দশ বছর আগের কথা। গ্রিসের নাগরিক আর্মেন কিরাকোসিয়ান একটি কল সেন্টারে কাজ করতেন। প্রতিটি কল মানেই ছিল বিরক্তিকর গ্রাহক, একঘেয়ে মেনু ঘাঁটা, আর হাতে হাতে নোট নেওয়ার ক্লান্তিকর কাজ। দিনগুলো যেন ধৈর্য আর হতাশার পরীক্ষা ছিল।
কিন্তু এখন, প্রযুক্তির বদলে যাওয়া দুনিয়ায় ২৯ বছর বয়সী এই অ্যাথেন্সবাসীর কাজ অনেকটাই বদলে গেছে। তিনি যখন ফোন ধরেন, গ্রাহক কিছু বলার আগেই তার প্রোফাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। এমনকি কখনো কখনো আগেভাগেই বুঝে যান, কী সমস্যা নিয়ে ফোন করছেন গ্রাহক। কিরাকোসিয়ান বলেন, "এআই আমাদের ভেতরের রোবটটাকে সরিয়ে দিয়েছে।"
বিশ্বজুড়ে কল সেন্টারের চ্যালেঞ্জ
বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ কল সেন্টারে কাজ করছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সংখ্যাটি প্রায় ৩০ লাখ। মোবাইল ফোন নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে অনলাইন অর্ডারের সমস্যা, সব সামলান এরা। কিরাকোসিয়ান বর্তমানে কাজ করেন টিটিইসি নামের একটি কোম্পানিতে, যারা ২২টি দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে গ্রাহকসেবা দেয়।
তবে এই কাজ অনেকের জন্য সত্যিই কঠিন। ম্যাককিনসির তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫০% কল সেন্টার কর্মী এক বছরের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দেন। কারণ, মানসিক চাপ, একঘেয়েমি এবং কম সুযোগ।
মানুষ না এআই, কে দেবে সমাধান?
আজকের দিনে সাধারণ অনেক কাজই করে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। এতে কিছু চাকরি হারিয়েছে ঠিকই, কিন্তু জটিল সমস্যার সমাধানে এখনো ভরসা মানুষই। অনুমান করা হচ্ছে, আগামী ১০ বছরে অর্ধেক কল সেন্টার চাকরি হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তবে তাতে মানুষের গুরুত্ব একেবারে ফুরিয়ে যাবে না।
সুইডেনের ক্লারনা এআই চালুর মাধ্যমে ৭০০ কর্মী বাদ দিয়েছিল। কিন্তু পরিচয় চুরি বা জটিল লেনদেন সমস্যা এআই সামলাতে না পারায়, ২০২৫ সালে তারা আবার মানুষ নিয়োগে ফিরে আসে।
রেপ্লিকেন্ট নামের একটি এআই কোম্পানির গাডি শামিয়া বলেন, “আমাদের স্বপ্ন, একটি ‘এআই-ফার্স্ট’ কন্টাক্ট সেন্টার, যেখানে সাধারণ কাজগুলো করবে এআই আর জটিল বিষয় সামলাবে দক্ষ মানুষ।”
আইভিআর-এর দিন কি শেষ?
“সেলসের জন্য এক চাপুন, সার্ভিসের জন্য দুই”-এই পরিচিত বাক্যটি এসেছে ইন্টারঅ্যাকটিভ ভয়েস রেসপন্স (আইভিআর) প্রযুক্তি থেকে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এখনো চান সরাসরি একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে। এজন্য অনেকে ম্যানুয়ালি চেষ্টা করেন IVR পেরিয়ে যাওয়ার, যা অনেক সময় ভিন্ন বিভাগে পাঠিয়ে দেয় বা অপেক্ষা বাড়ায়।
এই সমস্যা সমাধানে মার্কিন সিনেট প্রস্তাব করেছে "Keep Call Centers in America Act", যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে কল সেন্টার রাখলে প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে এবং সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চ্যাটজিপিটি, এরিকা ও ভবিষ্যতের এআই এজেন্ট
গ্রাহকসেবার জগতে আসছে আরও উন্নত এআই এজেন্ট। ওপেনএআই এনেছে চ্যাটজিপিটি এজেন্টস, যাকে আপনি বলতে পারেন, “আমি আগামী বছরের একটি বিয়ের জন্য হোটেল খুঁজছি, কাপড় ও উপহারের অপশন দিন।” এআই বুঝে যাবে আপনার প্রয়োজন এবং একসাথে সমাধান দেবে।
ব্যাংক অব আমেরিকার এরিকা নামের চ্যাটবট ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩০০ কোটি বার ব্যবহৃত হয়েছে। এটি শুধু প্রশ্নের উত্তরই দেয় না, বরং গ্রাহকের অভ্যাস বুঝে পরামর্শও দেয়।
জেমস বেদনার, টিটিইসি-এর পণ্য বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিশ্বাস করেন, “এই প্রযুক্তি একদিন আইভিআর সিস্টেমকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করবে। এআই এমনভাবে পথ দেখাবে, যাতে মেনু ঘাঁটার ঝামেলা না থাকে।”
কল সেন্টারের কাজ যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি বদলাচ্ছে গ্রাহকসেবার মানদণ্ড। এআই সাধারণ সমস্যার সমাধান দিচ্ছে দ্রুত, আর জটিল সমস্যায় পাশে থাকছে দক্ষ মানুষ। ভবিষ্যতের কল সেন্টার হবে মানুষের ও প্রযুক্তির সম্মিলিত প্রয়াস, যেখানে প্রযুক্তি কাজ করবে সহযোগী হিসেবে, প্রতিস্থাপক হিসেবে নয়। সূত্র: ব্লুমবার্গ, টেককাঞ্চ, এপিনিউজ