বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিল্প খাতের প্রসারের ফলে নগরায়ণের হারও বেড়েছে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ অনুসারে, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ২ কোটি ৩৯ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা শীর্ষে এবং বিশ্বের সপ্তম জনবহুল শহর। ঢাকার মতো এমন ঘনবসতিপূর্ণ একটি মহানগরে প্রতিদিন হাজারো মানুষ জীবিকার সন্ধানে আসছে, ফলে আবাসনের চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে। ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনাসহ অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর অবস্থাও ঠিক একই রকম।
একই সঙ্গে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জীবনমান উন্নত হওয়ায় আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ফ্ল্যাট ও বাড়ির চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। এ কারণে আবাসন খাত দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিণত হয়েছে, যা অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। তবে এই খাতে যেমন বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা ধরনের কাঠামোগত ও নীতিগত চ্যালেঞ্জ। যা সমাধান না করলে দীর্ঘ মেয়াদে খাতটি স্থবির হয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশে নগর-পরিকল্পনার বড় চ্যালেঞ্জ অপরিকল্পিত শহরায়ণ। ঢাকায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসছে জীবিকার সন্ধানে। কিন্তু পর্যাপ্ত আবাসন ও অবকাঠামো যেমন রাস্তা, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা প্রকল্প বাস্তবায়নকে কঠিন করে তুলছে। অনেক আবাসন প্রকল্পে খেলার মাঠ, খোলা জায়গা ও পরিবেশবান্ধব নকশা নেই, যা বসবাসের মানকে প্রভাবিত করছে।
আবাসন খাতের সমসাময়িক চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে নগরবিদ ও পরিবেশবাদী ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আবাসন খাতে অব্যাহত চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো জমির উচ্চমূল্য। মূলত জমিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বিনিয়োগের ক্ষেত্র বা পণ্যে পরিণত করার ফলেই এই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে একদল অলিগার্কিক ল্যান্ড ডেভেলপারদের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিপরীতে রয়েছে সরকারের ন্যায্য অংশগ্রহণের অভাব।’
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, ‘সবার জন্য সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিতে দরকার সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা। এটিই পুরো আবাসন খাতকে দ্রুত বদলে দিতে পারে। এখন দেশের আবাসনের চাহিদা মেটাতে সরকারি ও বেসরকারি ভূমি উন্নয়ন উদ্যোক্তাদের ন্যায্য অংশীদারত্বের ভিত্তিতে যৌথভাবে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) আবাসন প্রকল্প হাতে নেওয়া জরুরি। এসব প্রকল্পের সঙ্গে শহরের কেন্দ্রকে রেল, সড়ক ও নদীপথে সহজ যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি স্বল্প সুদে গৃহঋণ দেওয়ার মতো উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দৃঢ় সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।’
আবাসন খাতে ক্রেতার চাহিদা ও পছন্দ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। আগে বড় আকারের ফ্ল্যাট জনপ্রিয় ছিল, বর্তমানে মাঝারি ফ্ল্যাটগুলোর চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভারের মতো এলাকায় নতুন আবাসিক প্রকল্পের প্রবণতা বাড়ছে। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও জমির মূল্য ও প্রকল্প বিনিয়োগে আগ্রহ বেড়েছে। তবে জমির উচ্চমূল্য এবং নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় বাজারে প্রতিযোগিতা ও ঝুঁকি উভয়ই বাড়ছে।
আবাসন খাতে বিনিয়োগ নিয়ে সমসাময়িক যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি আসে তা হলো, নতুন আবাসন প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা কোন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো সবচেয়ে বেশি অনুভব করছেন এবং কীভাবে এই বাধাগুলো অতিক্রম করা যায়?
এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়ার বলেন, ‘আবাসন খাতের বিনিয়োগকারীদের জন্য দরকার ব্যাংক ফ্যাসিলিটিজ। অর্থাৎ সহজ সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ আবাসন খাতে উন্নয়নের জন্য ব্যাংকগুলো এই সুবিধা দিয়ে থাকে।’
আধুনিক প্রযুক্তি আবাসন খাতে নতুন দিগন্ত খুলছে। স্মার্ট হোম অটোমেশন, সিসিটিভি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি সিস্টেম এখন অনেক প্রকল্পেই ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ হিসেবে সোলার প্যানেল, রেইনওয়াটার হারভেস্টিং ও জ্বালানি সাশ্রয়ী নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ছে।
এ ছাড়া এখন থ্রি-ডি ডিজাইন ও ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্রেতারা ফ্ল্যাট কেনার আগেই প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাচ্ছেন। এতে ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়ছে। এ ছাড়া ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস ও অনলাইন লিস্টিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতা সহজেই সংযুক্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা অ্যানালিটিকসের ব্যবহার বাজারকে আরও সুসংগঠিত করবে।
রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ‘দেশে আবাসন খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত নগরায়ণ। আগামী পাঁচ বছরে সঠিক নীতি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আবাসন খাত শুধু শহরের বাসস্থানের সংকট মেটাবে না, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখবে।’ লেখা: দিনার হোসেন