যুদ্ধবিধ্বস্ত লেবাননে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ‘বিকল্প থেরাপি’ হয়ে উঠছে এআই চ্যাটবট

প্রকাশ: মঙ্গলবার, ০৫ অগাস্ট, ২০২৫
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png টেকভয়েস২৪  ডেস্ক
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ লেবাননের সীমান্তবর্তী একটি গ্রামের নাম জয়নাব দাহের। ইসরায়েলি হামলার মুখে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাতারাতি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। গোলাবর্ষণ এতটাই তীব্র ছিল যে সময়ের অভাবে সঙ্গে নিতে পারেননি প্রিয় জিনিসপত্র, স্মৃতিচিহ্ন কিংবা আশ্বাস। কেবল প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বৈরুতের উদ্দেশে যাত্রা।

১৩ ঘণ্টার ক্লান্তিকর ও আতঙ্কভরা পথ। কিন্তু বৈরুতে এসেও স্বস্তি মেলেনি। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসলেও আতঙ্ক রয়ে গেছে। গোলাগুলির শব্দ, ভবনের ধ্বংসস্তূপ, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার। সব মিলে বাস্তবতা এখনো ভয়াবহ।

যুদ্ধ মানেই শুধু শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি নয়, মানসিক বিপর্যয়ও
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, সংঘাতপীড়িত অঞ্চলে প্রতি পাঁচজনের একজন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভোগেন। কেউ হালকা বিষণ্নতায়, কেউ তীব্র উদ্বেগে, কেউ আবার জর্জরিত হন পিটিএসডি বা ট্রমা-পরবর্তী মানসিক বিপর্যয়ে। লেবাননের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই হার আরও বেশি বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিছু বাস্তবচিত্র 
প্রায় ৯০ হাজার মানুষ এখনো নিজ গ্রামে ফিরতে পারেননি। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা, ঘুমের সমস্যা, প্যানিক অ্যাটাক প্রভৃতি বাড়ছে। প্রতিটি মানসিক থেরাপি সেশনের মূল্য ৪০ থেকে ১০০ ডলার। এতে সাধারণ মানুষের পক্ষে মানসিক সেবা নেওয়া কার্যত অসম্ভব।

 এআই চ্যাটবট: মুক্তির পথ, না ভুল আশ্রয়?
জয়নাব দাহের ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে মানসিক কথোপকথনে জড়ান। তাঁর কথায়, “এটা অন্তত শুনছিল... আমি যা বলতে চাই, সবই বলতে পারছিলাম।” চ্যাটজিপিটি তাকে পিটিএসডি, এডিএইচডি ও স্কিৎজোফ্রেনিয়ার সম্ভাবনা দেখায়। কিন্তু চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় তিনি এই বটের কাছেই আত্মিক আশ্রয় খুঁজে ফেরেন।

২২ বছর বয়সী সারাহ রাম্মালের গল্পও এমনই। ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিজের বাড়ি ও ব্যবসা হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। রাতে নিঃসঙ্গতায় চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বলতেন, ব্যথা লাঘবের আশায়। কিন্তু পরে উপলব্ধি করেন, এটি কেবল ব্যথার বৃত্তেই আটকে রেখেছে তাকে। শেষ পর্যন্ত একজন পেশাদার থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হয়ে সামান্য মুক্তির অনুভূতি পান।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চ্যাটজিপিটি বা অন্য এআই টুল মানুষের মতো সহানুভূতি বা মানসিক অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে না। অনেক সময় ভুল রোগনির্ণয় ও আত্মপ্রবঞ্চনার আশঙ্কা থাকে। এটি চিকিৎসা গ্রহণে বিলম্ব ঘটাতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, “চ্যাটজিপিটি মানসিক পুনর্বাসনের স্থায়ী পথ হতে পারে না।এটি কেবল এক প্রকার ভার্চুয়াল বিরামচিহ্ন মাত্র।”

 বিকল্পভাবে প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, ‘স্টেপ বাই স্টেপ’ অ্যাপ
পরিস্থিতি মোকাবিলায় লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এমব্রেস সংস্থা যৌথভাবে চালু করেছে ‘Step-by-Step’ নামের একটি অ্যাপ। এটি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের সহায়তায় তৈরি, যাতে ব্যবহারকারী ধাপে ধাপে নিজের মানসিক অবস্থা মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারেন। এই অ্যাপটি একটি আশার আলো হতে পারে। বিশেষ করে তাঁদের জন্য, যাঁদের পক্ষে থেরাপি সেশন নেওয়া অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব নয়।

প্রযুক্তি সমাধান নয়, সহায়ক মাত্র
লেবাননের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে মানুষের মানসিক পুনর্বাসনের দায়িত্ব শুধু চ্যাটবটের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের অবিচার। প্রযুক্তি হতে পারে সহায়ক, কিন্তু সেটি চিকিৎসা নয়। আমরা যেন ভুলে না যাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা মানুষ কেবল খাবার বা বাসস্থান চায় না, তারা চায় শ্রবণযোগ্যতা, সহানুভূতি, ও নিরাময়ের সুযোগ। সেটি দিতে পারে একজন মানুষই আর তা কোনো রোবট নয়। সূত্র:  টেকক্রাঞ্চ, এমব্রেচ ল্যাবানন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আল জাজিরা

 

image

আপনার মতামত দিন