পর্বতঘেরা প্যাংগং লেকের চোখজুড়ানো সৌন্দর্য

প্রকাশ: বুধবার, ১৪ অগাস্ট, ২০২৪
Image টেকভয়েস২৪  ডেস্ক
news-banner
  ছবি: সংগৃহীত
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৩৫০ মিটার উঁচুতে লোনাপানির হ্রদ প্যাংগং। পাহাড়ে ঘেরা অপার্থিব সৌন্দর্যের আধার। ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছায়াছবির কল্যাণে এখন পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে।

ভারতের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘থ্রি ইডিয়টস’ দেখে থাকলে নিশ্চয়ই এর শেষ দৃশ্যে নীল জলরাশি আর পর্বতঘেরা অপার্থিব সুন্দর হ্রদের দৃশ্য অবশ্যই মনে থাকার কথা। এ দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল ভারত ও চীনের সীমান্তবর্তী পৃথিবীর উচ্চতম নোনাজলের হ্রদ প্যাংগংয়ে। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা বিখ্যাত হবার পর থেকে প্যাংগং লেকের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এখন অসংখ্য মানুষের ‘বাকেট লিস্টে’ যোগ হচ্ছে লাদাখ। আমিও এর ব্যতিক্রম নই, সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম লাদাখ যাওয়ার।

অবশেষে সে সুযোগ চলে আসে এ বছর। ২০২৪ সালের কোরবানির ছুটিটা সপ্তাহান্তের সঙ্গে থাকায় মাত্র দুদিন ছুটি নিলে ৯ দিনের টানা ছুটি মিলে যায়। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে লাদাখ যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলি। জুন থেকে আগস্ট, বছরের এ সময়টা লাদাখ যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এ ধরনের ঘোরাঘুরির জন্য প্রয়োজন মোটামুটি বড় একটি গ্রুপের।

ফেসবুকে তারিখ ঘোষণা করে ভ্রমণসঙ্গী চেয়ে পোস্ট দিতেই পেয়ে যাই বেশ কয়েকজনকে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র উর্মি আপু আর তাঁর মেয়ে পদ্য, আগের সহকর্মী লিপি আপা, তাঁর স্বামী সূর্য ভাই, মেয়ে ভোর, আমার ব্যাচমেট জুঁই, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক জুনিয়র তানিম, আমার স্ত্রী বাবলী ও ছেলে আরিয়ান। সব মিলে দশজনের দারুণ একটা দল হয়ে যায়।

লাদাখ পৌঁছে লেহ শহরে দুদিন থেকে আমরা চলে যাই নুব্রা ভ্যালিতে। সেখান থেকে তুর্তুক গ্রাম দেখে পরের দিন যেতে হবে প্যাংগং। কিন্তু সমস্যা শুরু হয়ে গেল আগেই। দলের বেশ কয়েকজনের উচ্চতাজনিত সমস্যা দেখা দিল। লেহর হাসপাতালে দলের কনিষ্ঠ দুই সদস্য সাত বছর বয়সী আরিয়ান ও পদ্যকে সতর্কতামূলক অক্সিজেন দিয়ে রাখল চার ঘণ্টা। এদিকে নুব্রা ভ্যালি পৌঁছানোর পর তানিমের মাথাব্যথা শুরু হলো। এটা উচ্চতাজনিত অসুস্থতার প্রথম লক্ষণ। রাতে তানিমকে নিয়ে গেলাম ডিস্কিত হাসপাতালে।

সেখানে ডাক্তার জানালেন শুধু অক্সিজেন স্বল্পতা নয়, জ্বরেও ভুগছে সে। অক্সিজেন, প্যারাসিটামল, স্যালাইন আর ইনজেকশন দিয়ে তবে ছাড়লে তানিমকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এ জন্য খরচ করতে হয়েছে মাত্র ৩০ রুপি! ডাক্তারকে আমাদের ট্রিপের পরবর্তী পরিকল্পনা খুলে বললাম। ডাক্তার জানালেন, আর কোনো সমস্যা হবার সম্ভাবনা উনি দেখছেন না; জরুরি প্রয়োজনে প্যাংগংয়ের কাছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাসপাতাল আছে।

আমরা অবশ্য সতর্কতা হিসেবে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার সঙ্গে  রাখি। এটা দিয়ে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ চালানো সম্ভব। যাহোক, ঈদের দিন সকালে ঈদের জামাত নুব্রা ভ্যালিতে পর্বতের পাদদেশে আয়োজন করা হয়েছিল। নামাজ শেষ করে লিপি আপার রান্না করা সেমাই খেয়ে আমরা রওনা হয়ে যাই স্বপ্নের গন্তব্য প্যাংগং লেকের উদ্দেশে। শুরুতে রাস্তা ভালো থাকলেও যত সময় যাচ্ছিল, ততই রাস্তার বেহাল দশা দেখা দিচ্ছিল।

একপর্যায়ে বিশাল এক পাথুরে উপত্যকায় উপস্থিত হলাম আমরা। রাস্তা বলতে পাথর দিয়ে কোনোমতে সমান করে রাখা অংশ। এর মধ্যেই দক্ষতার সঙ্গে আমাদের ট্রাভেলার টেম্পো চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ড্রাইভার। সিটে বসে থাকাই কষ্টকর এই এবড়োখেবড়ো রাস্তায়। মনে হচ্ছে পৃথিবী নয়, চাঁদের বুকে আমাদের পথচলা; আর সেটা যেন শেষ হবার নয়। অবশেষে প্রায় দুই ঘণ্টা পরে এ কষ্টকর যাত্রা শেষ হলো পর্বতের কাছে এসে। এবার রাস্তা ভালো, কিন্তু পাথুরে পর্বত কেটে বানানো। তাই এঁকেবেঁকে উঠতে শুরু করলাম আমরা। কোথাও কোথাও পর্বতের অংশ রাস্তার ওপর ছাদের মতো রয়েছে।

প্যাংগংয়ের কাছে আসতে আসতে রাস্তা যেন আরও ভালো হয়ে গেল। আমরা তখন ছুটে চলেছি মসৃণ গতিতে। উঁচু পর্বতের বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল নীল জলরাশির বিশাল এই হ্রদের প্রথম অংশ। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমরা দেখতে লাগলাম পৃথিবীর বুকে অপার্থিব এ ভূখণ্ডকে। চারপাশের সুউচ্চ পর্বতগুলোর রংও বেশ কয়েক রকমের। কোনোটা চীনামাটির সাদাটে পর্বত, কোনোটা খয়েরি, আবার কোনোটার চূড়া ঢেকে আছে বরফে।

এই হ্রদের দৈর্ঘ্য ১৬০ কিলোমিটার! এই হ্রদের তিন ভাগের মালিকানা চীনের আর এক ভাগের, মানে প্রায় ৬০ বর্গকিলোমিটারের মালিক ভারত। হ্রদের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। গন্তব্য ঠিক যেখানে ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির শুটিং হয়েছে, সেখানটায়। গাড়ি থেকে যখন নামলাম, তখন বিকেল পাঁচটা বাজে। প্রখর রোদ; তাই জ্যাকেটগুলো গাড়িতে রেখে আমার হাঁটা দিলাম লেকে ধারে। কাছাকাছি পৌঁছাতেই মেঘে ঢেকে গেল আকাশ; সঙ্গে  তীব্র শীতল বাতাস। বাধ্য হয়ে আবার গাড়ি থেকে শীতবস্ত্র নিয়ে আসতে হলো।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই হ্রদের উচ্চতা ৪ হাজার ৩৫০ মিটার (১৪ হাজার ২৭০ ফুট)। এখানকার পানি লবণাক্ত; এটা কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাই একটু মুখে দিয়ে দেখলাম সেটা সত্য কি না। সমুদ্রের মতো না হলেও সামান্য লবণ রয়েছে পানিতে। এই স্বচ্ছ পানিতে নামার খুব ইচ্ছা থাকলেও জানলাম, এখানে নামা নিষিদ্ধ। সীমান্তবর্তী এলাকা হবার কারণে কোনো নৌভ্রমণ করাও যাবে না। লেকের ধারে ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভির শেষ দৃশ্যের মতো কিছু হলুদ স্কুটার রাখা আছে। ভাড়ায় পাওয়া যায়। শেষ দৃশ্যে কারিনা কাপুর যেমন লেহেঙ্গা পরেছিল, সেটাও। এ ছাড়া তিনটি করে চেয়ার রাখা আছে, যেগুলোতে বসে ছবির তিনজনের মতো করে পোজ দিয়ে ছবিও তুলছেন অনেকে।

আমরাও কিছু ছবি তুলে লেক ঘুরে দেখতে থাকি। এদিকে তাপমাত্রা নেমে এসেছে ১০ ডিগ্রির নিচে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাড়িতে ফিরে গিয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিই। প্যাংগংয়ে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে অনেক। তবে বেশির ভাগ হোটেলই খুব সাদামাটা। এ ছাড়া তাঁবুতেও থাকছেন অনেকে। আমরা উঠেছিলাম প্যানারোমা রিসোর্টে।

এক সারিতে লেকের দিকে মুখ করা পরপর পাঁচটি রুম আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। রুমের সামনে বসেই দেখা যাচ্ছিল প্যাংগং লেকের একটি বড় অংশ; আর রুমের পেছনে পর্বতসারি। সব পর্বতের মাথায় বরফ জমে আছে। বোঝা যাচ্ছে, হ্রদের এপারের পর্বতগুলোর উচ্চতাই বেশি। শীতের সময় পুরো লেক জমে বরফের মাঠে পরিণত হয়। কেবল জুন থেকে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর পর্যন্ত এ ধরনের নীল-সবুজ রূপ দেখা যায়।

হোটেল ম্যানেজার জানিয়ে গেলেন রাতের খাবার দেওয়া হবে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। লাদাখে এ সময়ও দিব্যি আলো থাকে। ডাইনিংয়ে উপস্থিত হয়ে দেখলাম, খাবার গরম আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম। আকাশে দশমীর চাঁদ, তার আলোতেই যেন ভেসে যাচ্ছে এই নীল দরিয়া। রাতে চাঁদের আলোয় পর্বত আর হ্রদের সৌন্দর্য দেখতে তাই বের হয়ে পড়ি লিপি আপা, সূর্য ভাই, ভোর, তানিম ও আমি।

তাপমাত্রা তখন শূন্যের কাছাকাছি। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লেকের ধারে এসে দাঁড়াই আমরা। চাঁদের আলোয় পর্বতের স্নো-ক্যাপ জ্বলজ্বল করছে। হ্রদের অন্য পাশে আকাশজুড়ে তারার মেলা। এ সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। আমরা তীব্র শীত উপেক্ষা করে আরো কিছুক্ষণ থেকে তারপর রুমে ফিরে আসি।

সকালে আমার যখন ঘুম ভাঙল, তীব্র রোদে চোখ ঝলসে যাওয়ার অবস্থা। মনে হচ্ছিল দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়েছি; অথচ তখন সাতটাও বাজেনি। বের হয়ে চোখ চলে গেল লেকের দিকে। মনে হচ্ছে, আগের দিনের চেয়ে এর সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। সকালে নাশতা সেরে নিই আমরা। আগের রাতেই পইপই করে বলে দিয়েছে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ, চেক–আউট সকাল নয়টায়। দেরি না করে সব গুছিয়ে রওনা দিলাম লাদাখের রাজধানী লেহর উদ্দেশে।

যেতে হলে জানা চাই
এবার জানিয়ে দিতে চাই এই সফরের কিছু বিষয়। তাহলে আগ্রহীদের সুবিধা হবে।

যেভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে লাদাখে বিমানে গেলে দিল্লিতে ট্রানজিট নিতে হবে। লেহ এয়ারপোর্ট দুপুরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়, তাই আগের দিন রাতের ফ্লাইট নিয়ে ভোরের ফ্লাইটের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারেন। সড়কপথে গেলে দিল্লি থেকে মানালী হয়ে আসতে পারেন লেহতে।

খরচ: ঢাকা থেকে বিমানে গেলে খরচ পড়বে জনপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আর ওখানে ঘোরাঘুরি করতে জনপ্রতি প্রায় একই রকম খরচ পড়বে। অবশ্যই শীতের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে যেতে ভুলবেন না। সূত্র: হাল ফ্যাশন

লেখক: মুহাম্মদ হোসাইন সবুজ 

image

আপনার মতামত দিন