ইভ্যালির অফারের ফাঁদে পড়ে দিশেহারা গ্রাহক

প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ, ২০২০
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png উজ্জ্বল এ গমেজ
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
অনলাইন কেনাকাটার প্লাটফর্ম ইভ্যালির আকর্ষণীয় ছাড় আর লোভনীয় অফারের ফাঁদে পা দিয়ে পছন্দের পণ্য কিনে নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অসংখ্য সাধারণ গ্রাহক। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্রাহকদের ছাড় ও অফারের পণ্য বুঝিয়ে না দিয়ে আরো অসংখ্য নতুন নতুন অফার দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রবিবার (১৫ মার্চ) বিকেলে ফেসবুকে ইভ্যালির অফিসিয়াল পেজ ইভ্যালি.কম.বিডিতে মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেয়া হয় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কাঁপাতে, ইভ্যালিতে আসছে আবারো ইভ্যালি বৈশাখী ঝড়ো অফার সিজন ২.০, লাইফে এখন এইত্তেরিকা ঐইত্তেরিকা, কারণ #লাইফ মানে ইভ্যালি শিরোনামে নানান ধরনের অফার।

বছরব্যাপী বিশেষ দিবসকে ঘিরে প্রতিষ্ঠানটির দেয়া এসব রকমারি চটকদার বিজ্ঞাপন আর লোভনীয় ছাড় ও অফারে আকৃষ্ট হয়ে পছন্দের পণ্য অর্ডার করে বিপাকে পড়েছেন হাজারো ভুক্তভোগী গ্রাহক।

অভিযোগ অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব অভিযোগের অধিকাংশই সময় মত পণ্য ডেলিভারি না দেয়া, অর্ডার দেয়া পণ্য ক্যানসেল করে গ্রাহকের টাকা ফেরত না দেয়া সংক্রান্ত। তবে মিলছে না এসব অভিযোগের কোনো সুরাহা।

প্রতিষ্ঠানটির ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার নিয়ম থাকলেও দিনের পর দিন অপেক্ষা করে, কেউ এক মাস, কেউ দুই মাস পরেও বুঝে পাচ্ছেন না নির্দিষ্ট পণ্য। এসএমএস, ইমেইল, হেল্প সেন্টারে কল করেও মিলছে না কোনো সমাধান। কেউ কেউ পণ্য অর্ডারের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও রয়েছেন শঙ্কায়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উঠেছে গ্রাহক হয়রানি, প্রতারণা আর ভোগান্তির হাজারো অভিযোগ। এ ধরনের অসংখ্য গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্রে আরো জানা গেছে, অনলানে কেনাকাটা করতে গিয়ে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতারিত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি গ্রাহক। এসবের মধ্যে ৮০ ভাগ অভিযোগই রয়েছে ইভ্যালির বিরুদ্ধে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইভ্যালিতে ক্যাশ অন ডেলিভারি (সিওডি) বা পণ্য হাতে পাওয়ার পর পেমেন্ট পদ্ধতি নেই। ফলে এখানে পণ্য ক্রয় করতে হলে অবশ্যই আগে থেকে অনলাইনে পেমেন্ট দিতে হবে। পেমেন্ট দেয়ার কয়েকমাস পর গ্রহাকরা হাতে বুঝে পাচ্ছেন তাদের পণ্য।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গতকাল ইভ্যালির অফিসিয়াল পেজে একটা অফার ঘোষণা করা হয়েছে। ওই অফারে শুধু বলা হয়েছে ইভ্যালিতে নতুন রেজিস্ট্রেশন করলেই মাত্র ২৬ টাকায় মিলবে হাই কোয়ালিটির একটা পোলো টি-শার্ট। অফারটি শুধু ইভ্যালিতে নতুন রেজিস্ট্রেশনকারীদের জন্য।

এ ধরনের টি-শার্টের অফার দেখিয়ে এর আগেও বেশ কয়েকবার সাধারণ গ্রাহকদের দিয়ে ইভ্যালিতে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে অ্যাপ ডাউনলোড করানোর অভিযোগ রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে ওই সব অফারের পণ্য সঠিক সময়ে বুঝে না পাওয়ার অভিযোগও।

ওই অফারের নিচে কমেন্টে মো. অপু লিখেছেন, আবার শুরু ধান্দাবাজি। নতুন একাউন্টে এসব ১০/২০ টাকার অফার দিয়ে একজনকে দিয়ে ১৫/২০ টা একাউন্ট খোলাবে, আর দুইদিন পর টাকা দিয়ে নিউজ করবে ইভ্যালিতে ১ বছরে ১২ লাখ গ্রাহক।বাহ, টাকলা রাসেল বাহ!

ওই অফারের ঘোষণায় গ্রাহক কীভাবে টি-শার্টটি অর্ডার করবেন, অফারটি কবে দেয়া হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছুই বলা হয়নি।

আব্দুর রব শেখ লিখেছেন, আমি রেজিস্ট্রেশন করেছি। কিন্তু মাত্র ২৬ টাকায় হাই কোয়ালিটির পোলো টি-শার্টের অফারটা কিভাবে পাবো দয়া করে একটু জানিয়ে দেন।

জাবাবে অফারটা পাওয়ার পদ্ধতি বিষয়ে না বলে ইভ্যালি পেজের অ্যাডমিন জানালেন, অফারটি শুধু ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ইভ্যালিতে রেজিস্ট্রেশন করা ইউজারদের জন্য প্রযোজ্য। ইভ্যালি অ্যাপ থেকে অর্ডার করা প্রথম ৩০ হাজার জন পাবেন এই অফার। অর্ডার করতে পারবেন ২৬ মার্চ পর্যন্ত।

মনজুর মোর্শেদ নামে একজন গ্রাহক অফারটিতে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। করে পড়ে গেলেন বিপাকে। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছেন, অর্ডার করার কোনো অপশনই নেই কেন? এভাবে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দিয়ে কয়দিন ব্যবসা করবেন?

মো. ফরহাদ রানা লিখেছেন, আমি নতুন রেজিস্ট্রেশন করেছি, এখন কিভাবে এই ২৬ টাকার টি-শার্টটি অর্ডার করবো?

অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটা ফেসবুক আইডি দিয়ে ইভ্যালির ওই অফারে রেজিস্ট্রেশন করা হলে দেখা গেছে, অফারে দেয়া লিংকে শুধু রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অর্ডার করার কোনো অপশনই নেই।

গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে মাত্র ১৬ টাকায় পোলো টি-শার্টের অফার দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ওই অফারের শর্ত দেয়া হয়েছিল অফারটি পেতে আগ্রহীকে ইভ্যালিতে নতুন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। আর শুধু নতুন রেজিস্ট্রেশনকারীদের মধ্য থেকে ২০ হাজার জনকে দেয়া হবে এই টি-শার্টটি।

ওই অফারের টিশার্ট এখানো পাননি অনেক গ্রাহক। তারা এখন মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেয়া মাত্র ২৬ টাকায় পোলো টি-শার্টের অফারের নিচে এসে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

শহিদুল ইসলাম মিলন নামের এক ভুক্তভোগী লিখেছেন, ১৬ টাকার টিশার্টটা পাইনি। ১৬ টাকা জলে গেলো।

ইভ্যালির টপ ফ্যান আশফুল আলম রবিন। তিনিও মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে কমেন্টে করেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৬ টাকা টি-শার্ট অর্ডার করলাম নভেম্বর মাসে আজও পেলাম না।

জাতির পিতার শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির দেয়া মুজিববর্ষের লোগো ব্যবহারের নীতিমালা অমান্য করে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০০ টাকায় একটি পোলো টি-শার্ট এবং ১টি অ্যায়ারফোনের অফার দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। পরে গত ৮ মার্চ ‘মুজিববর্ষ নিয়েও ব্যবসা করছে ইভ্যালি’ শিরোনামে বিবার্তায় একটা বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে অফারটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

ওই অফারে কাঙ্খিত পোলো টি-শার্ট বিষয়ে আজো কোনো আপডেট খবর না পেয়ে মনের কষ্টে স্বাধীনতা দিবসের অফারের নিচে কমেন্টে আবু সালেম লিখেছেন, ১০০ টাকায় একটি পোলো টি-শার্ট এবং ১টি অ্যায়ারফোনের অফারটি কবে পাবো? এর কী হবে? কিন্তু এর কোনো জবাবে মেলেনি।

একইভাবে সুর মিলিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান নয়ন নামের আরেক গ্রাহক। তিনি লিখেছেন, আর ১০০ টাকার অফারের কী হবে? অ্যায়ারফোন +টি-শার্ট?

ইভ্যালির আরেক টপ ফ্যান মো. শাহিন মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, কত আর বাটপারি করবেন। পরের মাথায় লবণ রেখে আর কত বড়ই খাবেন?

শখের প্রিয় বাইক অর্ডার করেছিলেন ইভ্যালিতে। এখানো হাতে না পেয়ে হতাশ অনিক রায় লিখেছেন, আমি তো বলি ধেত্তেরিকা। ১৬ ডিসেম্বরে অর্ডার করা পালসার ১৫০ সিসি এখনো পাইলাম না। আর পাবার আশাও রাখি না। বাটপার কোম্পানি।

গিফট কার্ড কিনে তিন মাস অপেক্ষায় বসে আছেন মো. তারেকুল ইসলাম প্রান্ত। যদি কখনো কোনো অফারে কিছু কেনা যায়। আশাবাদী প্রান্ত লিখেছেন, গিফট কার্ডে পেমেন্ট করার উপায় রাখবেন। ৩ মাস ধরে অপেক্ষায় আছি।

ফারহান ইসলাম লিখেছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারির অর্ডার এখনো প্রসেসিং অবস্থায়। ডেলিভারি টাইমলাইন অনুযায়ী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ডেলিভারি করবেন। এখনো প্রোডাক্টের কোনো খবর নাই। অর্ডার ইনভয়েস নম্বর-EVL248245133।

পণ্য অর্ডার করে টাকা পরিশোধ করার পরেও সেটা নির্ধারিত সময়ে গ্রাহক না পাওয়া, প্রোসেসিংয়ের নামে দিনের পর দিন পণ্য আটকে রাখা, হেল্প লাইনে কল করে অভিযোগ করলে সেটা আমলে না নিয়ে তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়া, সাধারণ গ্রাহকদের এমন নানান ধরনের হয়রানি আর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

আইটি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন লোভনীয় ছাড় আর অফারের নামে যা করছে তা মূলত জনগণের টাকায় গ্রাহক ভোগান্তি আর হয়রানির ব্যবসা। যে কোনো বিশেষ দিবসে নানান লোভনীয় ছাড় আর অফার দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এ ফাঁদে পা দিচ্ছে দেশের সহজ-সরল অসংখ্য সাধারণ গ্রাহক। অর্ডার নিয়ে কিছু গ্রাহককে পণ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাকিদের পণ্য হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন। কেউবা দিন গুনছেন কখন অর্ডার ক্যান্সেলের টাকা ফেরত পাবেন সে আশায়। এভাবে চলতে থাকলে অন্যসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের উপর থেকে সাধারণ গ্রাহকের আস্থা উঠে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচার এবং তাদের কার্যক্রমের কারণে অভিযোগের হার বেড়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো পণ্য বা সেবা নিয়ে কেউ প্রতারিত হলে তিনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করতে পারেন।

ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা জানান, ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত একটা হটলাইন চালু করা হয়েছে। হটলাইন নম্বর ১৬১২১। এখন থেকে যে কোনো ভোক্তা সেবা বা পণ্য কিনে প্রতারিত হলে সঙ্গে সঙ্গে ওই হটলাইনে অভিযোগ করতে পারবেন। কল করে ২৪ ঘণ্টা এ সেবা পাওয়া যাবে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে ইভ্যালির পদক্ষেপ সম্পর্কে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটির পাবলিক রিলেশন কনসালটেন্ট সোলায়মান হোসেন শাওনকে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষে লিখিত বক্তব্যের জন্য ইমেইল করলে জানান ইভ্যালির সিইও ঢাকার বাইরে আছেন। উনাকে মেইলটা পাঠিয়েছি। উত্তর দিলেই আপনাকে দিয়ে দেয়া হবে। দীর্ঘ ৩৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদনটি বিবার্তায় প্রকাশ হয়েছে। দেখতে যেতে হবে এই ঠিকানায়
image

আপনার মতামত দিন