এআই নৈতিকতা: যে বাস্তবতা এআই রেটারদের চোখ খুলে দিলো

প্রকাশ: সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৫
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png নিজস্ব প্রতিবেদক
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিকতা নিয়ে নিজের অবস্থান বদলে দেওয়া সেই মুহূর্তটি আজও ভুলতে পারেন না ক্রিস্টা পাভলোস্কি-অ্যামাজনের মেকানিক্যাল টার্কে কাজ করা এক এআই রেটার। প্রতিদিন তাঁর কাজ, এআই তৈরি টেক্সট, ছবি, ভিডিও যাচাই করা, ভুল ধরানো, তথ্য মিলিয়ে দেখা। কিন্তু একদিনের অভিজ্ঞতা তাঁর এআই-ধারণাই বদলে দিল।

একটি টুইট, আর একটি উপলব্ধি
দুই বছর আগে তিনি একটি কাজ পান, টুইটগুলো (বর্তমানে এক্স) বর্ণবাদী কি না তা চিহ্নিত করা। সেখানে তিনি দেখেন, “Listen to that mooncricket sing.” শব্দটির অর্থ তিনি জানতেন না, তাই না অর্থাৎ বর্ণবাদী নয়, বেছে নিতে যাচ্ছিলেন। পরে খুঁজে দেখেন, ‘mooncricket’ কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্দেশে ব্যবহৃত অবমাননাকর বর্ণবাদী গালি।

এই একটি ভুল তাঁকে থামিয়ে দেয়। তাঁর মনে হয়, এরকম ভুল কতবার তিনি করে ফেলেছেন? আর সেই ভুলগুলোই হয়তো অজান্তেই ঢুকছে এআই মডেলের ভেতরে, পক্ষপাত, অপমানজনক ভাষা, ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল তথ্য।

এআই নিয়ে তাঁর অবস্থানে সম্পূর্ণ পরিবর্তন
বছরের পর বছর এই কাজ করতে করতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজে আর কোনো জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করবেন না। এমনকি তাঁর কিশোরী মেয়েকেও দূরে রাখেন এসব টুল থেকে।

পাভলোস্কির ভাষায়, “আমার বাড়িতে এআইয়ের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ।”

মেকানিক্যাল টার্কে প্রতিবার নতুন কোনো কাজ দেখলেই তিনি ভাবেন, এটি কি মানুষের ক্ষতি করতে পারে? প্রায়ই তাঁর ভেতরের উত্তর হয়, হ্যাঁ, পারে।

অ্যামাজনের অবস্থান
অ্যামাজন জানায়, কোন কাজ নেবেন তা কর্মীরাই সিদ্ধান্ত নেন। কাজের নির্দেশনা, পারিশ্রমিক, সময়, সবই নির্ধারণ করেন কাজ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। মেকানিক্যাল টার্ক মূলত একটি ক্রাউডসোর্সিং প্ল্যাটফর্ম, কোম্পানিগুলো তাদের ছোট ছোট কাজ ভাগ করে দেয়, আর সাধারণ কর্মীরা সেগুলো করে আয় করেন।

পাভলোস্কি একা নন, এআই রেটারদের হতাশা বাড়ছে
গুগলের জেমিনি, চ্যাটজিপিটি, ইলন মাস্কের গ্রোক, সব মডেলের রেটাররা দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, এআইয়ের ভিতরকার দুর্বলতা দেখে তাঁরা পরিবারের সদস্যদেরও সতর্ক করছেন, অনেকে পুরোপুরি নিষেধ করছেন এআই ব্যবহার করতে।

গুগল সার্চের এআই ওভারভিউ রেটিং করা এক কর্মী বলেন, ‘চিকিৎসা-সংক্রান্ত প্রশ্নে এআইয়ের অযৌক্তিক উত্তর তাঁকে আতঙ্কিত করেছে। কোনো মেডিকেল প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাঁদের এসব প্রশ্ন যাচাই করতে দেওয়া হচ্ছে।’

কাজের চাপ, অস্পষ্ট নির্দেশনা-গুণগত মান রাখা অসম্ভব
মেকানিক্যাল টার্কে কাজ করা ব্রুক হ্যানসেন বলেন, “এআই নয়, কোম্পানিগুলোই বিপজ্জনক, তারা দায়িত্বের চেয়ে লাভকে বেশি গুরুত্ব দেয়।”

২০১০ সাল থেকে ডেটা-সংক্রান্ত কাজে যুক্ত তিনি জানান,
>>যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নেই
>>নির্দেশনা অস্পষ্ট
>>সময়সীমা অত্যন্ত কম
ফলে এআই’র নিরাপত্তা, নির্ভুলতা বা নৈতিকতা, কোনোটাই ঠিকভাবে বজায় রাখা যায় না।

‘উত্তর না’ দেওয়ার বদলে এখন ভুল উত্তর দিচ্ছে এআই
নিউজগার্ডের গবেষণা বলছে, ২০২৪ সালে বড় এআই মডেলের নন-রেসপন্স রেট ছিল ৩১%, ২০২৫ সালে তা নেমেছে শূন্যে, ভুল তথ্য দেওয়ার হার বেড়ে ১৮% থেকে ৩৫%, অর্থাৎ, এখন এআই ভুল হোক বা সঠিক-একটা উত্তর দিতেই হবে।

রেটারদের ভাষায়, “এআইকে যদি মিথ্যা বলা বন্ধ করানো যেত, তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত।”

পক্ষপাতও বড় সমস্যা
এক রেটার জানান, ২০২৪ সালে গুগলের জন্য কাজ করার সময় তিনি দেখেছিলেন,
>>ফিলিস্তিনের ইতিহাস জানতে চাইলে মডেল নীরব
>>কিন্তু ইসরায়েলের ইতিহাস জানতে চাইলে লম্বা ব্যাখ্যা

তিনি বিষয়টি রিপোর্ট করেছিলেন-কোনো উত্তর পাননি। তাঁর মন্তব্য-ডেটা যখন পক্ষপাতপূর্ণ, এআইও পক্ষপাতপূর্ণ হবে। এটাই সেই ক্লাসিক নিয়ম, Garbage in, garbage out.

 এআইয়ের পেছনে অদৃশ্য শ্রম ও পরিবেশগত খরচ
 হ্যানসেন বলেন, এআই কোনো জাদু নয়। এটি দাঁড়িয়ে আছে,
>>বিপুল মানুষের অদৃশ্য শ্রম
>>ভুল সিদ্ধান্ত
>>সময়ের চাপ
>>পরিবেশগত ক্ষতি
>>এবং বিশাল আর্থিক ব্যয়ে।

ডিস্ট্রিবিউটেড এআই রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক আদিও দিনিকার কথায়, “যারা এআইয়ের ভেতরের শ্রম দেখেছেন, তারা একে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নয়, বরং ভঙ্গুর সিস্টেম হিসেবে দেখেন।”

স্কুলে গিয়ে সতর্কতা দিচ্ছেন রেটাররা
মিশিগান অ্যাসোসিয়েশন অফ স্কুল বোর্ড সম্মেলনে পাভলোস্কি ও হ্যানসেন প্রেজেন্টেশন দেন, এআইয়ের নৈতিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়ে। অনেকে বিস্মিত হন। বিশেষ করে এআইয়ের পেছনের শ্রম ও পরিবেশগত খরচ শুনে।

টেক্সটাইল শিল্পের উদাহরণ
পাভলোস্কির মতে, এআইয়ের নৈতিকতা অনেকটা টেক্সটাইল শিল্পের মতো। একসময় ক্রেতারা জানতেন না, সস্তা পোশাক কীভাবে তৈরি হচ্ছে, কারা বানাচ্ছে, তাদের শ্রমের মূল্য কেমন।

>>এআইয়ের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন
>>ডেটা কোথা থেকে আসছে?
>>কপিরাইট ভাঙা হয়েছে কি?
>>কর্মীরা কি ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন?

আমরা এখনো সব উত্তর জানি না। কিন্তু প্রশ্ন করা শুরু করলেই বদল আসবে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।

image

আপনার মতামত দিন