সাহিত্য কি প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নিজস্ব স্বর হারাতে বসেছে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি লেখকের জায়গা দখল করে নিচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো ফের আলোচনায় এসেছে লেনা ম্যাকডোনাল্ড নামের এক জনপ্রিয় লেখিকার ঘটনা ঘিরে।
তাঁর সদ্য প্রকাশিত ফ্যান্টাসি-রোমান্স বই ‘ডার্কহলো অ্যাকাডেমি: ইয়ার ২’–এ এআই-জেনারেটেড একটি প্রম্পট অনিচ্ছাকৃতভাবে ছাপা পড়ে যায়। পাঠকেরা মুহূর্তেই বিষয়টি ধরে ফেলেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় সমালোচনার ঝড়।
কী ছিল সেই বিতর্কিত অংশ?বইটির তৃতীয় অধ্যায়ে লেখিকা লেখেন, “আমি এই অংশ নতুন করে লিখেছি, যাতে জে. ব্রি-র লেখার ধরনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়-যেখানে থাকবে আরও টান টান উত্তেজনা, রুক্ষ আবহ এবং অতিপ্রাকৃত উপাদানের নিচে লুকিয়ে থাকা গভীর আবেগের প্রকাশ।”
এই বাক্য থেকেই পাঠকেরা আঁচ করেন যে এটি একটি এআই প্রম্পটের অংশ, যা হয়তো সম্পাদনার সময় বইতে থেকে গেছে। উল্লেখ্য, জে. ব্রি একজন খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক লেখিকা, যাঁর লেখা ফ্যান্টাসি-রোমান্স ধারায় ব্যাপক জনপ্রিয়। তাঁর শৈলীতে লেখার চেষ্টা করতে গিয়েই, ম্যাকডোনাল্ড এআইয়ের সাহায্য নেন।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া: ‘এটা লেখারই অপমান’বইয়ের বিতর্কিত অংশ আমাজন থেকে সরিয়ে আপডেট করা হলেও স্ক্রিনশট ইতিমধ্যেই ভাইরাল। পাঠকদের প্রতিক্রিয়া এসেছে ক্ষুব্ধ ও হতাশায় ভরা:
“এটা আমার কাছে একেবারে ব্যানযোগ্য অপরাধ।”
“নিজেই যদি না লিখে থাকেন, তবে বই লেখার মানে কী?”
“লেখার আনন্দটাই তো তো লেখকের আত্মা!”
আরেকজন পাঠক বললেন, ‘এটা একমাত্র ঘটনা নয়। এখন অনেক বইয়ে মাঝপথে লেখার ধরন হঠাৎ বদলে যাচ্ছে, যা থেকে বোঝা যায় অনেক লেখক চুপিচুপি এআই ব্যবহার করছেন।’
শুধু সাহিত্যেই নয়, আদালতেও চলছে এআই বিতর্কএই ঘটনাটি আলাদা নয়। লেখালেখির বাইরেও, পেশাদার জগতে এআই ব্যবহারের সীমা ও দায়বদ্ধতা নিয়েও চলছে বিতর্ক। সম্প্রতি মার্কিন ব্যবসায়ী মাইক লিন্ডেল-এর এক মানহানির মামলায়, তাঁর আইনজীবীরা এআই ব্যবহার করে আদালতে এমন এক দলিল জমা দেন, যেখানে ছিল ভুল এবং ভুয়া সাইটেশন। বিচারক নিনা ওয়াং জানান, ৩০টির মতো ভুল রেফারেন্স ছিল সেখানে-কিছু ছিল সম্পূর্ণ কাল্পনিক মামলা। এ কারণে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এআই বনাম সৃষ্টিশীলতা: কোথায় সীমারেখা?লেনা ম্যাকডোনাল্ডের ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়-প্রযুক্তি সহায়ক হতে পারে, তবে সৃষ্টিশীলতার বিকল্প নয়। পাঠকেরা প্রযুক্তির ব্যবহারে আপত্তি করছেন না, বরং আপত্তি করছেন স্বচ্ছতার অভাব ও লেখকের আত্মিক অনুপস্থিতিতে। সাহিত্য বরাবরই ছিল একজন মানুষের চিন্তা, অনুভূতি আর কল্পনার প্রতিফলন। তাই অনেকেই মনে করছেন, লেখক যদি নিজের লেখাকে এআইয়ের হাতে ছেড়ে দেন, তাহলে পাঠকের সঙ্গে তাঁর সংযোগটাই হারিয়ে যায়।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এআই এখন বাস্তবতা এবং এর ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু লেখার জগতে এআই আসার সঙ্গে সঙ্গে দরকার নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও সততার প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া। নাহলে পাঠক শুধু বই নয়, হারাবেন লেখকের প্রতি আস্থা-আর সাহিত্য হারাবে তার আত্মা। সূত্র: ম্যানুস্ক্রিপ্ট রিপোর্ট ডট কম