‘দেশের স্বাস্থ্যখাতের একজন পরিচিত মুখ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রথিতযশা লেখক। প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী ও পথ প্রদর্শক।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসাহিত্যের পথিকৃৎ। চিকিৎসক, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক, গবেষক হিসেবে দেশ ও বিদেশে দীর্ঘ
৫০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। দেশের পুরো স্বাস্থ্যখাত এবং চিকিৎসাসেবায় যার অবদান অনেক। তিনি হলেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী এমবিবিএস, এম ফিল, এফসিপিএস।
চিকিৎসক হিসেবে তিনি সরকারি এবং বেসরকারি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চিকিৎসা
প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে
সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেছেন। ৩৫ বছর সরকারি
প্রতিষ্ঠানে এবং ১৪ বছর বেসরকারি
খাতে বারডেমের ডিরেক্টর ল্যাবরেটরি সার্ভিস ও ইব্রাহিম মেডিকেল
কলেজে সম্মানি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে তিনি দেশি-বিদেশি জার্নালে ৫২টি প্রবন্ধ লিখেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৬২টি মৌলিক গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। সেইসাথে ছাত্রজীবন থেকেই দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকায় স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লক্ষাধিক লেখা লিখেছেন। এখনও লিখছেন। বর্তমানে অবসর যাপন করছেন সহজ-সরল জীবনযাপনকারী চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই লেখক ও
গবেষক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী।
সম্প্রতি বিবার্তা২৪.নেটের সাথে একান্তে কথা বলেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। দীর্ঘ আলাপে জানালেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অতীতে কি হয়েছে, বর্তমানে
কেমন চলছে, চিকিৎসকদের শিক্ষা, চিকিৎসাখাতে অবকাঠামোগত সমস্যা ও সমাধানসহ নানান
বিষয়। দীর্ঘ আলাপের চুম্বক বিষয়গুলো বিবার্তার পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো।
বিবার্তা : চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
ডা. শুভাগত চৌধুরী: ১৯৬৯ সালে মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রথম কাজ করা শুরু করি। এর পর সিলেট
মেডিকেল কলেজের শিক্ষক হই। ১৯৭১ সালের পর পর বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রিতে প্রভাষক পদে যোগ দিই। আশির শেষের দিকে বিলেতে যাই প্রশিক্ষণ, শিক্ষাদীক্ষার কাজে। ইউরোপে গেছি, সাউথইস্ট এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও যাওয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রিতে যোগ দিই। ১৪ বছর কাজ
করেছি এখানে। প্রফেসর অব বায়োকেমিস্ট্রি হয়েছি।
২০০০ সালে প্রিন্সিপাল এবং প্রফেসর হই, হেড অব বায়োকেমিস্ট্রি হিসেবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলাম। ২০০৪ সালে অবসর নিলাম। ২০০৫ সালে বারডেমের ডিরেক্টর ল্যাবরেটরি সার্ভিস এবং অনারারি প্রফেসর অব বায়োকেমিস্ট্রি হিসেবে
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজে যোগ দিলাম। এখন অবসরে আছি।
বিবার্তা : বর্তমানে আপনি দেশ ও বিদেশে কোন
কোন কাজের সাথে যুক্ত আছেন?
ডা. শুভাগত চৌধুরী: আমি এখন সরাসরি তেমন কোনো কাজের সাথে যুক্ত না। পেশাগত জীবনে আমার শেষ কর্মস্থল ছিল ঢাকা বারডেম ল্যাবরেটরি সার্ভিস। ওখানে ডিরেক্টর হিসেবে ছিলাম। অধ্যাপনা করেছি। এখন পুরোপুরি অবসরে আছি। গৃহবন্দি জীবনযাপন করছি। তবে প্রত্যক্ষভাবে দেশে-বিদেশে গবেষণা, জুম মিটিং, ভার্চুয়ালি জুম প্লাটফর্মে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছি। দেশে-বিদেশে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিচ্ছি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় স্বাস্থ্য বিষয়ে কিছু লেখালেখি করছি, চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাংলায় কিছু বইও বের হয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও আগের মতো আর গবেষণা করতে
পারছি না। কারণ একবারে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছি।
বিবার্তা : আপনি যখন ১৯৭১ সালে চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন, তখনকার আর এখনকার চিকিৎসাসেবায়
কোনো পার্থক্য দেখছেন কি?
ডা. শুভাগত চৌধুরী: হ্যাঁ, অবশ্যই। অনেক পার্থক্য দেখছি। তখনকার চিকিৎসাবিজ্ঞানটা এতোবেশি অগ্রসর বা উন্নত ছিল
না। এখন অনেক উন্নত হয়েছে। অগ্রসর হয়েছে। আমি ডাক্তার হয়েছি পাকিস্তান আমলে। তখন বাংলাদেশী ডাক্তারদের অনেক দমন-নিপীড়ন করা হতো। ডাক্তারদের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হতো না। পূর্ব পাকিস্তানে তখন চিকিৎসাসেবায়, চিকিৎসাবিদ্যায় কোনো মানও ছিল না। তেমন কোনো ধারাও ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চিকিৎসাসেবা এমনকি চিকিৎসাবিদ্যায় অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা হয়তো সমালোচনা করতে পারি কী হয়নি, আর
কী হয়েছে। সব খাতেই কিছু
কিছু নেতিবাচক দিক আছে। তেমনি দেশের স্বাস্থ্যখাতেও থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেগুলো বাদ দিলেও বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটা অনেক বড় প্রাপ্তি। এটা
আমরা ভাল করে বুঝতে পারি। কারণ আমরা দুই দেশেই কাজ করেছি। আমি যখন পাকিস্তানে কাজ করেছি তখন পাকিস্তানে পড়েছি। আবার যখন দেশে কাজ করেছি তখন দেশে পড়েছি। সুতরাং আমরা এই পার্থক্যটা খুব
ভালভাবে বুঝতে পারি। যতটুকু হোক না কেন সার্বিকভাবে
চিকিৎসাবিজ্ঞানে দারুণ অগ্রগতি হয়েছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। চিকিৎসা পদ্ধতি হয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর। চিকিৎসাসেবায় রোগ শনাক্তকরণে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে। স্বাধীনতার পরে দেশে তো বেসরকারি হাসপাতাল
ছিলই না। এখন বেসরকারি হাসপাতালগুলো দারুণ উন্নতি হয়েছে। সেসাথে সরকারি হাসপাতালগুলোতেও সব দিক থেকে
উন্নতি ও অগ্রগতি হয়েছে।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশে অনেক বড় বড় চিকিৎসক
এসেছেন, শিক্ষকরা এসেছেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রযুক্তিবিদরা এসেছেন, গবেষকরা এসেছেন। এর প্রভাব পড়েছে
পুরো স্বাস্থ্যখাতে। এখন স্বাস্থ্যখাতে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে সব কিছু। তাই
সার্বিক দিক বিবেচনায় আমি বলবো ৭০ দশকের তুলনায়
এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক উন্নতি হয়েছে।
বিবার্তা : চিকিৎসাসেবা খাতের সীমাবদ্ধতা আছে কী? সেগুলো কী কী?
ডা. শুভাগত চৌধুরী: দেখুন, সবকিছুরই সীমাবদ্ধতা থাকে। কোনকিছুই পরিপূর্ণ হয় না। কিছু
কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবেই। তেমনি বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা খাতেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ খাত নিয়ে
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত হওয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সাথে সাথে জনগণের দোরগোড়ায় চিকিৎসাসেবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন
সেটির বাস্তবায়নও করেছিলেন অনেকটা। বঙ্গবন্ধুর সময়েই সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসাসেবাটি সম্প্রসারিত হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির জন্য পরিকল্পনা করেন। বাস্তবায়নও করেছেন। তখন কাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে।
এরপরে সময়ের পরিবর্তনে বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার নামে দুর্নীতি হয়েছে। যদিও কেনা হয়েছে সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় নাই। প্রতিষ্ঠানগুলোতে
জনবল সঠিকভাবে উপস্থাপন করা যায় নাই। চিকিৎসাসেবা পদ্ধতিতে কোনো সিস্টেম চালু করা হয়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণার অভাব। মানসম্মত চিকিৎসা দেয়ার জন্য যেসমস্ত চিন্তা-ভাবনা এবং কর্মপরিকল্পনা করার দরকার, সেগুলো করা হয়নি। অনেকেই হয়তো চেষ্টা করেছিলেন। সেভাবে বাস্তব রূপ দেয়া হয়ে উঠেনি। চিকিৎসাসেবা খাতে এগুলো আমাদের সীমাবদ্ধতা। সাধারণ মানুষের কাছে সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে
চিকিৎসাসেবাটা পৌঁছে দেয়ার পদ্ধতি তৈরি করতে না পারাটাও একটা
সীমাবদ্ধতা।
আরেকটা বিষয় হলো, দেশের মানুষের চিকিৎসার যে চাহিদা সে
তুলনায় চিকিৎসকদের (চিকিৎসায় জনসম্পদ) সংখ্যা খুবই কম। বেশি দূর যেতে হবে না। আপনি যদি ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে যান তাহলে দেখতে পাবেন, ৬ ঘন্টার মধ্যে
একজন চিকিৎসক ৩০০ জন রোগী দেখছেন।
জনগণ বলছেন বেশি করে সময় দেন। ৩০০ জন রোগীর লম্বা
লাইন। ১০ মিনিট সময়
দিলে ৬ ঘণ্টায় কোন
মতে দেখা সম্ভব না। এমন পরিস্থিতিতে অনেক সময় চিকিৎসকরা নানাভাবে নিপীড়িত হচ্ছেন। নির্যাতিত হচ্ছেন। এর জন্য তেমন
কোন প্রতিবাদ হচ্ছে না। চিকিৎসকরা অনেক কষ্টের মধ্যে সেবাগুলো দিচ্ছেন।
বিবার্তা : এই সীমাবদ্ধতা দূর
করতে কী পদক্ষেপ নেয়া
যেতে পারে বলে মনে করেন?
ডা. শুভাগত চৌধুরী: এমনটা কেন হচ্ছে? কারণ আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত রোগী দেখার বিজ্ঞানসম্মত কোনো সিস্টেম তৈরি করা হয় নাই। ১৯৭১
সালের পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলাম যে, সাধারণ মানুষের জন্য জেনারেল প্র্যাকটিজ (জিপি) সিস্টেম এবং হেলথ ইন্সুরেন্স চালু করলে চিকিৎসায় অনেকটা শৃ্ঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কেউ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এলাকাভিত্তিক যদি জিপি সিস্টেম থাকতো তাহলে এলাকার ডাক্তাররা প্রথম রোগী দেখতেন। পরে তারা যদি মনে করতেন রোগীটার জটিল অবস্থা, তাহলে যার কাছে পাঠানো দরকার সেখানে পাঠিয়ে দিতেন। এটা বলা হয় রেফারেল সিস্টেম।
অন্যদিকে মেডিকেল কলেজে কনসালটেন্ট আছেন যারা তারা অধ্যাপক। তারও দুটা ভাগ করা উচিত ছিল। অধ্যাপক মেডিকেলে অধ্যাপনা করবেন। কনসালটেন্ট মেডিকেলে রোগী দেখবেন একাডেমিক রোগীদের। এটা বাইরের দেশে করা হয়ে থাকে। আরেকটা বিষয় হলো, আমার কাছ থেকে প্রতিদিন কতজন চিকিৎসা নিলেন সেটার চেয়ে, সেটার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি কেমন চিকিৎসা দিচ্ছি। চিকিৎসার জন্য গুণগতমানটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি ৩০০ জন রোগী দেখলাম।
সেখানে মানটা রইল না। তাহলে তো কোনো মানে
হলো না। তাই আমি মনে করি, যে সিস্টেমগুলো নিয়ে
বলেছি সেগুলো চালু করা যেতে পারে। চালু হলে ভোগান্তি কিছুটা কমতো। বলছি না যে এটা
সম্পূর্ণ সমাধান।
বিবার্তা : দেশের চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে আপনার মতামত কেমন?
ডা. শুভাগত চৌধুরী: দেখুন, আমি চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা, উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্বের অসংখ্য দেশ ঘুরেছি। বিভিন্ন দেশে কাজও করেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে যদি দেখি তাহলে বলবো যে, উন্নত ও প্রযুক্তি সফল
দেশের চিকিৎসাসেবার তুলনায় আমাদের দেশের চিকিৎসার মান, চিকিৎসকদের সক্ষমতা, দক্ষতা, প্রতিভা অনেক ভাল। আমাদের দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের
বাস। মানুষের চিকিৎসার যে চাহিদা, সে
তুলনায় চিকিৎসকদের (চিকিৎসায় জনসম্পদ) সংখ্যা খুবই কম। এখন পর্যন্ত এই সীমিত সংখ্যক
চিকিৎসকরা সারাদেশের সাধারণ মানুষদের যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে
এটা পৃথিবীর কোন দেশেই সম্ভব না। এটা থিওরিটিক্যাল না। এটা প্র্যাকটিকেল বিষয়। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের হাসপাতালে এবং ল্যাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে জোর দিয়ে বলছি।
আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষ এই অল্প সংখ্যক
চিকিৎসকদের কাছ থেকে যে চিকিৎসাসেবাটা পায়
সেটা পৃথিবীর কোন দেশেই পাবে না। বলতে পারেন খুবই উন্নত মানের চিকিৎসা। উন্নত মানের চিকিৎসা দেশের কতজন মানুষ নিতে পারেন? সাধারণ মানুষ পারেন? না। যাদের বেশি পয়সা আছে তারাই উন্নত মানের চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়া বা সিংগাপুরে যান।
যাদের একটু কম পয়সা আছে
তারা যান ভারতে। এটা কী চিকিৎসাবিজ্ঞানে উন্নতি হলো?
আমার কাছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি মানে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবার উন্নতি। মানুষ যাতে সুলভ মূল্যে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সব ধরনের চিকিৎসাসেবা
গ্রহণ করতে পারে।
বিবার্তা : দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার অগ্রগতি কেমন? যেসব গবেষণা হচ্ছে সেগুলো কী যথেষ্ট, আপনার
অভিজ্ঞতা কী বলে?
ডা. শুভাগত চৌধুরী: চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু থেকেই শিক্ষকতা করার পাশাপাশি সবসময় মনের মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা বিষয়টি ভাবাতো। শেখার নেশায় গবেষণা করেছি। নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় গবেষণা চালিয়েছি। দেশ-বিদেশে একে একে ৫২টি বিষয়ে গবেষণা করেছি। ওই গবেষণাপত্রগুলো দেশে
ও বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেলেই
দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে
শিক্ষকতা করেছি। আমার অভিজ্ঞতায় বলবো দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার অগ্রগতি তো দূরের কথা,
চিকিৎসায় যে পরিমাণ গবেষণা
হওয়া উচিত ছিল সে তুলনায় খুবই
কম হয়েছে। কেউ কেউ গবেষণায় ভাল করেছেন। তাদের গবেষণাপত্রগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ হয়েছে। এদের সংখ্যাটা খুবই কম।
আমাদের দেশে চিকিৎসায় গবেষণার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যেগুলো গবেষণা হয়েছে সেগুলো বিচ্ছিন্ন, ব্যক্তিগতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়নি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোনো গবেষণা করা হলে সেটার যে একটা বিরাট
আয়োজন সেরকম এ দেশে করা
হয়নি বা হয় না।
আমাদের দেশে এ বিষয়ে তেমন
কোন অগ্রাধিকার নাই, গুরুত্বও কম। আমি জানি না চিকিৎসায় গবেষণা
নিয়ে কেনো আয়োজন কম, কেনো অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। বিষয়টা
আমার কাছে একটা রহস্য। আর এটা খুবই
দুঃখজনক। এটা হওয়া উচিত। আমাদের চিকিৎসকদের গবেষণায় বেশি উৎসাহিত করতে হবে। এটা হলে চিকিৎসাসেবায় আরো অনেক বেশি উন্নত হতো। তবে এরই মধ্যে যে গবেষণা হয়েছে
সেটা সন্তোষজনক না।
বিবার্তা : বলছিলেন দেশে চিকিৎসায় গবেষণার অফুরান সম্ভাবনা রয়েছে। সেটা কীভাবে, একটু যদি বলতেন. . .
ডা. শুভাগত চৌধুরী: দেখুন, আমাদের দেশের মানুষ খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা খুবই সহজ-সরল। ১৮ কোটি মানুষের
মধ্যে মাত্র ৩ কোটি মানুষ
বাস করেন শহরে। বাকি ১৬ কোটি মানুষই
গ্রামের। এদের নিয়ে ক্লিনিক্যাল গবেষণা করাটা খুবই সহজ, যেটা বিশ্বের অন্য দেশে করা সম্ভব না। আমাদের দেশে ক্লিনিক্যাল গবেষণার এতবেশি মেটিরিয়েলস আছে যেটা বিশ্বের অন্য দেশের নেই। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে রোগীর গায়ে তো টাচ করাই
যাবে না। টাচ করতে অনুমতি লাগবে। বিনা অনুমতিতে রক্ত নেয়া যায় না। রক্ত বা নমুনা নিতে
হলে রোগীর অনুমতি নিতে হয়। আর এদেশে তো
সাদর সম্ভাষণ না জানিয়েই রোগীর
পেটে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করলে রোগী কিছুই মনে করেন না। কেননা রোগীরা যে বড় অসহায়।
তাই এখানে চিকিৎসায় গবেষণা করাটা অনেকটা সহজ। শুধু দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও আন্তরিক সদ্বিচ্ছা।
বিবার্তা : চিকিৎসাসেবা খাতের উন্নয়নে আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
ডা. শুভাগত চৌধুরী: চিকিৎসাসেবাখাতের সার্বিক উন্নয়নের কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলবো,
চিকিৎসাসেবাখাতে আমাদের আরো অনেক দিক থেকে উন্নতি করতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন ও উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আমাদের সৎভাবে ও আন্তরিকতার সাথে
চিকিৎসা দিতে হবে। চিকিৎসায় যন্ত্রপাতি কেনায় যে দুর্নীতি হয়,
সেটা বন্ধ করতে হবে। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় কী করে অত্যাধুনিক
চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেয়া যায় সেটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কীভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে অত্যাধুনিক ও উন্নত চিকিৎসাসেবা
দেয়া যায়, সে দিকে নজর
দিতে হবে। চিকিৎসাসেবায় গুণগত মান কীভাবে বাড়ানো যায়, কী করে জনবল
বাড়ানো যায়, হাসপাতালে উন্নতমানের নষ্ট যন্ত্রপাতিগুলো কীভাবে ঠিক করা যায় এসব বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। চিকিৎসায় শিক্ষার গুণগতমান বাড়াতে হবে। কেননা, মানসম্পন্ন চিকিৎসক পেতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে ও পরিবেশ দিতে
হবে।
বিবার্তা : এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ। স্বাস্থ্যসাহিত্যের আপনার অবদান অনেক। আপনার স্বাস্থ্য নিয়ে বইগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
ডা. শুভাগত চৌধুরী: চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে এবং জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর এ পর্যন্ত ৬২টি
মৌলিক গ্রন্থ লিখেছি। সাধারণ মানুষের জন্য লেখা এসব বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আমাদের শরীর, স্বাস্থ্য কথা, ডায়াবেটিস ব্লাডপ্রেশার কোলেস্টেরল হার্ট এটাক, নারীর স্বাস্থ্য, আপনার স্বাস্থ্য কুশলসমগ্র, ডায়াবেটিস: রোগ লক্ষণ ও প্রতিকার, গোপন
রোগের কথা, টিন এজ মন শরীর
ও স্বাস্থ্য, ভালো খাওয়া ভালো স্বাস্থ্য, শিশুর জগৎ, আপনার কুশল ২য় খন্ড, আপনার
কুশল ৩য় খন্ড, ডাক্তারী
আলাপ, চিকিৎসা বিজ্ঞানে আবিস্কারের কাহিনী, চিকিৎসাবিজ্ঞান পরিভাষা, মনের এ দুয়ারটুকু, খাদ্য
পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকথা, ভালো
খাওয়া ভালো স্বাস্থ্য, যৌবন ধরে রাখতে হলে, ক্যান্সার, কিডনীর যত্ন, শরীর নামের কারখানা, সুখে অসুখে ইত্যাদি। এছাড়াও ছাত্র অবস্থা থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে
নিয়মিত চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নিয়ে লিখেছি। ৫০ বছর ধরে
নিয়মিত লিখছি। এর সংখ্যা লক্ষাধিক
হবে।
বিবার্তা : চিকিৎসা পেশা নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই?
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী: চিকিৎসা একটা মহৎ পেশা। চিকিৎসা একমাত্র পেশা, যেখানে দুর্নীতি না করে সৎভাবে
প্রচুর টাকা অর্জন করা যায়। সচ্ছলভাবে থাকা যায়। সুন্দরভাবে জীবনযাপন করা যায়। একটা সময় এটা মহান পেশা ছিল। এখন চিকিৎসকদের কসাই বলা হয়। কেন? এ প্রশ্নটা আসলে
চিকিৎসকদের নিজের করা উচিত। আসলে রোগীকে আদর্শ সময় দেওয়া উচিত। যারা চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়ছেন, তাদের আরো মানবিক হওয়া প্রয়োজন। যারা এই পেশায় আসছেন,
তাদের এটিকে ভালোবেসে আসা প্রয়োজন। পেশাটাকে হৃদয়ে ধারণ করে মন থেকে মানুষকে
সেবা দেয়া উচিত। তাহলে মানুষের এই মহান পেশা
সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে।
বিবার্তা : চিকিৎসাসেবায় বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চাইছেন?
ডা. শুভাগত চৌধুরী: চিকিৎসকরা সেবা দিয়ে একজন মুমূর্ষু রোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনে নতুন জীবন দিয়ে থাকেন। তাই কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস চিকিৎসকরা জটিল রোগ থেকে সুস্থ করে তাদের নতুন জীবন দিবেন। কোটি মানুষের এই বিশ্বাসকে বাস্তবে
রুপ দিতে দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। বাস্তবে অনেক সময় এর উল্টো চিত্র
চোখে পরে। কয়েকজন স্বার্থান্বেষী চিকিৎসকদের কারণে পুরো চিকিৎসাসেবা খাতের সব চিকিৎসকদের দুর্নাম
হয়। এমনটা চর্চা যাতে কেউ না করেন সে
আশা করছি।
এর জন্য প্রয়োজন
দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়নের। এই খাতে শিক্ষার
মান যত বেশি উন্নত
হবে, চিকিৎসকরাও ততবেশি দক্ষ ও গুণগতমানসম্পন্ন হবেন। আমি
চাই চিকিৎসাখাতটা এমন সুন্দর হয়ে উঠুক যেখানে থাকবে না কোন দুর্নীতি,
অর্থলোভ। চিকিৎসকরা হৃদয় থেকে ভালোবেসে এ মহান পেশাটাকে
গ্রহণ করবে। সবাই যাতে নির্লোভ থেকে আন্তরিকতার সাথে সৎভাবে মানুষকে চিকিৎসা দিতে পারেন। সব মানুষ যাতে
চিকিৎসকদের বসাতে পারেন শ্রদ্ধা এবং ভরসার সর্বোচ্চ আসনে, যে সম্মান ও
মর্যাদার দাবিদার একজন আদর্শ চিকিৎসক। দেশের সবাই আদর্শ চিকিৎসক হয়ে উঠুক। দেশের স্বাস্থ্যখাত হয়ে উঠুক সুন্দর, যেখানে সবাই থাকবে সুস্থ। এমনটাই আমার প্রত্যাশা।
নিউজটি বিবার্তায় প্রকাশ হয়েছে। দেখতে যেতে হবে এই ঠিকানায়।