বাংলাদেশের নানান উপজাতি ভাষা হারিয়ে যাওয়ার পথে। এই ভাষাগুলো শুধু শব্দ নয়, মানুষের জীবনধারা, ইতিহাস এবং আবেগ বহন করে। হারিয়ে গেলে দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন সময় ‘মাল্টিলিঙ্গুয়াল ক্লাউড’এসেছে নতুন এক উদ্যোগ নিয়ে, তারা দেশের বৈচিত্র্যময় ভাষাগুলোকে ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণ করছে এবং সময়ের সঙ্গে হারিয়ে না যায় সেজন্য কাজ করছে।
‘রেঙ্গমিটক’ বা ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা বিশ্বে মাত্র ছয়জন মানুষই বলতে পারেন। এদের মধ্যে পাঁচজনের বয়স ৬০ এর বেশি এবং একজন প্রায় ৫০ বছর বয়সী। তারা বান্দরবানের গভীর পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন। চারজন আলিকাদামে, দুইজন নাইক্ষংছড়িতে। তারা চলে গেলে ভাষাটিও চিরতরে হারিয়ে যাবে। এই ভাষা যে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে, তা আর কেউ বুঝতে পারবে না।
সাম্প্রতিক এই ডিজিটাল সংরক্ষণ উদ্যোগের মাধ্যমে রেঙ্গমিটকা ভাষার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। মাল্টিলিঙ্গুয়াল ক্লাউড শুধু শব্দ নয়, উচ্চারণ, ছন্দ, গল্প সবই সংরক্ষণ করছে। এর ফলে আধুনিকতার চাপেও এই ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে না।
জাতির কণ্ঠসংগ্রহ
আইসিটি বিভাগের তহবিল এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) উদ্যোগে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় ডিজিটাল আর্কাইভ। এখন পর্যন্ত ৪২টি ভাষা এবং ৫টি উপভাষার তথ্য ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ৭,১৭৭টি বিষয়ভিত্তিক নমুনা এবং ২১৬ জন মাতৃভাষী বক্তার ১২,০০০ মিনিটের অডিও রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় এক লাখ বাক্য আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক লিপিতে লিপ্যন্তর করা হয়েছে।
সংগ্রহ স্থল থেকে সরাসরি আর্কাইভে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মামুন উর রশিদ জানান, ‘আমরা এমন একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছি, যা সরাসরি মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করে। তথ্য একেবারেই সংগ্রহ স্থান থেকে স্থায়ীভাবে রেকর্ড হয়।’
দলটি দেশের আটটি অঞ্চলে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছে। উত্তর বঙ্গ, সিলেটের চা বাগান, ময়মনসিংহ-শেরপুর-নেত্রকোনা এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ঘুরে তারা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ছড়িয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন বেদে সম্প্রদায়ের এবং ঢাকাইয়া উর্দু ভাষাভাষীর কাছ থেকেও তথ্য নেওয়া হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ ও নতুন পথ
প্রকল্পের গবেষণা ও কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ চারু হক জানান, ‘বাংলাদেশে এ ধরনের কাজের আগে কোনো মডেল ছিল না। তাই আমাদের নিজস্ব পথ তৈরি করতে হয়েছে।’ প্রাথমিকভাবে টেন্ডার পাঁচবার প্রকাশিত হলেও কোনো প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখায়নি। আইসিটি বিভাগের পূর্ণ সহযোগিতা নিশ্চিত হলে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে।
তথ্য সংগ্রহের সময় দলটি স্থানীয় পরিবারের সঙ্গে থেকেছে, খেয়ে, তাদের জীবনধারা বোঝার চেষ্টা করেছে। চারু হক বলেন, ‘শুধু দেখা নয়, সঙ্গে বসবাসের মাধ্যমে প্রকৃত ভাষাগত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।’
ভাষার গুরুত্ব
ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়। এটি সমাজের ইতিহাস, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আবেগ বহন করে। মো. মামুন উর রশিদ বলেন, ‘ধর্ম, সংস্কৃতি, খাদ্য, বিশ্বাস- এগুলো আমাদের পরিচয়ের ভিত্তি। একটি ভাষা হারালে মানুষের বৈচিত্র্যও হারায়।’
ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি ভাষা হারায়। বাংলাদেশে ১৪টি ভাষা বিলুপ্তির পথে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ
অনেক উপজাতি সম্প্রদায়ের তরুণরা মাতৃভাষা ছেড়ে বাংলা বা ইংরেজি ব্যবহার করছেন। মাল্টিলিঙ্গুয়াল ক্লাউড উচ্চারণ, গঠন এবং মৌখিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করছে, যাতে ভাষা হারালেও ইতিহাসে অমর থাকে। গবেষক, শিক্ষক এবং ভাষাপ্রেমীরা ভবিষ্যতে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভাষাগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে।
মামুন উর রশিদ বলেন, ‘প্রকল্পের লক্ষ্য শুধু শব্দ সংরক্ষণ নয়। এটি সম্মান, স্মৃতি এবং উপজাতি সম্প্রদায়ের পরিচয় রক্ষা। প্রতিটি সম্প্রদায়ের, যত ছোটই হোক, তাদের ঐতিহ্য রক্ষার অধিকার আছে।’
রেঙ্গমিটকার ছয়জন বেঁচে থাকা বক্তা থেকে খারিয়া ভাষা রক্ষাকারী বৃদ্ধ বোনেরা- প্রতিটি রেকর্ডিং মানুষের সহনশীলতা, ইতিহাস এবং মানবজাতির গল্প বলে। মামুন উর রশিদ আরও বলেন,‘ভাষা মানুষের ইতিহাস। সংরক্ষণ মানে কেবল শব্দ নয়, মানবতার সম্মিলিত ঐতিহ্য রক্ষা করা।’