দেশের সৃজনশীল খ্রিস্টান লেখক, কবি-সাহিত্যিক ও মুক্ত চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন মানুষদের ২৮ বছরের পুরানো সংগঠন বাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরাম। অন্য পাঁচটা সম্প্রদায়-ভিত্তিক সংগঠনের মতো নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুর হয়। সংগঠনটির দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় রয়েছে সুখ ও দুঃখ গাঁথার এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস। এখানে রয়েছেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে গর্ব, অসংখ্য বিখ্যাত, প্রসিদ্ধ ও গুণী লেখক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্য পরিচালক, অভিনেতা, কলামিস্ট ও সাংবাদিক।
স্বপ্নবাজ মানুষের চিন্তা থেকে যাত্রা শুরু হয় সংগঠনেরদুই বা তিনজন স্বপ্নবাজ মানুষের চিন্তা থেকে যাত্রা শুরু হয় যেকোনো সংগঠন বা ফোরামের। যাত্রার শুরুর পথটা কখনো মসৃণ হয় না। চায়ের আড্ডায়, কোনো গাছতলায় গল্পোচ্ছলে হঠাৎ একজনের মাথায় চিন্তার উদয় হয়। সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় পরিকল্পনার। দফায়, দফায় চলে মিটিং-সিটিং, আড্ডা ও আলোচনা সভা। অর্থপূর্ণ “নাম” নির্বাচন। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে লেখা হয় গঠনতন্ত্র। সে অনুসারে কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন। শুরু হয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা।
তিন স্বপ্নদ্রষ্টার সম্মিলিত চিন্তার ফসলবাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরামও এর ব্যতিক্রম নয়। গুণী কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার সুবীর কাস্মীর পেরেরা, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ভিক্টর কে. রোজারিও এবং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সঞ্জীব দ্রং এই তিন স্বপ্নদ্রষ্টার সম্মিলিত চিন্তা ও প্রচেষ্টার ফসল এই লেখক ফোরামটি। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিসহ কার্যনির্বাহী পরিষদের সকল সদস্য ও সাধারণ সদস্যরা একটা নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছেন। কালের যাত্রায় সংগঠনটির কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিভিন্ন মেয়াদে বেশ কয়েকটি কার্যনির্বাহী পরিষদ দায়িত্ব পালন করেছেন। সকল কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ অভিনন্দন।
তাঁদের কাজেও রেখে যেতে হয় পদহিহ্নসম্মানিত সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা, সংগঠন ও সাধারণ সদস্যদের কল্যাণে এবং উন্নয়নে কাজ করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। তাই তাঁদের কিছু নৈতিক দায়িত্ব থাকে। পুরো মেয়াদে সাংগঠনিকভাবে আয়োজিত ও অনুষ্ঠিত সকল কার্যক্রমের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন আকারে রেজিস্টার খাতায় লেখা, প্রকাশনার খরচ ও কেনাকাটার বিল-ভাউচার সংরক্ষণ করা, নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব কার্যনির্বাহী পরিষদের সংশ্লিষ্ট কমিটির অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব। বার্ষিক সাধারণ সভায় কোন সদস্য যেকোনো অনুষ্ঠান বা কেনাকাটার খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে যেনো কোষাধ্যক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ওই বিলের কাগজ দেখাতে পারেন। যেকোনো সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় আর্থিক লেন-দেনের হিসেবের স্বচ্ছতা থাকাটা জরুরি। কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা নিজ নিজ দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করলে পরের মেয়াদে পরিষদের সদস্যদের দায়িত্ব পালনে কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না।
হৃদয় দিয়ে ধারণ করতে হয় সংগঠনকেকার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের সংগঠনকে ধারণ করতে হয় হৃদয়ে। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করে যখন কেউ মন থেকে বলতে পারেন, এই সংগঠনটা আমার। এটিকে তিন বছর আমি নিজের সন্তানের মতো যতœ করবো। তখন তাঁর সব কাজগুলো হবে স্বতঃস্ফূর্ত, আত্মনিবেদিত। সদস্যদের কল্যাণমুখী। সেটি প্রকাশ পাবে সদস্যদের সঙ্গে তাঁর কথায়, কাজে, ব্যবহারে ও আচরণে। যারা নির্বাচিত হয়ে মনে করেন আমি জনগণের ভোটে নেতা হয়েছি। এটা আমার অর্জিত ক্ষমতা। এই তিনটা বছর আমি আমার মতো করে কাজ করবো। সাধারণত, এ মনোভাবের মানুষগুলো দ্বারা সংগঠন ও সদস্যদের কল্যাণমূলক তেমন কোনো কাজই হয় না। অন্যদিকে, এই শ্রেণির কেউ কেউ আবার সুকৌশলে সংগঠনকে ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধি বা নিজের ব্যবসা বড় করার ব্যানার ও টুলস হিসেবে ব্যবহার করেন। আমাদের চারপাশে বিভিন্ন সংগঠনে এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে। এমনটা কারোই কাম্য নয়।
বয়স তোমার ২৮, শুধু কি সংখ্যা, না যোগ্যতায়?১৯৯৭ সালে রাজধানীর ফার্মগেটের তেজগাঁও কলেজের বিপরীতে পরিত্যাক্ত মাঠটি ছিল (আনোয়ারা উদ্যান), সেখানে খোলা আকাশের নিচে ভাসমান মানুষ বাস করতো। সময়ের পরিবর্তনে সেটির উপর দিয়ে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে গেছে। তাই সংগঠনের দৃশ্যমান কিছু ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও পরিচালনা কৌশলও হতে হবে এমনই যুগোপযোগী ও স্মার্ট। কারণ সংগঠনটির বয়স এখন ২৮ বছর। একজন সচেতন লেখকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ২৮ বছরের সংগঠনটি কি শুধু বয়সেই বড় হয়েছে, নাকি যোগ্যতা অর্জন করে পরিপক্কও হয়েছে। জানা মতে, সংগঠনটি এখনও সমাজসেবা অধিদফতর থেকে সরকারি নিবন্ধনের কাজ সম্পন্ন করা হয়নি।
২৮ বছরের যুবক যেমন নিজে সাবলম্বী হয়, তেমনিভাবে সংগঠনটিও সবদিক থেকে সাবলম্বী হওয়ার কথা। বাস্তবে কতটুকু হয়েছে সেটা ভাববার বিষয়। একটা সংগঠন তখনই সাবলম্বী বলা যাবে, যখন সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুসারে কার্যনির্বাহী পরিষদের সকল বিভাগের কার্যক্রমের সবকিছু তথ্য প্রমাণের সাথে সংরক্ষিত থাকে। আর্থিক লেন-দেনের বিষয়ে স্বচ্ছতা বজায় থাকে। প্রয়োজনীয় সব ফাইলপত্র, বিল-ভাউচার, ডকুমেন্টস গোছানো থাকে। শুধু সেকেলের মতো খাতায় লেখা নয়, এখন স্মার্টলি ওয়েবে ও সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করাও সময়ের দাবি। এ বিষয়গুলো ঠিক থাকলে সংগঠন চলবে আপন গতিতে। সময়ের পালা-বদলে কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা বদল হবে। কিন্তু সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার ইকোসিস্টেম ঠিকই থাকবে। সেই ইকোসিস্টেম কি গড়ে তোলা হয়েছে?
সংগঠনের গতিশীলতায় কৌশলগত কর্ম পরিকল্পনাস্মার্ট যুগে সংগঠনের গতিশীলতা বাড়াতে কৌশলগত পরিকল্পনায় আনতে হবে বৈচিত্রতা। যেখানে সব সদস্যরা সক্রিয়ভাবে সব কাজে অংশগ্রহণ করে নিজেদের প্রতিভাকে বিকশিত করতে পারেন। এর জন্য বর্তমানে কার্যনির্বাহী পরিষদ নিতে পারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও কার্যকর উদ্যোগ। তৈরি করতে পারে তিন বছরের জন্য স্মার্ট কৌশলগত পরিকল্পনা, তিন বছরের রোডম্যাপ। চলতি ২০২৪-২০২৭ মেয়াদের কোন মাসে কি প্রোগ্রাম আয়োজিত হবে, সেগুলো নিয়ে একটা ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করা যেতে পারে।
সদস্যদের স্মার্ট স্বীকৃতি প্রদানপ্রত্যেক সদস্যকে লেখক হিসেবে পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে একটা স্মার্ট কার্ড বা পরিচয়পত্র দেওয়া যেতে পারে। স্মার্ট কার্ডটি সদস্যরা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সময় পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। দেশের বাইরে গেলেও কখনও কখনও সংগঠনের এসব পরিচয়পত্রের গুরুত্ব বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের সব খ্রিস্টান হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডাক্তার, উকিল, স্কুল ও কলেজের সাথে সমঝোতা চুক্তি করা যেতে পারে। সদস্যরা যখন অসুস্থ হবেন তখন তাঁরা যেনো ওই স্মার্ট আইডি কার্ড দেখিয়ে চুক্তিকৃত ডাক্তারের চেম্বারে ও হাসপাতালে সুলভ ও সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা নিতে পারেন। একইভাবে খ্রিস্টান উকিল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুবিধা নিতে পারেন।
স্মার্ট যুগে প্রয়োজন যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য গঠনতন্ত্র১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরামের যাত্রার শুরুতে প্রথম কার্যনির্বাহী পরিষদের তিনজন প্রতিষ্ঠাতা সম্মানিত সদস্য প্রথম গঠনতন্ত্র রচনা করেন। ২৮ বছরের যাত্রাপথে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু যুগের প্রয়োজনে এটিকে আরও স্মার্ট, সময়োপযোগী ও সদস্যবান্ধব করা সময়ের দাবি। কেননা যেকোনো সংগঠন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একটা মানসম্পন্ন, সময়োপযোগী, সদস্যবান্ধব এবং গ্রহণযোগ্য গঠনতন্ত্র। এই গঠনতন্ত্রের সাহায্যেই পরিচালিত হয় সংগঠনের প্রতিটি মেয়াদের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম।
নিতে হবে নতুন চ্যালেঞ্জ২৮ বছরের পথচলায় সংগঠনের ইতিহাসে এবারই প্রথম ব্যালট পেপারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।নির্বাচনটি সুষ্ঠু, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। দায়িত্ব পেলেন নতুন কার্যনির্বাহী পরিষদ। সময়ের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে নতুন কার্যনির্বাহী পরিষদকে নিতে হবে নতুন চ্যালেঞ্জ।
ভাবনার ফানুস পুড়ে প্রতিহিংসার আগুনেএকজন লেখক হিসেবে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়াটা সুভাগ্যের বিষয়। ভাল লেখক হয়েও অনেকে তার সৃষ্ট সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম দিয়ে মানুষের হৃদয় ছুঁতে পারেন না। কারণ তিনি তাঁর কথা-বার্তা, আচরণ ও চিন্তা-ভাবনায় পরিপক্কতার পরিচয় দিতে পারেন না। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে, ম্যাসেঞ্জারে পাবলিক গ্রুপে কোথায়, কিভাবে, কতটুকু প্রক্রিয়া প্রকাশ করতে হয়, আলাপে কেমন শব্দ চয়ন করতে হয়, সেক্ষেত্রেও বিচক্ষণতার অভাব রয়েছে। প্রত্যেকজন ব্যক্তি বা লেখক সম্মানিত। সবাই সম্মান চান। সম্মানের বদলে তাঁকে নিয়ে অশালীন শব্দে সমালোচনা করলে, একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি যখন সেগুলো দেখেন, পড়েন, তখন অসম্মানিতবোধ করবেন। মনে কষ্ট পাবেন। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করলে ওই লেখক যত বিখ্যাত, প্রসিদ্ধ ও গুণীই হন না কেনো, একটা সময় তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমতে থাকে। অন্যদিকে, ওই খ্যাতিমান লেখক হয় তো মনে মনে নিজেকে সবার থেকে বড় ভাবছেন। ছোটদের গোনার মধ্যেই ধরছেন না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন। একটা সময় যখন প্রিয় মানুষগুলো তাঁকে এড়িয়ে চলতে থাকেন, তখন নিজে থেকেই মানসিক যন্ত্রণার আগুনে পুড়তে থাকেন। এমন আচরণ বিভিন্ন সংগঠনে লক্ষ্য করেছি। খ্রিস্টান হিসেবে আমাদের মধ্যে যে শিক্ষা ও মূল্যবোধ রয়েছে, এমন আচরণ কারওই কাম্য না।
শেষ কথাএকটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের যে কথাগুলো এককভাবে বললে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব পায় না, সেটি সংগঠনের ব্যানারে বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। ওই সম্প্রদায়ের অধিকার আদায় সহজ হয়। আমাদের প্রাণের সংগঠন ‘খ্রিস্টান লেখক ফোরাম’ও একইভাবে গোটা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জাতীয় অধিকার আদায়ে সুদূরপ্রসারী ও বিলষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। এমনটাই প্রত্যাশিত। (লেখাটি খ্রিস্টান লেখক ফোরামের লিটল ম্যাগাজিন আর্শির ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছে)
লেখক: উজ্জ্বল এ গমেজ, লেখক ও সাংবাদিক।