তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যুবক-যুবতীদের ভার্চুয়াল জগতে আশা ও সত্যের সাক্ষ্য বহন, খ্রিষ্টান পরিচয়কে তুলে ধরতে সামাজিক যোগাযোগামধ্যমের দায়িত্বশীল ব্যবহার, পোস্ট, কনটেন্ট লেখায় খ্রিষ্টীয় ভাবধারা বজায় রাখা ও ভার্চুয়াল জগতের কনটেন্ট ফ্যাক্টচেকিংয়ের মাধ্যমে যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে সামাজিক যোগাযোগামধ্যমের পোস্টগুলো পরিশীলিতভাবে উপস্থাপনের বিষয়ে ধারণা দিতে এক সেমিনার আয়োজন করা হয়।
শনিবার (২৬ জুলাই) ঢাকার ভাটারা ঐশ করুণা ধর্মপল্লীতে ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের আয়োজনে মহাধর্মপ্রদেশের যুবক-যুবতীদের নিয়ে এই মিডিয়া সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে ৬০ জন যুবক-যুবতী এই সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।
সেমিনারের শুরুতে সবাইকে স্বাগত জানান ভাটারা ঐশ করুণা ধর্মপল্লীর সহকারী পাল পুরোহিত শিশির কোড়াইয়া। ফাদার শিশির কোড়াইয়া অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে বলেন, “এই সেমিনারের অভিজ্ঞতা আপনারা যেন নিজেদের ধর্মপল্লীতে এবং সমাজে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিতে ব্যবহার করুন।”

“ডিজিটাল মিশনারী: ডিজিটাল বিশ্বে আশা ও সত্যের সাক্ষী হওয়া”-মূলসুরের উপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের কাফরুল ধর্মপল্লীর পালপুরোহিত জ্যোতি এফ কস্তা।
তিনি বলেন, “আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন ডিজিটাল মাধ্যম শুধু তথ্য আদান-প্রদানের একটি সরঞ্জাম নয়, বরং আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন আমরা অসংখ্য বার্তা পড়ি, শেয়ার করি এবং প্রকাশ করি। এই বিশাল ডিজিটাল জগতে আমরা প্রত্যেকে যেন একেকজন প্রেরক। প্রশ্ন হলো-আমাদের বার্তা কি আশা ও সত্যের সাক্ষ্য বহন করছে, নাকি কেবল শব্দের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে? একজন ডিজিটাল মিশনারি হওয়ার মানে হলো সচেতনভাবে এমন কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার করা যা মানুষের মাঝে সাহস, ইতিবাচকতা ও মানবিকতা জাগিয়ে তোলে।''
ফাদার জ্যোতি এফ কস্তা বলেন, ‘‘খ্রিষ্টান হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পোস্ট আমাদের মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। তাই আমাদের দায়িত্ব এমনভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে অংশগ্রহণ করা, যাতে সেগুলো শুধু তথ্য দেয় না, বরং অনুপ্রাণিত করে। আজকের ডিজিটাল পরিবেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সত্যকে রক্ষা করা। মিথ্যা তথ্য, গুজব ও বিভ্রান্তিকর খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। একজন খ্রিষ্টান যুবক-যুবতী হিসেবে আমাদের কাজ হলো প্রতিটি তথ্য যাচাই করা, ফ্যাক্ট-চেকিং করা এবং কেবল সেই কনটেন্ট শেয়ার করা যা বিশ্বাসযোগ্য এবং গঠনমূলক। একই সঙ্গে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে আমরা আশা ছড়ানোর ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। হতাশা, নেতিবাচকতা ও সহিংস বার্তার পরিবর্তে আমরা এমন বার্তা দিতে পারি যা মানুষকে একত্র করে, ভেঙে দেওয়া সম্পর্ককে জোড়া লাগায় এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।”
সেমিনারটি সার্বিকভাবে পরিচালনা করেন ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের আহ্বায়ক, খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রের পরিচালক ও সাপ্তাহিক প্রতিবেশী’র সম্পাদক ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু। তিনি উল্লেখ করেন, “ডিজিটাল দুনিয়া যেমন চ্যালেঞ্জপূর্ণ, তেমনি সম্ভাবনায় ভরপুর। যদি আমরা সচেতনভাবে এর সঠিক ব্যবহার শিখি, তবে এই মাধ্যম আমাদের হাতে হয়ে উঠবে এক শক্তিশালী মিশনারি প্ল্যাটফর্ম। তাই আসুন, আমরা প্রত্যেকে আমাদের প্রতিটি ক্লিক, প্রতিটি পোস্ট ও প্রতিটি শেয়ারকে এমনভাবে ব্যবহার করি, যাতে মানুষ আমাদের মাধ্যমে শুধু তথ্যই না পায়, বরং খুঁজে পায় আশা, সত্য এবং জীবনের ইতিবাচক দিক। অনলাইনে প্রতিটি পোস্ট, কমেন্ট বা শেয়ার আমাদের খ্রিষ্টান পরিচয়কে তুলে ধরে। তাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দায়িত্বশীল আচরণ বজায় রাখা আজ সময়ের দাবি।
অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে বিষয়ভিত্তিক প্যানেল আলোচনা হয়। প্যানেল আলোচনা পরিচালনা করেন তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম-বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল টেকভয়েস২৪-এর হেড অব অনলাইন উজ্জ্বল এ গমেজ, ডিসি নিউজবিডির নির্বাহী সম্পাদক রবীন ভাবুক, আনন্দবার্তা পরিবারের এডমিন নিউটন মণ্ডল ও সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যাণ্ড কলেজের শিক্ষিকা ও উপস্থাপিকা ঈশিতা ক্লারা গমেজ।

নিউটন মণ্ডল ও ঈশিতা ক্লারা গমেজ “একজন খ্রিষ্টান যুবক-যুবতী হিসেবে কনটেন্ট তৈরি, নেটওয়ার্কিং এবং সহযোগিতা”-এর গুরুত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে আলোচনায় বলেন, “আজকের যুগে, যেখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে কনটেন্ট তৈরি শুধু একটি প্রযুক্তিগত কাজ নয়-এটি এক ধরনের বিশ্বাসের সাক্ষ্য (testimony), আত্মিক দায়বদ্ধতা এবং সৃষ্টিশীল মিশন। খ্রিষ্টীয় কনটেন্ট হলো এমন বার্তা বা সৃষ্টিশীল উপাদান যা মানুষের মনে খ্রিষ্টের প্রেম, ক্ষমা, শান্তি এবং সত্যের বীজ বপন করে। খ্রিষ্টান কনটেন্ট মানেই শুধু বাইবেল-এর কোট নয়-এটি হতে পারে: ব্যক্তিগত সাক্ষ্য, নৈতিকতা ও সম্পর্ক নিয়ে খ্রিষ্টীয় দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক সমস্যা নিয়ে বিশ্বাসভিত্তিক বক্তব্য, প্রার্থনা, সংগীত, কবিতা, বা ছোট নাট্যাংশ ইত্যাদি। ডিজিটাল মাধ্যম আজ শুধু তথ্যের বাহন নয়, এটি সুসমাচার প্রচারেরও শক্তিশালী একটি ক্ষেত্র। একজন খ্রিষ্টান যুবক হিসেবে আমাদের উচিত এমন কনটেন্ট তৈরি করা, যা মানুষের মাঝে সত্য, আশা ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। হতাশা, ভীতি বা নেতিবাচকতার পরিবর্তে এমন কনটেন্ট তৈরি করা যা মানুষের মনে সাহস, সহানুভূতি ও ঐক্য সৃষ্টি করে।”

রবীন ভাবুক তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, “অনলাইনে মিথ্যা তথ্য, ঘৃণাসূচক বক্তব্য বা বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট না ছড়িয়ে, যাচাই করা এবং নৈতিকভাবে সঠিক তথ্য প্রকাশ করা।”

‘কপিরাইট, গোপনীয়তা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও নৈতিকতা’র বিষয়ে উজ্জ্বল এ গমেজ বলেন, ‘‘ডিজিটাল দুনিয়ায় আমরা প্রতিদিনই ছবি, লেখা, ভিডিও, সংগীত অসংখ্য কনটেন্ট ব্যবহার করছি। কিন্তু আমরা কি সবসময় ভাবি, এগুলোর মালিকানা কার? আমরা কি নিশ্চিত হই যে যা আমরা শেয়ার করছি তা কপিরাইট লঙ্ঘন করছে না? কপিরাইটের মূল উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টিশীল ব্যক্তির কাজকে আইনি সুরক্ষা দেওয়া। যে ছবি একজন তুলেছেন, যে লেখা কেউ লিখেছেন বা যে সংগীত কেউ তৈরি করেছেন, তার প্রতিটি কাজের একটি আইনি অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারকে অগ্রাহ্য করে যদি আমরা বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করি, সেটি শুধু নৈতিক নয়, আইনি দিক থেকেও ভুল। আমরা যদি সত্যিকারের ডিজিটাল মিশনারি হতে চাই, তবে আমাদের অনলাইনে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।’’
সেমিনারে বক্তারা নৈতিকতা, সঠিক নেটওয়ার্কিং, সহযোগিতা, ফ্যাক্ট-চেকিং এবং কপিরাইট সচেতনতার গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করেন। তাদের মতে, ভুয়া তথ্য প্রতিরোধ এবং বিশ্বস্ত তথ্য প্রচার বর্তমান সময়ে খ্রিষ্টান মিডিয়া কর্মীদের অন্যতম দায়িত্ব।
পরিশেষে সকলে যেন প্রকৃত খ্রিষ্টান কনটেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে উঠতে পারে সে জন্য ঈশ্বরের কাছে সাহায্য চেয়ে পবিত্র খ্রিষ্টযাগ উৎসর্গ উৎসর্গ করেন ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু।

সেমিনারটি সঞ্চালনায় ছিলেন কমিশনের সদস্য সাগর এস কোড়াইয়া ও লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া।

সূত্র: আনন্দ বার্তা