আগামী এক দশকে ছয় লাখের বেশি মানবকর্মী প্রতিস্থাপন করতে পারে রোবট। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের গোপন নথির তথ্য অস্বীকার করলেও বাস্তবতা বলছে, অটোমেশনই আমাজনের ভবিষ্যৎ।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নিয়োগদাতা এখন রোবটনির্ভর পথে
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন খুচরা বিক্রেতা আমাজন এখন রোবোটিক অটোমেশনের নতুন যুগে প্রবেশ করছে। কর্মী নিয়োগের দিক থেকে ওয়ালমার্টের পর যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানটি এবার তাদের বিশাল কর্মীবাহিনীর একটি বড় অংশ রোবট দ্বারা প্রতিস্থাপনের পথে হাঁটছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর গোপন নথি উদ্ধৃত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাজনের অটোমেশন টিম আগামী এক দশকের মধ্যে ছয় লাখের বেশি নতুন কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন এড়াতে পারে-কারণ সেই কাজগুলো করবে রোবট।
রোবট দিয়ে কীভাবে কমবে নিয়োগের প্রয়োজন
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল ২০২৭ সালেই আমাজনকে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে হতো। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উন্নত রোবোটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই বিশাল সংখ্যক মানবকর্মীর প্রয়োজন হবে না। এমনকি ২০৩৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মীর সংখ্যা না বাড়িয়েই প্রতিষ্ঠানটি বিক্রয় দ্বিগুণ করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আমাজন বলছে তথ্য বিভ্রান্তিকর
এই তথ্য অবশ্য আমাজন কর্তৃপক্ষ সরাসরি অস্বীকার করেছে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্টে পাঠানো এক বিবৃতিতে আমাজনের মুখপাত্র কেলি ন্যান্টেল বলেন, “ফাঁস হওয়া নথিগুলো অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। এটি কেবল একটি অভ্যন্তরীণ দলের প্রাথমিক বিশ্লেষণ, যা কোম্পানির সামগ্রিক নিয়োগনীতির প্রতিফলন নয়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “গত দশকে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেছে আমাজনই। কেবল চলতি ছুটির মৌসুমেই আমরা ২ লাখ ৫০ হাজার নতুন পদে নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছি।”
রোবোটিক প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে আমাজন
বিশ্লেষকদের মতে, আমাজনের এই অটোমেশন পরিকল্পনা মোটেও আশ্চর্যের কিছু নয়। গত কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি তাদের গুদাম ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে ক্রমশ রোবটনির্ভর করছে।
বর্তমানে আমাজনের ফুলফিলমেন্ট নেটওয়ার্কে প্রায় ১৫ লাখ ৬০ হাজার মানবকর্মীর বিপরীতে ১০ লাখেরও বেশি রোবট কাজ করছে। এই রোবটগুলোই এখন প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ডেলিভারির কাজ সম্পন্ন করছে।
গুদাম ব্যবস্থাপনা এখন রোবটের হাতে
অটোমেশন ব্যবস্থার ফলে শুধু প্যাকেজ বাছাই বা পণ্য সরবরাহ নয়, মজুত ব্যবস্থাপনা, বাছাই ও মোড়কীকরণের ক্ষেত্রেও রোবট ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ছে।
নথি অনুযায়ী, নতুন গুদামগুলো এমনভাবে নকশা করা হচ্ছে যাতে ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা যায়। অর্থাৎ ভবিষ্যতের আমাজন গুদাম হবে প্রায় মানবশূন্য।
বিতর্ক: কর্মীদের ওপর চাপ ও চাকরি হারানোর আশঙ্কা
এই প্রযুক্তিগত রূপান্তরের সঙ্গে কিছু বিতর্কও জড়িত। শ্রমিকদের অভিযোগ, রোবটের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে কর্মীরা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ছেন। অন্যদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘রোবট ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা বাড়লেও মানবকর্মীর ওপর নির্ভরতা কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে চাকরি হ্রাসের বড় কারণ হতে পারে।’
আমাজনের দাবি: নিরাপত্তা বেড়েছে, পরিশ্রম কমেছে
আমাজনের মতে, রোবট ব্যবহারে কর্মীদের শারীরিক পরিশ্রম কমেছে এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ‘অটোমেশন আমাদের কর্মীদের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করছে।’
তবে একই সূত্রে দেখা যায়, গত ১৬ বছরের মধ্যে এখন একটি সাধারণ আমাজন গুদামে সবচেয়ে কম সংখ্যক কর্মী কাজ করছে মাত্র ৬৭০ জন।
ভবিষ্যতের খুচরা বাণিজ্যে আমাজন মডেল
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোবট ব্যবহারের এই ধারাটি খুচরা বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। আমাজনের সফল মডেল ইতিমধ্যে ওয়ালমার্টসহ অন্যান্য বড় কোম্পানিকেও অনুপ্রাণিত করছে। উন্নতমানের রোবোটিক প্রযুক্তি যত সহজলভ্য হবে, ততই এই প্রবণতা বাড়বে, যার ফলে আগামী দশকে বাণিজ্য খাতের কাঠামোই পাল্টে যেতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: দক্ষতা বাড়লেও কর্মসংস্থানের সংকট
প্রযুক্তি ও অর্থনীতিবিদদের মতে, রোবটের মাধ্যমে শ্রম ব্যয় কমানো এবং কর্মদক্ষতা বাড়ানো-এই দুই লক্ষ্যেই অটোমেশনের বিস্তার ঘটছে। তবে এর সামাজিক প্রভাবও গভীর। যদি ছয় লাখের বেশি কর্মসংস্থান অটোমেশনের কারণে হ্রাস পায়, তবে এর অভিঘাত কেবল আমাজনের ভেতরে নয়, বরং পুরো যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে পড়বে। সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স, দ্য ইনডিপেনডেন্ট।