যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ২৮ পৃষ্ঠার একটি বিস্তৃত ‘এআই অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রকাশ করে তারা জানিয়েছে- এআই প্রযুক্তির বিকাশে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বে থাকতে চায় এবং এজন্য উদ্ভাবনকে উৎসাহ, আদর্শিক পক্ষপাতমুক্ত নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চীনকে টপকে যাওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য।
পরিকল্পনার মূল দিকগুলো কী?
এই অ্যাকশন প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৯০টিরও বেশি নীতিগত কর্মপরিকল্পনা, যেগুলো আগামী এক বছরে বাস্তবায়নযোগ্য বলে দাবি করেছে হোয়াইট হাউস। এর মধ্যে রয়েছে:
>> সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য রক্ষণশীল নীতিমালা পর্যালোচনা ও বাতিলের সুপারিশ
>> এআই উন্নয়নে দপ্তরীয় জটিলতা ও ‘ওয়োক’ পক্ষপাত দূর করার পদক্ষেপ
>> সরকারি ও বেসরকারি খাতে এআই ব্যবহারে উৎসাহ
>> এআই রপ্তানি সহজীকরণ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি প্রযুক্তি বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দেওয়া
প্রশাসনের অবস্থান ও যুক্তি
ডেভিড স্যাকস, ট্রাম্প প্রশাসনের ক্রিপ্টো ও প্রযুক্তি-বিষয়ক মুখপাত্র, সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, আমরা এআই দৌড়ে আছি এবং এই দৌড়ে আমরাই বিজয়ী হব।”
ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, এই উদ্যোগ উদ্ভাবনের গতি বাড়াবে, বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বজায় রাখবে, এবং জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করবে।
তারা মনে করছে, ‘অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ’, ‘নৈতিক পক্ষপাত’, এবং ‘ফেডারেল প্রক্রিয়ার জটিলতা’- এই তিনটি বড় বাধা এখন এআই প্রযুক্তির প্রসারে প্রধান অন্তরায়।
সমালোচনার ঝড়: করপোরেট ফেভারিজম?
সমালোচকদের মতে, এই পরিকল্পনা বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সুবিধার কথা মাথায় রেখে তৈরি।
সারা মায়ারস ওয়েস্ট, এআই নাউ ইনস্টিটিউটের সহনির্বাহী পরিচালক বলেন, “এই পরিকল্পনা প্রযুক্তি ধনকুবেরদের দ্বারা এবং তাদের জন্য তৈরি। এটি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বা অধিকারকে গুরুত্ব দেয় না।”
বাইডেন প্রশাসনের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, “ট্রাম্প এই পরিকল্পনার মাধ্যমে বাইডেনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকেন্দ্রিক নির্দেশনাগুলো বাতিল করেছেন, যা এআইকে দায়িত্বশীল পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করত।”
নিরাপত্তা ও রপ্তানি নিয়ে বিতর্ক
বাইডেন প্রশাসন যেখানে চীনের প্রতি উচ্চমানের এআই চিপ রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছিল, ট্রাম্প প্রশাসন তা তুলে নিয়েছে।
গত মাসে ট্রাম্প এনভিডিয়াকে চীনে তাদের উন্নতমানের এইচ২০ চিপ রপ্তানির অনুমতি দেন, যা পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞার বিপরীত।
জিম সিক্রেটো, বাইডেন প্রশাসনের সাবেক উপ-প্রধান বলেন, “এই সিদ্ধান্ত চীনের প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়াবে এবং মার্কিন নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।”
আদর্শিক পক্ষপাত দূর করার লক্ষ্য?
ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী, তারা চায় ‘ওয়োক’ এআই বা আদর্শিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট অ্যালগরিদম নির্মূল করতে।
এক্ষেত্রে প্রশাসনের ভাষ্য হলো, এআই যেন কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শনের ধারক না হয়, বরং নিরপেক্ষ ও বাস্তব-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়।
জনমত ভিত্তিক নীতিমালা?
হোয়াইট হাউস জানায়, তাদের এই নতুন এআই পরিকল্পনা ১০ হাজারের বেশি জনমতের ভিত্তিতে তৈরি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে তারা আরও জনমত গ্রহণ এবং খোলামেলা পর্যালোচনার মাধ্যমে নীতিমালা পরিমার্জন করতে প্রস্তুত।
নতুন নেতৃত্ব না পুরোনো বিতর্ক?
ট্রাম্প প্রশাসনের ‘এআই অ্যাকশন প্ল্যান’ নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে। তবে এটি যে বিতর্ক ও দ্বিধার পথ খুলে দিয়েছে, তা স্পষ্ট।
একদিকে প্রশাসন উদ্ভাবনের কথা বলছে, অন্যদিকে সমালোচকরা বলছেন এটি নিয়ন্ত্রণহীন উদারতার দিকে একটি বিপজ্জনক পদক্ষেপ, যা বড় করপোরেশনকে আরও ক্ষমতাধর করে তুলবে এবং সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব ফেলবে। এখন দেখার বিষয়-এই পরিকল্পনা সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের চেয়ে এগিয়ে রাখতে পারে কিনা, নাকি এটি আরও বৃহৎ নীতিগত ও নৈতিক বিতর্কের জন্ম দেবে। সূত্র: বিবিসি