চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক পুরোনো। ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি থেকে শুরু করে ভূরাজনীতি-সব ক্ষেত্রেই দুই দেশ দীর্ঘ সময় ধরে মুখোমুখি অবস্থানে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রতিযোগিতা এক নতুন রূপ নিয়েছে। নতুন যুদ্ধক্ষেত্র এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বিশ্বজুড়ে এই প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে “বৈশ্বিক ক্ষমতার নতুন মুদ্রা”, কারণ ভবিষ্যতের অর্থনীতি, যোগাযোগ, এমনকি সামরিক কৌশলেও এআই-এর প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে।
চীন এই নতুন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তির দুনিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও নিজেদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে মরিয়া।
চীনের পরিকল্পিত অগ্রযাত্রা
২০১৭ সাল থেকে চীন সরকারি পর্যায়ে এআইকে জাতীয় অগ্রাধিকারের তালিকায় যুক্ত করে। চীনা সরকার তখন থেকেই বিশাল বিনিয়োগ শুরু করে-এআই গবেষণা, ডেটা সেন্টার নির্মাণ, স্টার্টআপ ফান্ডিং ও শিক্ষা খাতে বিশেষ প্রশিক্ষণ চালু করে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০২৫ সাল নাগাদ রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে চীন এআই খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এত বড় বিনিয়োগের লক্ষ্য একটাই-বিশ্বের এআই সুপারপাওয়ার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা।
যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে থাকার ভ্রান্ত ধারণা
অনেক দিন ধরেই মনে করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এআই গবেষণা ও উদ্ভাবনে অনেক এগিয়ে। কিন্তু বাস্তবে সেই ব্যবধান দ্রুত কমিয়ে আনছে চীন। বিশ্বের বৃহত্তম চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং বলেন, “এআই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি এগিয়ে নেই। চীন এখন প্রায় সমান অবস্থানে।”
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পেড্রো ডোমিঙ্গোসও একই কথা বলেন। তার মতে, “চীন বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে ব্যবধান কমিয়ে এখন অগ্রভাগে চলে এসেছে। তারা শুধু অনুসারী নয়, এখন উদ্ভাবনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।”
শক্তিশালী চীনা এআই মডেলের উত্থান
লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম) ক্ষেত্রে একসময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল একচ্ছত্র আধিপতি। তবে এখন চীনের একাধিক প্রতিষ্ঠান দ্রুত অগ্রগতি দেখাচ্ছে।
চীনের ডিপসিক, কিউওয়েন-৩ এবং কিমি কে২ মডেল আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত। এই মডেলগুলো ইংরেজি ছাড়াও চীনা ভাষায় অত্যন্ত কার্যকরভাবে কাজ করছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-চীনা কোম্পানিগুলো ডেভেলপারদের জন্য এই মডেলগুলো বিনা মূল্যে বা কম খরচে ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে।
এর ফলে হাজার হাজার স্থানীয় গবেষক ও উদ্যোক্তা সহজেই এআই ভিত্তিক অ্যাপ ও টুল তৈরি করতে পারছে।
এটাই চীনের এআই অগ্রগতির বড় শক্তি হয়ে উঠেছে।
সংখ্যায় এগিয়ে চীন
বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি এআই মডেলের মধ্যে ১৪টিই চীনের তৈরি। এটি এআই দুনিয়ায় চীনের দ্রুত উত্থানের স্পষ্ট প্রমাণ। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের গুগল, ওপেনএআই ও মেটার মতো প্রতিষ্ঠান এখনো শীর্ষে আছে, তবু চীনের শক্তিশালী গবেষণা ও নীতিগত সহায়তা ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে।
চিপ সংকটে চীনের সীমাবদ্ধতা
তবে সব দিক থেকে চীন এখনো এগিয়ে নয়। এআই মডেল প্রশিক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো উন্নতমানের চিপ। এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ান এখনো অগ্রগামী।
মার্কিন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কারণে চীন অত্যাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি পায় না। এ কারণে চীনের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোনো হার্ডওয়্যার ব্যবহার করতে হচ্ছে।
তবে অধ্যাপক ডোমিঙ্গোস মনে করেন, এই নিষেধাজ্ঞাই উল্টোভাবে চীনকে আরও উদ্ভাবনী করে তুলছে। চীনের প্রকৌশলীরা পুরোনো প্রযুক্তি উন্নত করে নতুনভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে-যা ভবিষ্যতে আরও স্বনির্ভর গবেষণার পথ খুলে দিতে পারে।
নতুন স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা
এআই প্রতিযোগিতা এখন শুধু প্রযুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি ভূরাজনীতি, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউসি লর এআই ল অ্যান্ড ইনোভেশন ইনস্টিটিউট-এর পরিচালক রবিন ফেল্ডম্যান এই পরিস্থিতিকে “নতুন ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ” বলে বর্ণনা করেছেন।
তার ভাষায়, “এই এআই যুদ্ধে জিতবে সেই দেশ, যারা সবচেয়ে দ্রুত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অগ্রগতি অর্জন করবে
এবং দীর্ঘমেয়াদে তা ধরে রাখতে পারবে।”
প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ কার হাতে?
আজকের পৃথিবীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু প্রযুক্তি নয়-এটি এক ধরনের কৌশলগত শক্তি। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিযোগিতা নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের তথ্যপ্রবাহ, নিরাপত্তা, এমনকি বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথও। সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি নিউজ, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস