জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)-এর উদ্যোগে এবং জার্মান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (জিআইজেড)-এর কারিগরী সহায়তায় রাজধানীর হোটেল রেডিসন ব্লুতে চলছে দুই দিনব্যাপী ‘হারআইজন ফেস্ট ২০২৫: সেলেব্রেটিং ওমেন, স্কিলস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট’।
নানা আয়োজনে অনুষ্ঠনে নারীর ক্ষমতায়নকে দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে উদ্যাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের দক্ষতা উন্নয়নে নারীবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আলোচনা, কর্মশালা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে নারী নেতৃত্ব, দক্ষতা উন্নয়ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানের সুযোগ তুলে ধরা হয়েছে।
সোমাবার (৬ সেপ্টেম্বর) উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নারী ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দক্ষতা উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতা উন্নয়নে টেকনিক্যাল স্কুলগুলোর নারীকেন্দ্রিক উন্নয়নের পরামর্শ দেন বক্তারা।
প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত (উপদেষ্টা পদমর্যাদা) লুৎফে সিদ্দিকী।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব মো. সাইফুল্লাহ পান্না এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি অনুবিভাগ) শোয়াইব আহমাদ খান। গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত ড. রুডিগার লোটজ। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এনএসডিএ-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান (সচিব) ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
হারআইজন ফেস্টের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন তারা শুধু প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানে নয়, নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতে দেশের অর্থনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন, যা সামাজিক পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
উপদেষ্টা বলেন, দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি নারীর নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নেতৃত্ব বিকাশ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি বিদেশগামী নারী শ্রমিকদের জন্য ভাষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ জোরদারের আহ্বান জানান, যাতে তারা সুরক্ষা ও মর্যাদার সঙ্গে কাজ করতে পারেন। উপদেষ্টা আরও বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন কেবল নীতিতে নয়, বাস্তব নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতে হবে।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় নারীরা কেবল অংশগ্রহণকারী নয়, বরং অন্যতম চালিকাশক্তি। তিনি উল্লেখ করেন, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সরকার, বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সহযোগীদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এনএসডিএ’র উদ্যোগ নারীদের জন্য আরও ফ্লেক্সিবল ও সহায়ক শেখার পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যা সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সহায়ক হবে। তিনি নারীর ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দক্ষতা উন্নয়নের এই আয়োজনের সকল অংশীদারকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি মো. সাইফুল্লাহ পান্না তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, এনএসডিএ দেশের কর্মসংস্থান ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং এটি পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করলে বেকারত্বের বড় অংশ সমাধান সম্ভব।
তিনি বলেন, দেশের শ্রমশক্তির অর্ধেকই নারী, যারা দক্ষ, পরিশ্রমী ও সহিষ্ণু, এবং তাদের সম্পৃক্ততা জিডিপি গ্রোথ, রেমিট্যান্স এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি অনুবিভাগ) শোয়াইব আহমাদ খান বলেন, প্রযুক্তি ও পেশাগত দক্ষতা অর্জনে নারীর অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। তাই কারিগরি ও টেকনিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নারীকেন্দ্রীক উন্নয়ন অপরিহার্য। নারী টেকনিশিয়ানদের সামনের দিকে আনতে পারলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রেমিটেন্স সবই বাড়বে। নারীর শ্রমশক্তি দেশের অর্থনীতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ, তবে এখনও নারী অংশগ্রহণ সীমিত এবং অনানুষ্ঠানিক কাজ ও গৃহস্থলীর দায়িত্বের কারণে বাধাগ্রস্ত।
তিনি নারীকেন্দ্রিক কারিগরি শিক্ষা, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ, ইন্ডাস্ট্রি-রেডি প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক মানসিকতা পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
জার্মানির রাষ্ট্রদূত ড. রুডিগার লোটজ তার বক্তব্যে বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন শুধুমাত্র নারীর নয়, সকলের এবং এটি সফল হবে শুধুমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
তিনি বলেন, নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশে নারীরা তাদের প্রতিভা প্রকাশ করতে পারলে সমগ্র সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমে জার্মানির সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আশ্বাস জানান।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও এনএসডিএ-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, সম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তিতেও অবদান রেখে চলছে নারীরা। কিন্তু শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমাদের যাপিত জীবন ধারায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রভাব অনুভব করতে পারছি। শেখার পদ্ধতি, কাজের ধারাসহ সকল ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন আসছে। তাই অন্তর্ভূক্তিমূলক ও অভিন্ন প্রশিক্ষণ মানন্ড প্রণয়ণের মাধ্যমে চাহিদা ভিত্তিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ আরো প্রসারিত করা হচ্ছে।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০২২-এর আলোকে এনএসডিএ নারী, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাজারমুখী দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে। এ সম্মেলনের মাধ্যমে নারীর জন্য চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ, প্রতিবন্ধী নারী ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সুযোগ সৃষ্টি এবং ভবিষ্যতের শ্রমবাজার যেমন ডিজিটাল অর্থনীতি, সবুজ শিল্প, কেয়ার ইকোনমি ও সৃজনশীল খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির রূপরেখা তৈরি হবে। বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে আগত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও ওয়ার্কশপের মাধ্যমে নতুন নীতি ও সুপারিশ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
তিনি বলেন, এই উৎসব নারীর ক্ষমতায়ন ও টেকসই দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি কার্যকরী প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য মিনা মাসুদুজ্জামান বলেন, উন্নয়নে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী সমান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিতেও তারা নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ রাখছে। তবে এখনো আধুনিক প্রযুক্তি, কারিগরি শিক্ষা এবং ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ থেকে অনেক নারী এখনো বঞ্চিত। অবশ্য আশার কথা নারীরা এখন তথ্যপ্রযুক্তি, এআই, গ্রাফিক্স ডিজাইনে দক্ষতা অর্জন করে তারা ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করার সুযোগ করে দিচ্ছে।
অনুষ্ঠানের প্রথম দিনে জেন্ডার-সেন্সিটিভ সক্ষমতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ এবং সুবিধাবঞ্চিতদের সমান সুযোগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ইন্টারঅ্যাকটিভ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যা জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)-এর অন্তর্ভুক্তিমূলক দক্ষতা উন্নয়নের ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানে ৪৫০-এর বেশি অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী, দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদানকারী (এসটিপি) প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, বেসরকারি খাত ও শিল্প দক্ষতা পরিষদের নেতৃবৃন্দ, নারী নেটওয়ার্ক, যুব সমাজের প্রতিনিধি এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ। নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া, জার্মানি এবং ইউনিসেফের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা নারীদের অন্তর্ভুক্তিমূলক কারিগরি শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ দক্ষতা নিয়ে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, যা তরুণ, প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়াতে এনএসডিএ’র কৌশল প্রণয়নে সহায়তা প্রদান করে।