বিশ্বের ডিজিটাল অবকাঠামোর মেরুদণ্ড হলো ডাটা সেন্টার। ইন্টারনেট, ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবকিছুর পেছনেই রয়েছে হাজার হাজার সার্ভার। কিন্তু সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য: বিশ্বের অধিকাংশ ডাটা সেন্টার এমন অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে তাপমাত্রা বা আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এর ফলে বাড়ছে বিদ্যুৎ ব্যবহার, জ্বালানি খরচ এবং পরিবেশগত চাপ।
আদর্শ তাপমাত্রা বনাম বাস্তবতা
ডাটা সেন্টার শিল্পের মানদণ্ড নির্ধারণকারী সংস্থা এএসএইচআরই (ASHRAE) জানায়, সার্ভার নিরাপদ ও কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য বাতাসের তাপমাত্রা ১৮ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকা উচিত। এই সীমার বাইরে গেলে সার্ভার অকার্যকর হতে পারে কিংবা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিশ্বজুড়ে ৮ হাজার ৮০৮টি কার্যকর ডাটা সেন্টারের মধ্যে প্রায় ৭ হাজারটি এমন এলাকায় অবস্থিত, যেখানে তাপমাত্রা এই আদর্শ সীমার বাইরে।
অতিরিক্ত গরম ও অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, দুই দিকেই সমস্যা
এএসএইচআরইর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় ৬০০টি ডাটা সেন্টার এমন অঞ্চলে রয়েছে, যেখানে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। আবার অনেক ডাটা সেন্টার কাজ করছে ১৮ ডিগ্রির নিচের অতিরিক্ত ঠাণ্ডা এলাকায়। উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যা এক, তাপ নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োজন, যা বিদ্যুৎ ব্যবহারের দক্ষতা কমিয়ে দেয়।
সিঙ্গাপুর: চরম আবহাওয়ার মাঝেই ডাটা সেন্টার হাব
সিঙ্গাপুর এ সমস্যার একটি বড় উদাহরণ। দেশটিতে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর্দ্রতা প্রায়ই ৮০ শতাংশের বেশি। তবুও এখানে রয়েছে ১.৪ গিগাওয়াটের বেশি ক্ষমতার ডাটা সেন্টার
আরও কয়েকশ মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন ডাটা সেন্টার নির্মাণের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। তবে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে কুলিংয়ের চাহিদা বাড়ছে, যা স্থানীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
এআই ডাটা সেন্টার ও ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ চাহিদা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডাটা সেন্টারগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ডাটা সেন্টারে বিদ্যুৎ ব্যবহার ১৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, শুধু গত বছরেই ডাটা সেন্টারগুলো ব্যবহার করেছে প্রায় ৪১৫ টেরাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ, যা বৈশ্বিক মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ১.৫ শতাংশ।
কেন আবহাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না?
ডাটা সেন্টারের অবস্থান নির্ধারণে সাধারণত যেসব বিষয় বেশি গুরুত্ব পায়, সেগুলো হলো-
>>বিদ্যুতের প্রাপ্যতা ও দাম
>>পানির সহজলভ্যতা
>>জমির খরচ
>>সরকারি প্রণোদনা ও নীতিমালা
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বিষয় প্রায়ই আবহাওয়া বা তাপমাত্রার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত দক্ষতা উপেক্ষিত থেকে যায়।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
এএসএইচআরইর পূর্বাভাস বলছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের বড় ডাটা সেন্টারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এমন এলাকায় অবস্থিত হবে, যেখানে তাপমাত্রা অত্যধিক বেশি।
সিঙ্গাপুর, নাইজেরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে ইতোমধ্যে সব কার্যকর ডাটা সেন্টারই ২৭ ডিগ্রির ওপরের তাপমাত্রার অঞ্চলে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, বর্তমান ডাটা সেন্টার সম্প্রসারণ কার্যক্রমে স্বল্পমেয়াদি চাহিদা ও নিয়ম মানার দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ও জ্বালানি দক্ষতার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকছে।
ডিজিটাল ভবিষ্যৎ টেকসই করতে হলে ডাটা সেন্টার পরিকল্পনায় আবহাওয়া, শক্তি দক্ষতা ও পরিবেশগত প্রভাবকে আরও গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। সূত্র: টেক রাডার