সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা এখন আর শুধু উদ্ভাবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রতিভা দখলের এক অদৃশ্য যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এআই-ভিত্তিক প্রযুক্তির পরবর্তী প্রজন্ম তৈরির প্রতিযোগিতায় কে এগিয়ে থাকবে, সেটি অনেকাংশেই নির্ধারিত হচ্ছে কে সবচেয়ে প্রতিভাবান গবেষক ও প্রকৌশলীদের নিজেদের দলে টানতে পারছে তার ওপর।
এই প্রেক্ষাপটে মার্ক জাকারবার্গ একটি ব্যতিক্রমী চেষ্টা করেন। তিনি ওপেনএআইয়ের সাবেক প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) মিরা মুরাতিকে ১ বিলিয়ন ডলারের চাকরির প্রস্তাব দেন। কিন্তু এত বড় প্রস্তাব দেওয়ার পরও তিনি মিরাকে নিজের দলে টানতে পারেননি।
মিরা মুরাতির পথচলা: ওপেনএআই থেকে স্টার্টআপের নেতৃত্বে
মিরা মুরাতি ওপেনএআইয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (এজিআই) উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে ২০২4 সালে প্রতিষ্ঠানটি থেকে পদত্যাগ করে তিনি সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক নিজস্ব এআই স্টার্টআপ থিংকিং মেশিনস ল্যাব গড়ে তোলেন। তাঁর সঙ্গে এই উদ্যোগে যুক্ত হন ওপেনএআই, মেটা, মিস্ট্রালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ গবেষক ও ইঞ্জিনিয়াররা।
প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই স্টার্টআপটি প্রযুক্তি জগতে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তন, জটিল রোগের নিরাময় এবং সামাজিক বৈষম্য মোকাবিলায় সক্ষম এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে পারে। ফলে মাত্র ক’মাসের মধ্যেই এর মূল্যায়ন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার।
মেটার পরিকল্পনা ও জাকারবার্গের প্রস্তাব
মেটার লক্ষ্য ছিল-মিরা মুরাতি ও তাঁর সহকর্মীদের নিজেদের এআই প্রকল্পে যুক্ত করা। জাকারবার্গের দৃষ্টিতে, থিংকিং মেশিনস ল্যাবের গবেষকরা একেবারেই শীর্ষ সারির প্রতিভা। তাই প্রতিষ্ঠানটির ৫০ জনের মধ্যে অন্তত ১২ জনকে মোটা অঙ্কের প্রস্তাব দিয়ে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। এমনকি শুধু মিরাকেই নয়, আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান গবেষক অ্যান্ড্রু টুলকসহ কয়েকজনকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেতনের প্রলোভন দেখানো হয়।
কিন্তু কেন প্রত্যাখ্যান?
এখানেই আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-এই বিশাল আর্থিক প্রস্তাব কেন প্রত্যাখ্যান করলেন মিরা ও তাঁর টিম?
এর উত্তর নিহিত তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধে। মিরা ও তাঁর সহকর্মীরা মনে করেন, তারা যেই গবেষণা করছেন, সেটি কেবল বিজ্ঞাপন ব্যবসার উন্নয়নে ব্যবহৃত হলে তা তাদের লক্ষ্য ও নৈতিকতার পরিপন্থী হবে। মেটার মতো বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান গবেষণাকে নিজের বাণিজ্যিক লাভের হাতিয়ার বানাতে পারে-এই আশঙ্কাই মূলত তাঁদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে।
তাঁরা আরও বিশ্বাস করেন, আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স (এজিআই)-এর উন্নয়নে থিংকিং মেশিনস ল্যাব ও ওপেনএআই সবচেয়ে এগিয়ে। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে দরকার একধরনের অহংমুক্ত, সমতাভিত্তিক ও সহযোগিতাপূর্ণ গবেষণা পরিবেশ-যেটা তাঁরা নিজস্ব স্টার্টআপে তৈরি করতে পেরেছেন।
মিরা মুরাতির নেতৃত্ব ও সংস্কৃতি
মিরার নেতৃত্বে থিংকিং মেশিনস ল্যাবের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো প্রতিষ্ঠান সংস্কৃতি। এখানে কর্মীরা “মেম্বার অব টেকনিক্যাল স্টাফ” পরিচয়ে তালিকাভুক্ত হন, অর্থাৎ কেউ সিনিয়র বা জুনিয়র নয়-সবার ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই অহংকারহীন ও সৃজনশীল পরিবেশ গবেষকদের আরও স্বাধীনভাবে নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। স্টার্টআপটির গবেষকরা কেবল বেতন নয়, বরং লক্ষ্য, নেতৃত্ব, এবং গবেষণার স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দেন।
টাকার চেয়ে আদর্শের কাছে অনুগত
সিলিকন ভ্যালিতে ৯ অঙ্কের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা প্রায় নজিরবিহীন ঘটনা। কিন্তু মিরা ও তাঁর দল দেখিয়ে দিয়েছেন যে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে নৈতিকতা ও আদর্শকে মিলিয়ে চলা সম্ভব। তাঁদের জন্য কোন কোম্পানি কত টাকা দিচ্ছে সেটি নয়, বরং কেন এবং কীভাবে কাজটি করছেন, এই দৃষ্টিভঙ্গিই গুরুত্বপূর্ণ।
থিংকিং মেশিনস ল্যাব: সম্ভাবনার বাতিঘর
যদিও প্রতিষ্ঠানটি এখনো কোনো পণ্য বাজারে আনেনি, তবুও এর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েই চলেছে। এর পেছনে রয়েছে এনভিডিয়া, এএমডি, সিসকো, সার্ভিস নাও, এমনকি আলবেনিয়ান সরকার।এর মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সমর্থন। তাঁদের উদ্দেশ্য একটি এমন এআই তৈরি করা, যেটি সাধারণ মানুষও সহজে ব্যবহার করতে পারবে এবং বাস্তব জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মিরা মুরাতি ও তাঁর দলের সিদ্ধান্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তি শুধু আর্থিক সাফল্যের নয়, বরং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, নেতৃত্ব এবং মানবকল্যাণের বিষয়ও বটে। মার্ক জাকারবার্গের ১ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা প্রমাণ করেছেন আদর্শের প্রতি আনুগত্যই প্রযুক্তির ভবিষ্যত গড়ে দিতে পারে। সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টুডেু