একটি চ্যাটবট কীভাবে বিশ্বসেরা গণিতবিদদের চ্যালেঞ্জ জানায়? এমনই এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে চলতি বছরের মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে। গোপনীয় পরিবেশে আয়োজিত বিশেষ সম্মেলনে মুখোমুখি হন ৩০ জন শীর্ষ গণিতবিদ এক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায়। প্রতিপক্ষ ছিল একটি এআইচালিত চ্যাটবট-ওপেনএআই-এর নতুন প্রজন্মের মডেল ‘ও৪ মিনি’। ফলাফল-চমকে ওঠার মতো!
এই দুই দিনব্যাপী চ্যালেঞ্জের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট-এআইয়ের যুক্তিমূলক ক্ষমতা যাচাই করা। গবেষকেরা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণামূলক পর্যায়ের শতাধিক জটিল গাণিতিক সমস্যা ছুড়ে দেন ও৪ মিনির দিকে। অনেক সমস্যাই ছিল এমন, যেগুলোর সমাধান আগে কেউ দেয়নি বা যেগুলো ‘ওপেন প্রবলেম’ হিসেবে চিহ্নিত। ফলে এটি ছিল শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং ভবিষ্যতের গণিতচর্চার একটি ঝলক।
চমকে যাওয়া শুরু এখানেই
প্রথমেই গবেষকেরা লক্ষ্য করেন, এআই বটটি শুধু তথ্যভাণ্ডার থেকে উত্তর টানছে না; বরং নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করছে। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ এবং অনুষ্ঠানের অন্যতম বিচারক কেন ওনো একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রশ্ন তৈরি করেন, যা সাধারণত পিএইচডি স্তরের শিক্ষার্থীরাও সমাধান করতে পারেন না। তিনি সেই প্রশ্নটি ও৪ মিনিকে দেন-কৌতূহলে অপেক্ষায় থাকেন উত্তর দেখার জন্য।
প্রথম দুই মিনিটে ও৪ মিনি সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলো পড়ে আত্মস্থ করে নেয়। এরপর নিজেই জানায়, সে প্রথমে সহজ সংস্করণ সমাধান করে তারপর মূল সমস্যার দিকে এগোবে। মিনিট দশেকের মধ্যে উত্তর তৈরি করে জানায়, “কোনো সাইটেশন লাগবে না, সংখ্যাটি আমি নিজেই হিসাব করেছি!”
এই মুহূর্তে ওনো ও উপস্থিত গণিতবিদেরা বুঝতে পারেন-এআই শুধু উত্তর দিচ্ছে না, যুক্তি দিয়ে এগোচ্ছে, নিজস্ব পদ্ধতিতে চিন্তা করছে।
মানব বনাম যন্ত্রের এই লড়াইয়ে কার জয়?
যদিও ও৪ মিনি অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, তবুও কিছু প্রশ্ন ছিল যেগুলোর মুখোমুখি হয়ে সে পরাস্ত হয়েছে। ওই ১০টি প্রশ্নের জন্য গবেষকদের দেওয়া হয় ৭,৫০০ মার্কিন ডলারের পুরস্কার। এটি প্রমাণ করে, এখনো মানুষের সৃজনশীলতা ও গভীর বোধ একেবারে মুছে যায়নি-তবে চ্যালেঞ্জটা প্রকট হচ্ছে।
ও৪ মিনির সফলতা নিয়ে মন্তব্য করেন গণিতবিদ এলিয়ট গ্লেজার, যিনি নিজেই ‘ফ্রন্টিয়ার ম্যাথ’ নামে চার স্তরে বিভক্ত এক সেট নতুন প্রশ্নের কাঠামো তৈরি করেছিলেন। তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল নাগাদ ও৪ মিনি প্রায় ২০ শতাংশ নতুন ধরনের প্রশ্নের সমাধান দিতে পারবে, যেটি আগের যেকোনো এআই মডেলের চেয়ে অনেক বেশি।
গবেষণার ভবিষ্যৎ কোথায়?
লন্ডন ইনস্টিটিউট ফর ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সেস-এর গবেষক ইয়াং হুই হে মন্তব্য করেন, “ও৪ মিনি যেভাবে চিন্তা করছে, সেটি একজন অসাধারণ পিএইচডি ছাত্রের মতো-কিন্তু অনেক বেশি নিখুঁত ও দ্রুত।”
সম্মেলনের শেষ দিনে গবেষকেরা যখন ভবিষ্যতের চিত্র আঁকছিলেন, তখন এক প্রশ্ন বারবার উঠে আসছিল-গণিতবিদেরা কি শুধু প্রশ্ন তৈরি করবেন, আর সমাধান করবে তাঁদের ‘সহযোগী এআই’? এমন বাস্তবতায় কেন ওনোর সতর্ক বাণী বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়, “এআই আমাদের জায়গা নিতে পারবে না-এমন ভাবা ভুল। আমাদের আসল শক্তি থাকবে সৃজনশীলতায়।”
মানব মেধা বনাম যন্ত্রের যৌথ অভিযাত্রা
এখনকার বাস্তবতা বলছে, গণিতের মতো শুষ্ক ও কঠিন ক্ষেত্রেও এআই কেবল সমাধানকারী নয়, সহচর হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। হয়তো আগামী দিনের গবেষণায় মানুষ ও যন্ত্র একসঙ্গে পথ চলবে-একজন প্রশ্ন করবে, অন্যজন উত্তর খুঁজে আনবে। তবে, এই অভিযাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে সেই অনন্য মানবিক গুণ-সৃজনশীলতা। সূত্র: লাইভ সায়েন্স, টাইমস অব ইসরায়েল