সকল অংশীজনের অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে ডিএসএ ভিক্টিমস নেটওয়ার্ক। পূর্বে অনলাইনে মত প্রকাশ করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার এই নেটওয়ার্কের ২৭ জন ভুক্তভোগী সদস্য রবিবার এ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে সাইবার নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বাতিলকৃত ৫৭ ধারা এবং বাতিলকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নের শিকার প্রতিবাদী ভুক্তভোগীরা, উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশটি নাগরিকদের অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রণয়ন না করায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানায়।
এতে বলা হয়, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিপ্লবী শিক্ষার্থী-জনতা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করেছে। প্রায় দুই হাজারের ওপর শহিদ ও বিশ হাজারের ওপর আহত বিপ্লবী সাধারণ জনতা খুনি হাসিনা সরকার কর্তৃক মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে বাংলাদেশের জন্য এনেছে নতুন বাক স্বাধীনতার স্বাদ। বাংলাদেশের জনগণের মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনতার আত্মত্যাগের মাধ্যমে শপথ নেয়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তাই জনগণের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের সকল অংশীজনের সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা করে জনবান্ধব আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করবে।’
সেই প্রত্যাশায় অনুমোদনকৃত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ায় ৮টি সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। সমস্যাগুলো হুবহু নিচে তুলে ধরা হলো।
১। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে সকল অংশীজনের অংশগ্রহণ ও পর্যাপ্ত আলোচনার ব্যতিরেকে উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগত অনুমোদন করা হয়েছে, যা ‘আইনের শাসন’ (Rule of Law)-এর ব্যত্যয়। এভাবে গোপনভাবে আইনের খসড়া প্রণয়নের সাথে খুনি হাসিনার অপশাসনকালের আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির গুণগত কোনো প্রকার পার্থক্য নেই।
২। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টাকে সহায়তাকারী বিশেষ উপদেষ্টা আইনের পুরো খসড়া জনগণের নিকট প্রকাশ না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে অধ্যাদেশের কিছু ধারা নিয়ে বিতর্কিত পোস্ট দিয়েছেন, যা ইতোমধ্যে অংশীজনদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের অপেশাদার আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অগ্রহণযোগ্য, যা জবাবদিহিতার দাবি রাখে।
৩। সাইবার নিরাপত্তা আইনের কিছু বিতর্কিত ধারা বাতিল, এবং শাস্তি কমানো ছাড়া অনুমোদিত অধ্যাদেশের খসড়ার সাথে বিলোপকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মৌলিক তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বরং ধারা ৮-এর উপধারা ১ এবং ২-তে জাতীয় সংহতি, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি বলে মনে করা যেকোনো তথ্য অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষমতা জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালককে দেয়া হয়েছে, যা একজন নাগরিককে এই বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত নেবার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেবার বৈষম্যমূলক পথ তৈরি করবে। এই ধরনের পদক্ষেপ ভিন্নমত দমনে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে। অধ্যাদেশটি পড়ে যা বোঝা যাচ্ছে – এখন রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রের চাকুরিরত কর্মকর্তাবৃন্দ দেশের সংহতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদির সংজ্ঞা নির্ধারণ করবেন এবং এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। সেক্ষেত্রে বিগত সরকারগুলো দ্বারা তৈরি করা আইনের সাথে এই আইনের তো তেমন কোনো পার্থক্যই থাকছে না।
৪। জাতীয় সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিলে সরকারের মন্ত্রী, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের আধিক্য, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এবং ডিএসএ/সিএসএ আইনে অনিষ্পন্ন মামলাসমূহ চলমান থাকা ইত্যাদি নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনেরই ধারাবাহিকতা।
৫। সকল অংশীজনের সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা না করে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া প্রণয়ন করায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা সুস্পষ্ট করা হয়নি। যেমন সাইবার অপরাধের প্রকারভেদ, অনলাইন যৌন নির্যাতন, সাইবার বুলিইং, অনলাইন গ্রুমিং, ব্যক্তিগত তথ্য ইত্যাদি। এছাড়াও বেশ কিছু বিষয়, যেমন সেবা প্রদানকারীকে দায়ী না হওয়া, বিশেষজ্ঞ হিসাবে স্বীকৃতির সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড, সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো ইত্যাদি উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগত অনুমোদিত অধ্যাদেশে অনুপস্থিত।
৬। উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদিত অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুতকারীগণ সাইবার নিরাপত্তা (Cyber Security), সাইবার অপরাধ (Cyber Crime) এবং কন্টেন্ট ব্যবস্থাপনা (Content Moderation) এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে একটি বিভ্রান্তিমূলক খসড়া উপদেষ্টাবৃন্দ ও জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
৭। জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন/নীতিমালা, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন/নীতিমালা, ব্লকচেইন আইন/নীতিমালা, ওটিটি নীতিমালা ইত্যাদি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদিত অধ্যাদেশে বিস্তারিত ধারা না থাকায় ভবিষ্যতে উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদিত অধ্যাদেশের সাথে উপরোক্ত আইন/নীতিমালাগুলো সাংঘর্ষিক হওয়ার আশংকা রয়েছে।
৮। উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদিত অধ্যাদেশের সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও নীতিমালার অগ্রগতিকে ধারণ করে না। এ বছরের ২২ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সামিট অব দ্য ফিউচারে ঘোষিত Global Digital Compact (GDC) এবং ২৪ ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়া United Nations Convention against Cybercrime-এর নীতিমালাসমূহ উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগত অনুমোদিত অধ্যাদেশে অনুপস্থিত এবং এই অনুপস্থিতি সৃজনশীল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবকবৃন্দে সৃজনশীলতা ব্যাপকভাবে ব্যাহত করবে।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন- ঢাকার বন্দিনী পূণর্বাসন উদ্যোগের কর্মী ইশরাত জাহান রেইলি, ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক রহিম শুভ, ফেনীর শিক্ষার্থী সাইদুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি মঞ্জিলা ঝুমা, বরগুনার সাংবাদিক জামাল মীর, পটুয়াখালীর শিক্ষক নুসরাত জাহান সোনিয়া, রাঙামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহী, ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক আল মামুন জীবন, ঢাকার সাংবাদিক রুদ্র ইকবাল, অধরা ইয়াসমিন, মুমিতুল মিম্মা, বায়জিদ আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা, খুলনার সাংবাদিক আবু তৈয়ব, ময়মনসিংহ ভালুকার শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইমন, সুনামগঞ্জের সাংবাদিক মোহাম্মদ মাহতাব উদ্দিন তালুকদার, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজাম মুনিরা,যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের পিএইচডি গবেষক মাইদুল ইসলাম, রংপুরের শিক্ষক আফরোজা সরকার,বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সভাপতি দিলীপ রায়, মালয়েশিয়া প্রবাসী রাজনীতি বিশ্লেষক এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন চট্টগ্রাম মহানগরে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মারুফ হোসেন, চট্টগ্রামের মানবাধিকার কর্মী ইঞ্জিনিয়ার শাহনেওয়াজ চৌধুরী, ডি. এস. এ ভিক্টিমস নেটওয়ার্ক আহ্বায়ক গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার, সদস্য সচিব প্রীতম দাশ এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন সমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া।