জীবন লক্ষ্যের দ্বার প্রান্তে ঢাবি চারুকলার সহকারী অধ্যাপক ড. সীমা ইসলাম

প্রকাশ: শুক্রবার, ০৩ অগাস্ট, ২০১৮
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png উজ্জ্বল এ গমেজ
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
 ‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে . .  . ’। জনপ্রিয় এই গানটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কেউ যদি নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারেন, তাহলে তার স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই। চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সীমা ইসলাম সেটিই যেন প্রমাণ করে দেখালেন আরও একবার। শৈশবে রাজনীতি করার স্বপ্ন দেখতেন। সময়ের পালা-বদলে তিনি হয়েছেন রাজধানীর শীর্ষ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা। 

ক্যাম্পাসে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পা ভাঙ্গাসহ লাঠিপেটা খাওয়া শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসংখ্যবার হয়েছেন সংবাদ শিরোনাম। এখন তিনি চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের সহকারী  অধ্যাপক।

অদম্য আত্মপ্রত্যয়ী কিশোরী সীমার এই সহকারী অধ্যাপক ড. সীমা ইসলাম হয়ে ওঠার গল্পের পেছনে রয়েছে আরও অনেক কথা। জীবনের প্রতিটা ধাপে ধাপে রয়েছে নানান চড়াই-উৎরাই পেরুনোর দুঃখ গাঁথা। 

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবড়িয়া গ্রামে জন্ম সীমা ইসলামের। সরকারি চাকুরে বাবার পোস্টিংয়ের কারণে তার শৈশব ও কৈশোর কাটে জামালপুর সরিষাবাড়ী থানা সদরে সাতপোরায়। বাবা নুরুল ইসলাম ছিলেন পাটশিল্প ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মা হাছনা বেগম একজন আদর্শ ও শিক্ষিতা গৃহকর্তী। দুই ভাই ও দুই বোনো মধ্যে সীমা তৃতীয়। 

বড় বোন রোকসানা ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে শাহজালাল ইসলামি ব্যাংকে কাজ করছেন।   বড় ভাই মনিরুল ইসলামও অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেছেন ঢাবি থেকে। এখন চাকরি করছেন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ছোট ভাই মুনজরুল ইসলাম ঢাকা কলেজে ইতিহাস বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেছেন। ইতিহাস বিভাগে তার মেধা তালিকায় পজিশন ছিল চতুর্থ। এখন তিনি ঢাবিতে চাকরি করছেন।

ছোটবেলা থেকেই সীমা ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে মেধাবী ছাত্রী, ক্লাস ক্যাপ্টেন বা টিম লিডার, নৃত্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী, গায়িকা, খেলোয়ার, লেখক ও কবি। কথায় কথায় কিছুক্ষণের জন্য সীমা হারিয়ে যান শৈশবের দিনগুলিতে। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার নাচ, গান, খেলাধুলা করা ও শেখার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিল। থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ব্যাটমিন্টন, ভবিবল খেলায় পুরস্কার পেয়েছি। একইভাবে নাচ, গান করেও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছি। এসব নানান কিছু করেও ক্লাস ওয়ান থেকে নিয়মিত ভাল রেজাল্ট করেছি। স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে খুব আদর করতেন।

বিজ্ঞান বিভাগে সরিষাবাড়ি সরকারি পাইলট উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সরিষাবাড়ী মাহমুদা সালাম মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি প্রথম বিভাগে পাস করেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই কিশোরী।

ছোটবেলা থেকেই সীমা ছিলেন বাবা ও বড় ভাইয়ের ভক্ত। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। সবসময় বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করতেন। শৈশবে বাবা যখন গল্প বলতেন তখন সব সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ, নীতি, মূল্যবোধ ও তার বিভিন্ন গুণের কথা বলতেন। তার কালজয়ী ও ঐতিহাসিক ভাষণগুলোর কথা বলতেন এবং সেগুলোর ভিডিও দেখাতেন। বিষয়গুলো আমার শিশু মনে দোলা দিতো। আর মনে মনে ভাবতাম বড় হয়ে বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শ সৈনিক হবো। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জীবনে কাজে বাস্তবায়ন করবো।

১৯৯৭ সাল। সীমার পরিবারে নেমে আসে দুঃখের কালো ছায়া। চার ভাই-বোনই স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছিলেন। সীমা বলেন, হঠাৎ করেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবার গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। শুরু হয় তার উন্নত চিকিৎসা। অন্যদিকে চার ভাই-বোনের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাসহ পরিবারের সকলের ভরণ-পোষণের খরচ। সংসারে শুরু হয় একটা টানাপোড়েন। তখন পরিবারের হাল ধরেন বড় ভাই মনিরুল ইসলাম। তিনি ঢাবির অনার্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। থাকতেন  ঢাবি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতেন। সেটা দিয়ে নিজে চলতেন ও পরিবারে সাহায্য করতেন।

সীমা শৈশবে স্বপ্ন দেখতেন পরিণত বয়সে ডাক্তার হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করার। এইচএসসি পাস করার পর এখন সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে মেডিকেলে ভর্তির পালা। বিধিবাম। মেডিকেলে ভর্তির সব প্রস্তুতি শেষ। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। মেডিকেলে আর ভর্তি পরীক্ষা দেয়া হলো না তার। মনে একটা বড় হোঁচট খান স্বপ্নবাজ এই তরুণী।

ছয়জন সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা অসুস্থ। তখন পরিবারের হাল ধরেন বড় ছেলে। বোনের মনের এই অবস্থা দেখে বড় ভাই বলেন, তুমি তো ক্যামিস্ট্রিতে খুব ভাল। তাহলে ইডেন মাহিলা কলেজে চেষ্টা করে দেখো। চান্স পেলে ভর্তি হয়ে যাও।

তখন বড় ভাইয়ের পরামর্শে ইডেনে ভর্তি পরীক্ষা দেন তিনি। ক্যামিস্ট্রিতে চান্স পান সীমা। তার ভাষ্য, ইডেনে চান্স পেয়েও সেখানে পড়তে মন টানছিল না। বড় ভাই ও বোন ঢাবিতে থাকায় তখন তাদের সাথে পড়ার চিন্তা করি। তখন ঢাবির সব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শেষ। শুধু চারুকলা ইউনিটেরটা বাকি ছিল। বড় ভাই পরামর্শ দিলেন ফরম তুলে এখানেই চেষ্টা করো। পরীক্ষা দিয়ে চান্স পাই।  

১৯৯৯ সাল। সীমা ঢাবির চারুকলা অনুষদে ভর্তি হন। শুরু হয় প্রথম সেমিস্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের দিনগুলি কাটছিল বেশ ভালই। চারুকলায় ভর্তির পর সীমার শুরু অন্যরকম এক যুদ্ধের জীবন। বড় বোন রোকসানা ইসলাম তখন ঢাবিতে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে অনার্সে চতুর্থ বর্ষে ছিলেন। থাকতেন বেগম রোকেয়া হলে। বোনের হলে একই সিটে দুজনে শেয়ার করে থাকা শুরু করেন তারা।

প্রকৃতির নিয়মে আসে সীমার ইয়ারলি পরীক্ষা। তখন গভীর রাত। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ হলের দাদু তাকে দেন এক দুঃসংবাদ। সীমা বলেন, রাত আড়াইটা। দাদু এসে বলেন, আপনার ভাই এসেছে। আপনার বাবার অবস্থা খুব খারাপ। এখনই আপনাকে ঢাকা মেডিকেলে যেতে হবে। তখন ভাইয়ের সাথে মেডিকেলে যাই। গিয়ে দেখি বাবা আর নেই। চলে যান না ফেরার দেশে।   আকষ্মিক এই ঘটনায় মানসিকভাবে ভীষণ কষ্ট পাই। থেমে যাইনি। 

বাবার স্মৃতিচারণ করে সীমা বলেন, ব্যক্তি হিসেবে বাবা ছিলেন খুবই মেধাবী ও সৃজনশীল একজন মানুষ। গান, কবিতা ও ইংরেজিতে গ্রামার বই লিখতেন।   এলকায় তার বাবার একটা আলাদা পরিচয় ছিল। ইসলাম সাহেব বলে সবাই তাকে এক নামে চিনতেন। এক পরিবার থেকে তিনজন ছেলে-মেয়ে ঢাবিতে পাড়শোনা করার জন্য এলকার সবাই এখনও ইসলাম সাহেবের পরিবারকে শিক্ষিত  হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে।

বাবা নেই। চার ভাই-বোনই তখন ঢাকায় পড়াশোনা করছিলেন। মা একা থাকেন জামালপুর। এখন  কী হবে? কীভাবে চলবে মা, আর কে দেবে সবার পড়াশোনার খরচ? কোন আগপিছ চিন্তা না করেই মাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন ভাই-বোনরা। এবিষয়ে তিনি বলেন, বাবা ছিলেন আমার ভরসা। তার অবর্তমানে বড় ভাই পরিবারের হাল ধরলেও আমিও জীবন যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হই। আমার প্রতিদিন ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট করার জন্য অনেক রঙ কিনতে হতো। পেন্টিং করতে ভাল রঙ প্রয়োজন হতো। এতো টাকা দেবে কে? তখন নিজের পড়াশোনা ও হাত খরচ এবং মার থাকা খাওয়া খরচ চালানোর জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি ধানমন্ডি টিউটোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। 

প্রত্যেকজন ছাত্র-ছাত্রীর জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা একটা স্বর্ণালী অধ্যায় হয়ে থাকে। ক্লাস, পড়াশোনা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা, মজা-মাস্তি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কাটে রঙিন দিনগুলি। ভাগ্যদেবী সীমার প্রসন্ন হয়নি। তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। 

ক্যাম্পাসের দিনগুলির স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে ছয়টায় ওঠতাম। সকালে যে ড্রেস পরে যাবো সেটি আগের দিনই পরে, মুখে হালকা মেকাপ করে রাতে ঘুমাতাম। কারণ সকালে ওয়াশরুমের সিরিয়াল লম্বা হতো। সকালে তাড়াহুড়ো করে কোনরকমে রেডি হয়ে ঢাবি থেকে ধানমমিন্ড কখনও পায় হেঁটে বা লেগুনাতে করে যেতাম। সাতটায় ধানন্ডি টিউটোরিয়াল স্কুল শুরু।  ক্লাস শেষে ১১টায় এসে আবার নিজের ক্লাস করতাম। দুপুর ২টায় শেষ করে কোনরকম খেয়ে বিকাল তিনটা থেকে  আজিমপুরে লেডিস ক্লাবে ড্রয়িংয়ের ক্লাস নিতাম। এরপর বেগম বাজারে একটা টিউশনি করে হলে ফিরতাম সন্ধ্যা ৭টার দিকে। সারাদিন ব্যস্ততার কারণে প্রতিদিন রাতে গোসল করতে হতো। শুক্রবারে চারটা টিউশনি করেছি। এভাবেই চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রঙিন দিনগুলি।

আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহসের জন্য অল্পদিনের মধ্যেই রুমমেটদের সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন সীমা। তিনি বলেন, রোকেয়া হলে ওঠে দেখি জুনিয়র মেয়েদের সব সময় বিভিন্ন ভাবে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মেয়েদের প্রতি যেকোনো অন্যায় করা হলে বা হলে কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে আমি তার প্রতিবাদ করেছি। এসব বিষয়ের জন্য রুমমেটরা আমাকে পছন্দ করা শুরু করে।

ঢাবির হল ছাত্ররাজনীতির সাথে যোগ দেয়ার বিষয়টা সীমাকে সব সময় ভাবাতো। প্রথম বর্ষে দেখতেন হল ছাত্রলীগের সিনিয়র আপুরা যখন মধুর ক্যান্টিনে যেতেন তখন তার সাথে আরো অনেক আপুরা যেতেন। আস্তে আস্তে রুমমেটদের সাথে বন্ধুত্ব হলে তাদের সাথে মধুর ক্যান্টিনে যাওয়া শুরু করেন সীমা। এভাবে তার পরিচিতি বাড়তে শুরু করে। তার কথা, কাজ, ব্যবহার এবং জীবনযাপনশৈলী দেখে রুমমেটরা তার প্রতি আন্তরিক হন। নানাভাবে সহযোগিতা করতে শুরু করে। কেটে যায় প্রথম বর্ষ।

সীমা তখন দ্বিতীয় বর্ষে। একদিন জানতে পারেন ঢাবির হল ছাত্রলীগের নির্বাচন হবে। সীমা বলেন, ছাত্রীদের অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দিতে মনের ইচ্ছার কথা একজন আপুর কাছে প্রকাশ করি। তখন রুমমেটরা আমাকে নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করে। তারা আমাকে ফরম তুলার কথা বলে। এক রুমমেট ফরম তুলে পূরণ করে জমাও দিয়ে দেন। ওই নির্বাচনে নাসরীন আপা ঢাবির রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক এবং সংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন বর্তমান বিবার্তা২৪ডটনেটের সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি।

সব সময় ছাত্র আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্বে দিয়েছেন সীমা। তিনি বলেন, তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। সময়টা ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং। প্রায় সময়ই নানান ইস্যুতে সভা-সমাবেশ, মিছিল, আন্দোলন হতো। সংগঠনের সেক্রেটারি হিসেবে সেগুলোতে যোগ দিতাম। কখনও ক্লাস আবার কখনও প্রাকটিকেল পরীক্ষা রেখেই চলে গেছি। পরে সময় করে সেগুলো দিতাম।

মিছিল, মিটিং ও আন্দোলনের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে যান সংগ্রামী এই ছাত্র নেতা। তিনি বলেন, ছাত্রনেতা হিসেবে সব সময় আমার বাবার আদর্শ বুকে ধারণ করেছি। বাবা চাকরির জীবনে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কখনও কারো কাছ থেকে কোন ঘুষ নেয়নি। সৎপথে ছিলেন। সুযোগ পেলে মানুষের উপকার করেছেন। অন্যায় হতে দেখলে প্রতিবাদ করেছেন। সে শিক্ষা আমার জীবনে ধারণ করেছি। ছাত্র-ছাত্রী ও দেশের ন্যায্যতা এবং অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছি। এই  অধিকার আদায় করতে গিয়ে অসংখ্যবার পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েছি। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছি। একবার পুলিশরা পিটিয়ে আমার পা ভেঙ্গে দিয়েছিল। তবুও দমে যাইনি। আন্দোলন চালিয়ে গেছি। এভাবে চলতে চলতে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিকে হৃদয়ে ধারণ করে ফেলি। মনের জোর বেড়ে যায় দ্বিগুন। 

ঢাবির রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে  অদম্য সাহসিকতা ও দক্ষ নেতার পরিচয় দিলে পরে সীমাকে ঢাবির ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়।

ছাত্রনেতা হিসেবে সীমা ছিলেন একজন আত্মত্যাগী। চতুর্থ বর্ষে তাকে আলাদা রুম দেয়া হয়। তখন তিনি নিজের রুমে নতুন ছাত্রীদের বেডে ঘুমাতে দিতেন। তিনি ঘুমাতেন ফ্লোরে। সীমা বলেন, হলের জীবনে আমি শুরু থেকেই ফ্লোরে ঘুমিয়েছি। আর যারা বেড পায়নি তাদের আমার বেডে ঘুমাতে দিয়েছি। এক দিকে প্রতিদিন টিউশনি করে রাতে গোসল করতে হতো। অন্যদেক ফ্লোরে ঘুমাতাম। এভাবে একটা সময়ে এসে ঠাণ্ডা লেগে গলায় টনসিল ইনফেকশন হয়। পরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত স্যার সেটি অপারেশন করেন। স্যার আমাকে নিজের হাতে যত্ম করে অপারেশনটা করে দিয়েছেন। কোন পারিশ্রমিক নেননি। স্যারকে আজ এই লেখনির মধ্য দিয়ে কৃতজ্ঞতা ভরে ধন্যবাদ জানাই।

সময়ের পালা-বদলে অনার্সের চতুর্থ বর্ষ সফল ভাবে শেষ করেন সীমা। অনার্সে পড়ার সময় ক্যাম্পাসে তার পরিচয় হয় বিমান বাহিনীর এক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট   ভাইয়ের সাথে। উনি চট্টগ্রামে বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। সময় করে ঢাবির ক্যাম্পাসে আসতেন। দেখা হতো।  

সীমা বলেন, আমি তো ক্লাস, পড়াশোনা, টিউশনি আর ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বিজি থাকতাম। এর বাইরে প্রেম-ভালোবাসা করার তেমন সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে ছেলেটা আমাকে প্রপোজ করে। সব খুঁজ-খবর নেয়ার পর জানতে পারি মানুষ হিসেবে ছেলেটা ভাল। তাই  তার সাথে মিশতে শুরু করি। টিউশনিতে যাওয়া-আসার পথে মাঝে-মধ্যে সে আমার সাথে দেখা করতো। এভাবে সময় চলতে থাকে। তখন মাস্টার্সে প্রথম বর্ষে। একদিন সে আমাকে জানালো আমি তো চীনে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। বিবাহিতদের পরিবারসহ যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তোমার মত থাকলে আমরা বিয়ের বিষয়ে আগাতে পারি। পরে তাড়াহুড়ো করে পারিবারিকভাবেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলি। আমার বাবা না থাকলেও তার ভূমিকা পালন করেছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক। তখন মাস্টার্সের সেসন জট ছিল। দুজনে চলে যাই চীনে। এক বছর যেতে না যেতেই ঢাবি থেকে খবর আসে ক্লাস শুরু হচ্ছে। তখন আবার দেশে চলে আসি।

শুরু হয় তার মাস্টার্সের দ্বিতীয় বর্ষের পড়াশোনা। একদিকে শ্বশুরের পরিবার, অন্যদিকে পড়াশোনা। একসাথে দুদিক সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল দেখে শাশুড়ি তাকে হোস্টেলে থেকে ক্লাস করার অনুমতি দেন। সীমা বলেন, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ও ভাসুর খুব ভাল মানুষ। স্বামীও খুব ভাল। সব কিছুতে সাপোর্টিভ মাইন্ডের। ওনাদের সহযোগিতার জন্য আমি মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হয়েছি।

মাস্টার্সের রেজাল্ট প্রকাশের পর মিষ্টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যান সীমা। ওই দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার রেজাল্টে পরিবারের সবাই অনেক খুশি হন। তখন আমার শাশুড়ি, ভাসুর আমরা তিনজনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাই। যখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি তখন তিনি আমার মাথায় হাত রাখেন। পরম মমতায় কাছে টেনে আশীর্বাদ করেন। আমি বলেছিলাম আপা, আমি আপনার হলের সেক্রেটারি। ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে চাই। আপনার কাছে থাকতে চাই। তখন তিনি বলেছেন, পাগলি মেয়ে, রাজনীতি করবে ভাল কথা। এখন তোমার বয়স হয়নি। বয়স হোক। তখন করবে। আর তুমি তো অনেক ব্রিলিয়েন্ট ছাত্রী। তুমি ঢাবিতে শিক্ষকতা করো।

স্বামী সব সময় সীমাকে বলতেন তুমি যদি ঢাবির শিক্ষক হও, তাহলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবো। বিষয়টা তাকে প্রেরণা দিতো। অবশেষে ২০১০ সালে তিনি ঢাবিতেই চারুকলা গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের  প্রভাষক হিসেব শিক্ষকতা শুরু করেন। শুরু হয় তার শিক্ষকতার নতুন জীবন। সেই সময়ে ঢাবির উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও উপ উপচার্য ছিলেন  অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ স্যার। দুইজন স্যারসহ বর্তমান উপ উপচার্য প্রশাসন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. সামাদ স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

মাস্টার্সে ভাল রেজাল্ট করায় স্কলারশীপে পিএচডি করার সুযোগ পান সীমা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমানের অধীনে এই পিএচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এই ডিগ্রি করার সময় বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ, জাবির নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সাবেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. আফসার আহমেদ, চারুকলার অধ্যাপক ফরিদা জামান, অধ্যাপক জামাল আহমেদ ও বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ।

২০১৮ সালে ৪ ডিসেম্বরে চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সীমা ইসলামকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী সহকারী প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯২১ সালে ঢাবি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো নারী, সহকারী প্রক্টর নিয়োগ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। সীমা ইসলাম হলেন ঢাবির ইতিহাসে প্রথম নারী সহকারী প্রক্টর। 

প্রক্টর হিসেবে ঘোষণার অনুভূতি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যখন ছাত্রী ছিলাম তখন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতাম। পুরুষ প্রক্টরের কাছে স্বাভাবিকভাবে সব কথা বলতে পারতাম না। এখন মেয়রা নির্দ্বিধায় সব কথা বলতে পরেন। এমন সুন্দর উদ্যোগ নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানকে ধন্যবাদ জানাই। 

জীবনের অর্জন বিষয়ে সীমার ভাষ্য, ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করার পাশাপাশি রাজনীতি করার স্বপ্ন দেখতাম। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কখনো প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারবো, সেটা ছিল অলীক স্বপ্নের মতো। সেটাও বাস্তবে রূপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ পেয়েছি। ছাত্ররাজনীতি করার সুবাদে অসংখ্যবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। বিনিময়ে রোকেয়া হলে বিভিন্ন বড় অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের স্যার, মির্জা আজমের মতো সিনিয়র নেতাদের পাশে বসে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ হয়েছে। 

উনাদের স্নেহ-ভালোবাসা ও দোয়া আশীর্বাদ পেয়েছি। সাথে আছে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ। সেসাথে পেয়েছি একজন আদর্শ ও ভাল মনের স্বামী। পরিচয়ের পর থেকে সব সময় ভাল বন্ধু হিসেবে সব কিছুতে পাশে থেকেছে। বিশেষ করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভে তার অবদান অনেক বেশি ছিল। সারাদিন  ফ্লায়িং শেষ করে রাতে আমার পাশে বসে ছিলেন যাতে আমি ঠিক মতো পড়াশোনা  করতে পারি। স্বামী গ্রুপ ক্যাপ্টেইন মেজবাহর একমাত্র মেয়ে সামিহা মিসবাহর মতো এমন সুন্দর পরিবার পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।

ছবি আঁকা এখন নেশা ও পেশা দুটোই তার। সময় পেলেই বসে যান রঙতুলি নিয়ে। জীবনে অ্যাঁকেছেন অসংখ্য ছবি। বিভিন্ন ধরনের ছবি আঁকতে পছন্দ করেন তিনি। এসব ছবি স্থান পেয়েছে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তার ছবি কিনে নিয়েছেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে আত্মপ্রত্যয়ী চারুকলার এই সহকারী অধ্যাপক বলেন, শিক্ষকতাকে উপভোগ করছি। ছবি আঁকাআঁকিকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। সেসাথে রাজনীতি করার পরিকল্পনা রয়েছে। সুযোগ হলে রাজনীতি করতে চাই।
image

আপনার মতামত দিন