কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির উত্থানে গোটা প্রযুক্তি বিশ্ব যেন নতুন এক দিগন্তে প্রবেশ করেছে। মাইক্রোসফট, গুগল, মেটা, ওপেনএআই- এসব প্রতিষ্ঠানের দাপুটে উপস্থিতিতে এআই দুনিয়ায় নজর কেড়েছে নতুন নতুন উদ্ভাবন। অথচ এই প্রতিযোগিতার শুরুতে চুপচাপ থেকেছে টেক জায়ান্ট অ্যাপল। তবে এখন সেই নীরবতা ভেঙে জোর কদমে পা ফেলতে যাচ্ছে আইফোন ও ম্যাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।
চ্যাটজিপিটিকে টেক্কা দিতে ‘অ্যানসার ইঞ্জিন’
অ্যাপলের অভ্যন্তরীণ সূত্র ও প্রখ্যাত অ্যাপল বিশ্লেষক মার্ক গুরম্যানের মতে, প্রতিষ্ঠানটি এখন নিজস্ব একটি এআই চ্যাটবট তৈরির কাজ করছে, যার নাম হতে পারে ‘অ্যানসার ইঞ্জিন’। এটি হবে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যা ইন্টারনেট থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যবহারকারীর প্রশ্নের বাস্তবভিত্তিক ও প্রাসঙ্গিক উত্তর দিতে সক্ষম হবে,ঠিক যেমনটি করে ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি বা গুগলের বার্ড (বর্তমানে জেমিনি)।
এই নতুন চ্যাটবট আলাদা একটি অ্যাপ হিসেবেও আসতে পারে, আবার অ্যাপলের বিদ্যমান সেবা যেমন, সিরি, সাফারি ও অন্যান্য অ্যাপে সার্চ ও ইন্টারঅ্যাকশনের অভিজ্ঞতা বাড়াতেও ব্যবহৃত হতে পারে। অর্থাৎ অ্যাপল এই প্ল্যাটফর্মকে শুধুমাত্র একক একটি টুল হিসেবেই নয়, বরং সমগ্র ইকোসিস্টেমে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে।
‘অ্যানসার, নলেজ অ্যান্ড ইনফারমেশন’ অ্যাপলের গোপন এআই টিম
চ্যাটবটটির উন্নয়নে কাজ করছে অ্যাপলের অভ্যন্তরে গঠিত একটি বিশেষ টিম, যার নাম ‘অ্যানসার, নলেজ অ্যান্ড ইনফারমেশন’ । ধারণা করা হচ্ছে, এই টিমটি একদিকে যেমন প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজে ব্যস্ত, অন্যদিকে এই উদ্যোগ সফল করতে নতুন করে কর্মী নিয়োগও চলছে।
এই উদ্যোগ মূলত অ্যাপলের এআই খাতে পুনরুত্থানের এক অংশ। কারণ ২০২৪ সালে ‘অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স’ নামে তাদের নিজস্ব এআই সিস্টেম চালু করলেও তা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। টেক্সট সারাংশ বা কিছু অতি সাধারণ ফিচারের বাইরে সে প্ল্যাটফর্ম তেমন কার্যকর কিছু দেখাতে পারেনি। যার ফলে অনেক প্রযুক্তিপ্রেমী ও বিশ্লেষকই হতাশ হন।
প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া এবং গবেষক হারানো
অ্যাপলের এআই যাত্রা শুরু হলেও তা ছিল অনেকটাই ধীরগতির। এরই মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি অ্যাপলের অন্তত চারজন শীর্ষ এআই গবেষক মেটার ‘সুপার ইন্টেলিজেন্সe’ বিভাগে যোগ দিয়েছেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন অ্যাপলের এআই বিভাগের প্রধান রুয়োমিং প্যাং।
এই ঘটনা অনেকের কাছেই ছিল একটি বড় ধাক্কা। প্রযুক্তি খাতে ট্যালেন্ট রিটেনশন যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, অ্যাপল সেটি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
‘পারপ্লেক্সিটি’ অধিগ্রহণের সম্ভাবনা
বাজারজুড়ে গুঞ্জন উঠেছে, অ্যাপল তাদের দীর্ঘদিনের ডিজিটাল সহকারী সিরি-কে নতুন রূপ দিতে চাইছে। আর সেটির জন্য সম্ভাব্য পদক্ষেপ হিসেবে তারা এআই সার্চ স্টার্টআপ ‘পারপ্লেক্সিটি’ অধিগ্রহণ করতে পারে বলে অনেক বিনিয়োগকারী প্রত্যাশা করছেন।
পারপ্লেক্সিটি হলো একটি দ্রুতবর্ধনশীল এআই স্টার্টআপ, যারা চ্যাটবটের মাধ্যমে তথ্যভিত্তিক উত্তর দেওয়ার নতুন এক ধারা তৈরি করেছে। সিরি-কে যদি পারপ্লেক্সিটির ইঞ্জিনের ওপর ভিত্তি করে পুনর্গঠন করা হয়, তবে সেটি অ্যাপলের জন্য হতে পারে এআই দুনিয়ায় এক বড় পুনরাগমন।
টিম কুকের সংকেত: প্রস্তুত অ্যাপল
অ্যাপল সিইও টিম কুক সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে তারা যে-কোনো সম্ভাবনাময় কোম্পানি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তুত। এটা শুধু পারপ্লেক্সিটি নয়, বরং অন্যান্য উদীয়মান এআই উদ্যোগগুলোকেও ইঙ্গিত করতে পারে।
এআই দুনিয়ায় অ্যাপলের পদক্ষেপ অনেকটা দেরিতে হলেও এখন তারা যে এক নতুন গতি ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফিরছে, তা স্পষ্ট। ‘অ্যানসার ইঞ্জিন’-এর মতো একটি প্ল্যাটফর্ম, সিরি-এর পুনর্গঠন পরিকল্পনা, এবং সম্ভাব্য স্টার্টআপ অধিগ্রহণ, সবমিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, অ্যাপল আর পিছিয়ে থাকতে চায় না। তবে সময়ই বলে দেবে, এই নতুন উদ্যোগগুলো অ্যাপলকে আবারও এআই দুনিয়ার নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারবে কিনা। এ মুহূর্তে তারা শুধু প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু খেলা এখনো শুরু হয়নি। সূত্র: টেকরাডার, টেকক্রাঞ্চ, ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেস ও ব্লুমবার্গ