অনেকের চোখে ইন্টারনেট এক রহস্যময় জিনিস-বাতাসের মধ্যেই চলে তথ্য, ছবি, ভিডিও আর বার্তা। এক ডিভাইস থেকে আরেক ডিভাইসে মুহূর্তেই পৌঁছে যায় সবকিছু। কিন্তু বাস্তবতা? একেবারেই ভিন্ন।
বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটের প্রায় ৯৫ শতাংশ তথ্য আদান-প্রদান হয় সমুদ্রতলের ফাইবার অপটিক ক্যাবল দিয়ে। এই ক্যাবলগুলোই আমাদের পরিচিত ডিজিটাল দুনিয়ার প্রকৃত মেরুদণ্ড, যা এক মহাদেশকে আরেকটির সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে।
সমুদ্রের তলদেশে গড়ে উঠছে নতুন ক্ষমতার লড়াই
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, হোয়াটসঅ্যাপের বার্তা থেকে শুরু করে ব্যাংকিং লেনদেন, ভিডিও কল, স্যাটেলাইট ডেটা, এমনকি সেনাবাহিনীর গোপন যোগাযোগ-সবকিছুর মূলে রয়েছে এই ফাইবার অপটিক ক্যাবলগুলো। অর্থাৎ, এগুলোর নিয়ন্ত্রণ যার হাতে, সে-ই এক অর্থে তথ্যবিশ্বের নিয়ন্ত্রক।
এখানেই জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ধরনের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। সমুদ্রতলের এই ডিজিটাল মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে এখন এক অদৃশ্য শক্তির লড়াই শুরু হয়েছে-সরকার, টেলিকম জায়ান্ট আর এখন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে।
কে বানাচ্ছে এই ইন্টারনেট হাইওয়ে?
আগে এসব ক্যাবল স্থাপন করত রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক টেলিকম কোম্পানিগুলো। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন গুগল, মেটা, অ্যামাজন, মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্টরা নিজেরাই ক্যাবল বসাচ্ছে সমুদ্রের তলদেশে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গুগল এখন পর্যন্ত ২০টিরও বেশি আন্ডারসি ক্যাবল প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ইকুইয়ানো’-যেটি পর্তুগাল থেকে নাইজেরিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত।
উন্নয়ন না নিয়ন্ত্রণ?
প্রথমদিকে অনেকে ভাবতেন, এসব উদ্যোগে ইন্টারনেট হবে আরও দ্রুত, আরও সাশ্রয়ী। কিন্তু এখন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টা শুধু উন্নয়ন নয়-এটা তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশল।
যখন গুগল বা মেটার মতো কোম্পানি নিজেরাই ক্যাবল স্থাপন করে, তখন তারা হয়ে ওঠে সেই অবকাঠামোর মালিক। ফলে, কারা ইন্টারনেটে প্রবেশ পাবে, কত খরচ হবে, কোন তথ্য কোন রুটে যাবে-এসব সিদ্ধান্তের ক্ষমতা চলে যায় বেসরকারি টেক কোম্পানির হাতে।
নাহলা ডেভিস, প্রযুক্তি বিশ্লেষক, একে বলছেন "তথ্যের ভূরাজনীতি"। তাঁর মতে, দ্রুতগতির ইন্টারনেটের পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক গভীর উদ্দেশ্য-বিশ্বব্যাপী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ।
নিরাপত্তার নতুন চ্যালেঞ্জ
এখন শুধু প্রযুক্তির প্রশ্ন নয়, অনেক দেশ এই কেবলগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখছে। ভবিষ্যতে যদি যুদ্ধ বা সংঘাত হয়, প্রতিপক্ষ সহজেই এই ক্যাবল কেটে দিয়ে গোটা অঞ্চলকে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করতে পারে।
এছাড়া নজরদারির ঝুঁকিও কম নয়। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চীনা কোম্পানিগুলোর ক্যাবল প্রকল্পে অংশগ্রহণে বাধা দিচ্ছে। চীনও এর পাল্টা হিসেবে নিজের ক্যাবল নেটওয়ার্ক তৈরি করছে-পশ্চিমা রুট থেকে নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে।
এক নতুন ‘স্নায়ুযুদ্ধ’?
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. সিদ্ধার্থ কৌশল সতর্ক করে বলেছেন-এই ক্যাবলগুলোর ওপর নির্ভরতা এতটাই বেশি, যে ক্ষতি হলে তা বিশ্বব্যাপী বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমরা এক নতুন রকমের ‘ইন্টারনেট স্নায়ুযুদ্ধে’ প্রবেশ করছি। যেখানে শুধু প্রযুক্তি নয়-আস্থা, প্রবেশাধিকার ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মূল লড়াই।
ইন্টারনেটকে আমরা যতটা অবাধ ও সীমাহীন মনে করি, বাস্তবে তা ততটাই নিয়ন্ত্রিত আর কাঠামোবদ্ধ। আর এই কাঠামোর নিচেই গড়ে উঠছে এক নতুন শক্তির খেলা, যেখানে ক্যাবল ডেটা নয়, ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত ও নীতিও নির্ধারিত হতে পারে। আপনার ইন্টারনেট সংযোগ যত দ্রুতই হোক, তার পেছনের রাজনীতি হয়তো আরও দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে।