেই জন্ম নেয়, সেখানে বেড়ে ওঠে এবং সেখানেই চলতে থাকে। এগুলোর ভেতরে থাকে কনটেইনার, মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার, অটোমেটেড ডিপ্লয়মেন্ট পাথ, যার ফলে অ্যাপ্লিকেশনগুলো হয় দ্রুতগামী ও নমনীয়। এসব প্রযুক্তি যেমন ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সক্ষম, তেমনি এর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে তা আমাদের ডিজিটাল স্বপ্নকে এক মুহূর্তে দুঃস্বপ্নে রূপান্তর করতে পারে।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ক্লাউডভিত্তিক সেবা ব্যবহারে অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটেছে। সরকারি সেবাদান প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ, শিক্ষাবিষয়ক সফটওয়্যার, এমনকি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাও এখন ক্লাউডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ প্রসারে একটিই প্রশ্ন সামনে আসে: আমরা কি এগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি? বাস্তবতা বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরটি ‘না’। ২০২৩ সালে একটি ফিনটেক প্রতিষ্ঠানে কনটেইনার ভুল কনফিগারেশনের কারণে গ্রাহকের আর্থিক তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। আবার আরেকটি জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশনে এপিআই (API) নিরাপত্তার অভাবে হাজার হাজার ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয় হ্যাকাররা। এসব ঘটনায় শুধু ক্ষতি নয়, জনগণের আস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

ক্লাউড-নেটিভ অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ আসে বিভিন্ন স্তরে। অনেক সময় ডেভেলপাররা কনটেইনার ইমেজ তৈরি করার সময় তাতে এমন সফটওয়্যার রাখে, যা নিরাপত্তাহীন বা পুরোনো সংস্করণের। কোবারনেটস (Kubernetes) ক্লাস্টার ঠিকভাবে নিরাপদ না হলে ‘রোল বেসড অ্যাকসেস কন্ট্রোল’ ভেঙে হ্যাকাররা সহজেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। অনেক অ্যাপ্লিকেশনের গঠন এত জটিল হয় যে পুরো সফটওয়্যারের লাইফসাইকেলে (এসডিএলসি) নিরাপত্তা নজরদারি না রাখলে এক জায়গার ত্রুটি পুরো সিস্টেমে বিপর্যয় নামিয়ে আনতে পারে। এ ছাড়া ডেভঅপস (DevOps) বা সিআই/সিডি পাইপলাইন(CI/CD pipeline)-এ যদি সিকিউরিটি স্ক্যানিং (security scanning) এবং ভালনারেবিলিটি অ্যাসিসমেন্ট (vulnerability assessment) না থাকে, তবে হ্যাকারদের প্রবেশদ্বার খোলা থেকেই যায়।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠে, তাহলে কি বাংলাদেশের প্রযুক্তি উদ্যোগ থেমে থাকবে? একদমই না। বরং এখনই সময়-নিরাপত্তাকে প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে আনবার। আমাদের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিগুলোকে ডেভঅপস (DevOps) সংস্কৃতি অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিটি অ্যাপ্লিকেশনের যেন এপিআই (API) সঠিকভাবে সিকিউরড (secured) থাকে, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে।  ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যাজ কোড (IaC) ব্যবহারের ক্ষেত্রে একাধিক স্তরে যাচাই প্রক্রিয়া ও অটোমেশন (automation) যুক্ত করতে হবে। জাতীয়ভাবে প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট ক্লাউড অ্যাপ্লিকেশন সিকিউরিটি পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক (Cloud Application Security Policy Framework), যেখানে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রের জন্য সুস্পষ্ট গাইডলাইন থাকবে।

বাংলাদেশে সরকার যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি নিরাপদ প্রাইভেট ক্লাউড ইনিসিয়েটিভ (Private Cloud initiative) চালু করে এবং সকল সংবেদনশীল তথ্য স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করে, তবে তথ্য ফাঁস বা বিদেশি নিয়ন্ত্রণের শঙ্কা হ্রাস পাবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আইটি কোম্পানির অংশগ্রহণে নিরাপত্তা ট্যালেন্ট তৈরি করতে হবে। তরুণদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিরাপত্তাবিষয়ক ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ বাড়াতে হবে। হ্যাকাথন, বাগ বাউন্টি, ক্লাউড সিকিউরিটি ল্যাব, এসব উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণদের উদ্ভাবনী চেতনায় উসকে দিতে হবে।

বিশ্বের বিশাল অংশ ইতোমধ্যেই ক্লাউড-নেটিভ সফটওয়্যারে রূপান্তরিত হয়েছে। গার্টনার (Gartner) এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ নতুন সফটওয়্যার হবে ক্লাউড-নেটিভ। বাংলাদেশ যদি এখনই এই পরিবর্তনের প্রস্তুতি না নেয়, তবে আমরা শুধু প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বো না, বরং জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকিতেও পড়বো। কারণ, যে দেশে ডেটা নিরাপদ নয়, সে দেশ কখনোই সত্যিকারের ডিজিটাল হতে পারে না।

তাই আজকের দিনে, যখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি, তখন প্রযুক্তির পাশাপাশি তার নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার না দিলে এই স্বপ্ন একদিন ধুলোয় মিশে যাবে। ক্লাউড প্রযুক্তি যেমন ভবিষ্যতের শক্তি, তেমনি এর নিরাপত্তা ছাড়া এটি হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের দুর্যোগ। এখনো সময় আছে, ‘নিরাপদ ক্লাউড’-এর জন্য প্রস্তুত হই, যেন বাংলাদেশ হয়ে ওঠে প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভর, নিরাপদ ও গর্বিত এক ডিজিটাল জাতি।

লেখক: ড. মো. মারুফ হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং পরিচালক, সেন্টার ফর সাইবার সিকিউরিটি, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি

image

আপনার মতামত দিন