সুমা রোজারিও
নিজের দেশ, ভিটে-মাটি, বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের স্নেহ, মায়া-মমতা ও ভালোবাসা ছেড়ে মানব সেবার ব্রত নিয়ে যারা মানুষের সেবা করতে বাংলাদেশে আসেন, তাদের জীবনযাপনটা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো না।
নতুন দেশ, পরিবেশ, আবহাওয়া, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মানুষ সব কিছুর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের জীবনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। এমনই একজন মানব সেবায়ব্রতী তেইজে ব্রাদার গিয়োম।
ব্রাদার গিয়োম মানব সেবার টানে নিজের প্রিয় জন্মভূমি নেদারল্যান্ড এবং বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সব ছেড়ে এসেছেন বাংলাদেশের মাটিতে। কাজ করছেন দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে।
তিনি বর্তমানে আছেন ময়মনসিংহ জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত কাচিঝুলি তেইজে ব্রাদার হাউজে। কাজ করছেন মানব সেবায়।
১৯৪৬ সালের ১৫ এপ্রিল নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন ব্রাদার গিয়োম। সেখানেই তার বেড়ে উঠা। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বাবা-মরিনিস ও মা-বেলহামিনা।
বাবা-মা দুজনে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতেন। নিজের এলাকায় গরীব, দুঃখী ও অসুস্থদের জন্য নিয়মিত প্রার্থনা এবং দেখতে যেতেন। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার আদর্শে ও খ্রিস্টিয় শিক্ষায় বড় হন ব্রাদার।
বাবা-মায়ের কাজ ও প্রার্থনাপূর্ণ আদর্শের জীবন দেখে ছোটবেলা থেকেই ব্রাদারের শিশু মনে ইচ্ছা জাগে বড় হয়ে ঈশ্বরের জন্য কাজ করার। মানব সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে ফ্রান্সে তেইজে ব্রাদার সম্প্রদায়ে যোগদেন।
১৯৭০ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি সন্ন্যাসব্রতী ব্রাদার জীবনে ব্রত গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ ডিসেম্বরে মশিনারি কাজের জন্য তিনি বাংলাদশে আসেন। ৪৪ বছর ধরে তিনি নিরলসভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন পালকীয় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তার বয়স ৭৪ বছর।
১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে তেইজে ব্রাদারগণ বাংলাদেশের চট্টগ্রামে পালকীয় সেবা কাজ শুরু করেন। তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষেব পাশে থেকে প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে আসছেন। সহজ-সরল ও অতি সাধারণ সাদামাটা জীবনযাপন করেন তারা। গরীব অসহায়দের সহায় ও বন্ধু হয়ে কাজ করেন এই ব্রাদারগণ।
বাংলাদেশে এসে প্রথমে তিনি চট্টগ্রামে পালকীয় সেবা কাজ শুরু করেন। সেখানে তরুণ-তরুণীদের সাথে নিয়ে, হতদরদ্রি ও প্রতিবন্ধীদের সেবা দান করেন। তিনি বাঙালি ও আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরির উদ্দেশে বিভিন্ন গঠনমূলক সেমিনারের আয়োজন করেন। চট্টগ্রামে পাঁচ বছর কাজ করেন এই মানবপ্রেমী।
এরপর আসেন ঢাকায়। সেখানে তিনি ছয় বছর একই পালকীয় সেবা কাজ করেন। ঢাকা থেকে ১৯৮৭ সালে যান ময়মনসিংহ জেলায়। সেখানে প্রায় ৩৩ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি।
১৯৮৮ সালে ঢাকায় তিনি গারো সম্প্রদায়ের জন্য একটি কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টারটি ‘নকমান্দি’ নামে পরিচিত।
দীর্ঘ এই পালকীয় সেবার জীবনে তিনি অনেক সেবামূলক কাজ করেছেন। ঢাকা ও ময়মনসিংহে অসুস্থ, প্রতিবন্ধী পথশিশুদের নিয়ে নানান ধরনের কার্যক্রম করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ব্রাদার বলেন, গ্রাম-বাংলার মানুষেরা বিশেষ করে ময়মনসিংহের সকলে আমাদের অনেক আপন করে নিয়েছেন। শত ত্যাগ, কষ্ট ও চ্যালেঞ্জের পরেও আমাদের পাশে আছেন। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
ময়মনসিংহ জেলায় যাওয়ার পর শুরু থেকেই তিনি গির্জায় পবিত্র খ্রিস্টযাগের সময় গারো আচিক ভাষায় লেখা গানগুলো করার ব্যাপারে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এবং তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ব্রাদারের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিক চেষ্টায় বর্তমানে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের সব গির্জায় পবিত্র খ্রিস্টযাগের সময় গারো ভাষায় গান গাওয়া হচ্ছে।
ব্রাদারের দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক কল্যাণমূলক কাজের মধ্যে অন্যতম হলো তিনি জেলে বন্দিদের নিয়ে দীর্ঘ দিন বিভিন্ন ধরনের কাজ করে আসছেন। এসব কাজের মধ্যে বন্দিদের খোঁজ-খবর নেয়া, আর্থিক, মানসিক ও আধ্যাত্বিকভাবে সহযোগিতা করা। এমনকি জেল থেকে বের হবার পর ওই বন্দিকে সুন্দর জীবনের জন্য তিনি সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছেন।
মানুষের সেবায় ব্রতী ব্রাদার দরিদ্রদের দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হন। তাই অসংখ্য দরিদ্র যুবকদের বিশেষ করে যাদের পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা করতে পারছে না, তিনি তাদের শিক্ষায় বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন।
আন্তঃমাণ্ডলিক ঐক্যের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন ব্রাদার। যুবক-যুবতীদের নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন গঠনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বর্তমানে করোনার প্রভাবের কারণে তিনি স্বল্প পরিসরে কাজ করছেন।
মানব কল্যাণে ব্রতী ব্রাদার নিজের কাজের জন্য কোনো প্রতিদান চান না। বাংলাদেশে এসে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে তিনি নিরবে নিভৃতে থেকে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে কোনো কিছুর আশা ছাড়াই শুধু দিয়ে আসছেন।
সূর্যের আলোকে যেমন কোনোভাবে ঢেকে রাখা যায় না। তার আলো পৃথিবীকে আলোকিত করে। ঠিক তেমনিভাবে ব্রাদারের মানব কল্যাণমূলক কাজের দ্যুতিও কোনোভাবে গোপন রইল না। মানুষের নজরে এসেছে। মানুষকে আলোকিত করেছে।
ব্রাদারের এই মহান কাজের জন্য তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন নিজের মাতৃভূমি নেদারল্যান্ডের রাজা।
প্রতি বছর নেদারল্যান্ডের রাজা ২৭ এপ্রিল কিংস ডে উপলক্ষে বিশেষ কাজের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড দিয়ে থাকেন।
৪৪ বছর ধরে বিভিন্নভাবে মানুষের কল্যাণে সেবামূলক কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিশেষ অবদানের জন্য ব্রাদার গিয়োমকে এবার ‘অ্যাওয়ার্ড অব দ্য কিং’সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
এবছর বৈশ্বিক মহামাররি করোনা কারণে কিংস ডে উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান জাকজমকপূর্ণভাবে করা সম্ভব হয়নি। তবে গত ৯ অক্টোবর পুরানো ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চে সন্ধ্যায় এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রাদারের হাতে অ্যাওয়ার্ড অব দ্য কিং সম্মাননা তুলে দেয়া হয়।
ব্রাদারের হাতে এই সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশস্থ নেদাল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত মি. হ্যারি এবং উনার স্ত্রী আকিয় ওকামা। সেই সাথে সম্মাননা হিসেবে ব্রাদার গিয়োমকে নেদারল্যান্ডের রাজার ব্যাজ পরানো হয়।
অ্যাওয়ার্ড অব দ্য কিং সম্মাননা পেয়ে ব্রাদারের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, এ সম্মাননা আমার নয়। ঈশ্বরের জন্য কাজ করতে আমি নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন, এমনকি দেশ ছেড়েছি। যার জন্য কাজ করে এ পুরস্কার পেয়েছি এটা হলো তার (ঈশ্বরের)। আমি ঈশ্বরের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। তিনি যদি নাই চাইতেন তাহলে আমার এ পর্যন্ত আসা হতো না। আর এতো কাজ করাও সম্ভব হতো না। কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ বাংলাদেশের সাবাইকে যাদের জন্য আমি সেবামূলক কাজ করতে পেরেছি।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে মানবপ্রেমী এই ব্রাদারের ভাষ্য, বাংলাদেশে এসে প্রথমে চট্টগ্রাম, রাজধানী ঢাকায় এবং পরে মনমনসিংহে কাজ করছি। এভাবে সুস্থ থেকে মানুষের কল্যাণে মানব সেবা করেই যেতে চাই। এখন করোনার প্রভাবে কার্যক্রম একটু কম করছি।
এ দুর্যোগ চলে গেলে আরো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে যুবক-যুবতীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। তাদের মধ্যে অফুরান শক্তি দেখতে পাই। তাদের মাঝে আছে অফুরান সম্ভাবনা। এই তারুণ্যকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে দেশের জন্য মানব সম্পদে পরিণত করতে পারলে তাই গারো খ্রিস্টান সমাজের নেতৃত্ব দেবে। তাদের মধ্যে নতুন নেতৃত্ব দেখতে চাই। আর মানুষের সেবায় বাকি জীবনটা উৎসর্গ করতে চাই।