কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর চ্যাটবট ‘গ্রোক’কে ঘিরে শুরু হয়েছে প্রযুক্তি জগতে নতুন বিতর্ক। ইলন মাস্কের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এক্সএআই-এর তৈরি এই চ্যাটবট সাম্প্রতিক সময়ে ইহুদিবিদ্বেষী ও চরমপন্থী মন্তব্য করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিবিশ্বে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে।
গত শনিবার এক পোস্টে এক্সএআই তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে জানায়, ‘অনেকেই যে গ্রোকের ভয়াবহ আচরণের মুখোমুখি হয়েছেন, তার জন্য আমরা গভীরভাবে দুঃখিত।’
কী ঘটেছিল?
প্রতিষ্ঠানটির ব্যাখ্যায় বলা হয়, গ্রোকের মূল ভাষার মডেলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও, এক কোড আপডেটের মাধ্যমে '@grok' হ্যান্ডেলের বটটি এক্স-এর (সাবেক টুইটার) ব্যবহারকারীদের পোস্ট দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ পায়। এ সুযোগে গ্রোকের উত্তরগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে চরমপন্থী ও বিদ্বেষমূলক মতামত।
ইলন মাস্ক নিজেই কয়েক সপ্তাহ আগে অভিযোগ করেছিলেন, গ্রোক ‘খুব বেশি রাজনৈতিকভাবে সঠিক’ হয়ে উঠেছে। তিনি ঘোষণা দেন, বটটিকে আরও ‘স্বাধীন’ ও ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ বানানো হবে। ৪ জুলাই মাস্ক দাবি করেন, '@Grok' কে ‘উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত’ করা হয়েছে। এর পরপরই গ্রোক বিভিন্ন বিতর্কিত পোস্ট করতে শুরু করে, যার মধ্যে ছিল ডেমোক্র্যাট দলের সমালোচনা, ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, হিটলারের প্রশংসা এবং নিজেকে ‘মেকাহিটলার’ নামে উপস্থাপন করা।
প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপ
এই ঘটনায় গ্রোকের কিছু পোস্ট মুছে ফেলা হয়, বটটিকে সাময়িকভাবে অফলাইনে নেওয়া হয় এবং এর ‘সিস্টেম প্রম্পট’ হালনাগাদ করা হয়। তুরস্ক সরকার দেশটির প্রেসিডেন্টকে অপমানের অভিযোগে গ্রোককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ সময় এক্স-এর সিইও লিন্ডা ইয়াকারিনো পদত্যাগের ঘোষণা দেন, যদিও তিনি বিতর্কের সঙ্গে পদত্যাগের সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন।
এক্সএআই দাবি করে, গ্রোক একটি ‘অনিচ্ছাকৃত অ্যাকশন’-এর ফলে এমন নির্দেশ পেয়েছিল, যাতে বলা হয়: ‘তুমি যেমন, তেমনই বলো-even if it hurts politically correct people.’
ইলন মাস্ক নিজেও বলেন, গ্রোক ‘ব্যবহারকারীদের প্রম্পটের প্রতি অত্যন্ত অনুগত’ এবং ‘মানুষকে খুশি করতে অতিমাত্রায় আগ্রহী।’ তবে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গ্রোক-৪ মডেল ইলন মাস্কের নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম পোস্ট বিশ্লেষণ করে তার বক্তব্যে প্রভাবিত হয়-এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
সমালোচনা
ইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গাস জনস্টন ব্লুস্কাইতে মন্তব্য করেন, ‘গ্রোকের কিছু ইহুদিবিদ্বেষী বক্তব্য এমন থ্রেডেও এসেছে, যেখানে আগে কোনো বিদ্বেষ ছিল না। ব্যবহারকারীরা প্রতিবাদ করার পরও গ্রোক তার অবস্থান থেকে সরেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি প্রমাণ করে, সমস্যাটি কোডের মধ্যে প্রোথিত, কেবল বাইরের প্রভাব নয়।’
বিগত মাসগুলোতে গ্রোক বিতর্কিত অনেক বিষয়ের ওপর পোস্ট করেছে-যেমন: ‘শ্বেত গণহত্যা’, হলোকাস্টের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ, এমনকি ইলন মাস্ক বা ডোনাল্ড ট্রাম্পবিরোধী তথ্য সেন্সর করা। এসব ক্ষেত্রেও এক্সএআই দায় চাপিয়েছে ‘অননুমোদিত কোড আপডেট’ বা ‘বিদ্রোহী কর্মীদের’ ওপর।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সব বিতর্ক সত্ত্বেও মাস্ক জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই গ্রোককে টেসলা গাড়িতে সংযুক্ত করা হবে। এটি আরও বড় বিতর্কের জন্ম দিতে পারে-বিশেষ করে যখন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ব্যবস্থাকে সরাসরি গণপরিবহন ও গাড়ির সফটওয়্যারে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে।
গ্রোককে ঘিরে এই বিতর্ক কেবল একটি প্রযুক্তিগত ভুলের ফল নয়; বরং এটি বৃহত্তর প্রশ্ন তোলে-এআই যখন সামাজিক, রাজনৈতিক ও মূল্যবোধগত বিষয়ে মত প্রকাশ করতে শুরু করে, তখন তার নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা কে রাখবে? ভবিষ্যতের চ্যাটবট কেবল তথ্য নয়, মতামতও ছড়াবে-এবং সেই মতামতের দায় কাকে নিতে হবে, তা এখনই নির্ধারণ জরুরি। সূত্র: টেকক্রাঞ্চ