শিক্ষক জাকিয়া সুলতানা মুক্তা, একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর

প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png উজ্জ্বল এ গমেজ
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
ছোটবেলায় আমি শান্ত প্রকৃতির ছিলাম। চুপচাপ চিন্তা করতে পছন্দ করতাম। যারাই একটু আলাদা চিন্তা করতেন, তাদের নিরবে অনুসরণ করতাম। তাই পরিবার-সমাজ-দেশের যেকোনো অন্যায়-অতাচার, নির্যাতন, শোষণ-বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা এসব বিষয়গুলো আমাকে খুব ভাবাতো। চোখের সামনে কোনো অন্যায় দেখলে মনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হতো। একটা সময়ে এসে সব জায়গাতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করি। পরিণত বয়সে দেশের সংকটকালে ও অসম্প্রদায়িকতার পক্ষে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। এখনও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করছি।

এভাবেই নিজের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) সহকারী অধ্যাপক ও বাংলা বিভাগের সভাপতি জাকিয়া সুলতানা মুক্তা।


ছোটবেলার ভাবনা ছিল বড় হয়ে দার্শনিক হবো। দেশ ও মানুষের কল্যাণে যৌক্তিক দর্শন ছড়িয়ে দিতে কাজ করবো। সবসময় চিন্তার জগতে বিচরণ করবো। লেখালেখি, গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকবো। সময়ের পালা বদলে এই চাওয়া বদলে যায়। কারণ আমি যা করতে চাই এদেশের বাস্তবতায় তা করতে গেলে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তখন এমনটাই ছিলো আমার চিন্তা। এখানে আমার সব চিন্তার প্রতিফলন ঘটানোও সম্ভব। আজ আমার সে ভাবনা- চিন্তা বাস্তবে রূপ নেয়ার পথে। অনেকটা উচ্ছাসের সাথেই বললেন আত্মপ্রত্যয়ী মুক্তা।

কথা প্রসঙ্গে জানা গেলো, গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে হলেও জাকিয়া সুলতানা মুক্তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। বাবা প্রকাশক ও বই ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। তারা দুই ভাই এক বোন। তিনজনের মধ্যে সবার বড় মুক্তা। মেঝো ভাই পড়াশোনা শেষ করে একটা বেসরকারি রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। ছোট ভাই পড়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। মুক্তা মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে মাধ্যমিক ও বিসিআইসি কলেজ, মিরপুর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

স্কুল-কলেজে পড়াশোনাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। অন্য কোনো দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়ার সুযোগ ছিলো না। মুক্তা বলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে আমাকে নানান সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই পড়াশোনা করতে হয়েছে। তাই স্কুল-কলেজ জীবনে ছাত্র রাজনীতির সাথে তেমনভাবে যুক্ত হইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আদর্শিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভাগের বড় আপু-ভাইয়াদের সাথে রাজনীতির পাঠ নেওয়া শুরু হয়। তবে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হইনি। মাঝে মধ্যে রাজপথের বিভিন্ন আন্দোলন অংশগ্রহণ করেছি। বিশেষ করে আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছিলেন, সে আন্দোলন-সংগ্রামে অন্য আর সবার মতন আমিও আমার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যুক্ত থেকেছি। তবে খুব বেশি সক্রিয় না হওয়ায় রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো পদে ছিলাম না। তবে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠন সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলাম। যেমন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, সংবৃতা আবৃত্তি চর্চা ও বিকাশ কেন্দ্র, বিএনসিসি, আধুনিক ভাষা ইনিস্টিউটের ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম (জার্মান ও জাপানিজ ভাষা) ইত্যাদি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুনামের সাথে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছি। যদিও নানান প্রতিকূল পরিবেশের জন্য পড়াশোনাতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছি।

পরিবারে বাবা একমাত্র উপার্জনক্ষম হওয়ায় পড়াশোনা করা অবস্থাতেই নিজের দায়িত্বের কিছুটা ভার নিজেকেই নিতে হয়েছিলো মুক্তাকে। তাইতো স্নাতক সম্পন্ন করার পরপরই ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইন্টার্ন হিসেবে চাকরিতে যোগদান করতে হয়। পরে স্নাতকোত্তরে আরো ভালো ফলাফলের জন্য পরীক্ষার আগে স্বেচ্ছায় চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়। স্নাতকোত্তর শেষ । হঠাৎ বাবার ব্যবসায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। এবার শুধু নিজের নয়, পরিবারের দায়িত্বও তার কাঁধে এসে পরে। একদিকে মনের মধ্যে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন, অন্যদিকে জীবন বাস্তবতা।

মুক্তা অনেকটা বিষণ্ন কন্ঠে বলেন, মনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে শিক্ষকতার মতন কাঙ্ক্ষিত পেশায় যেতে অনেক সময় লাগতে পারে। আবার এমনও নয়, পেশা যাওয়াটা নিশ্চিত কিছু। তাই মনস্থির করলাম, যেখানে চাকরি হবে, সেখানেই শুরু করব। তারপর বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করতে থাকি। স্নাতকোত্তরের ফল প্রকাশের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ডার্ড গ্রুপে ভালো পদে আমার নিয়োগ হয়ে যায়। দুই মাস ওখানে কাজ করার পর গ্রামীণফোন থেকে একটা ভালো নিয়োগ প্রস্তাব আসে। তখন যোগ দেই গ্রামীণফোনে।

সময়টা ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন দুপুরের পর থেকে রাতের একটা পর্যন্ত ছিল মুক্তার অফিসের কাজের শিফট। রাতে টিভির পর্দায় ভেসে উঠলো কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে উত্তাল শাহবাগ। অজান্তেই তার মনে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। কাজ শেষ করে বাসায় ফেরেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা ফোন করে বলেন, ‘আমরা তো শাহবাগে দাঁড়িয়ে গেছি। তুই কোথায়?’ তখন রাত ১২টা। তার উত্তর ছিলো, ‘আমি তো মিরপুরে। এত রাতে আসা সম্ভব না। সকালে আসবো।’ কথা মতো সকালে শাহবাগে চলে আসেন তিনি।

এরপরের গল্পটা আরও চমকপ্রদ। মুক্তি বলেন, ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ১৯ মার্চ পর্যন্ত শাহবাগ আন্দোলনে ছিলাম। এর মাঝে তিন কি চারদিন অফিসে করেছি। ২০ মার্চ যখন অফিসে যাই। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ঢাবি'র ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় সমস্যা হলো, যখন দেশে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়, তখন তারা সব দায়িত্ব ভুলে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অফিস তো এভাবে চলে না। হয় দেশের কথা চিন্তা করেন। না হয় চাকরি করেন।’ আমি এক ঘণ্টার নোটিশে চাকরিটা ছেড়ে দেই। কেননা, একটা চাকরি গেলে আরেকটা পাবো। কিন্তু দেশের এই সমস্যায় আমাকে আন্দোলনে দাঁড়াতেই হবে।

ওই সময় শাহবাগে গণজারণ মঞ্চের আন্দোলনে গৌরব ’৭১ ও ঢাবির ছাত্র-ছাত্রীসহ অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনের নেতৃত্বের টানা প্রায় ছয় মাস আমি আন্দোলনে থেকেছি। একটা সময় অধিকাংশ মানুষ চলে গেলেও, দাবি আদায়ের জন্য অল্পসংখ্যক প্রতিবাদী মানুষ তখনও শাহবাগে অবস্থান করে যাচ্ছিলেন। তার মধ্যে একজন ছিলেন মুক্তা। তিনি বলেন, চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার নিয়মিত ঢাবি ক্যাম্পাসে যেতে শুরু করি। তখন এমফিল ও পিএইচডির একটা বিজ্ঞপ্তি চলছিলো। তাই এমফিলে ভর্তি হয়ে যাই। সপ্তাহে দুই দিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা করে ক্লাস করেছি। বাকি সময়টা শাহবাগে স্লোগান মুখর ছিলাম।

শাহবাগের আন্দোলন শেষ হলে, ঢাবি’র ক্যাম্পাসেই বেশি সময় কাটতো তার। একদিন আড্ডায় বন্ধুরা তাকে বলেন, ‘বাংলার বাঘ এ কে ফজলুল হক-এর রাজনৈতিক ভাবনার মতন আমাদেরও দেশের পক্ষে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের চেতনাটা, সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া উচিত। কারণ দেশে যেভাবে মৌলবাদের উত্থান হয়েছে, আমাদের একদম শেকড়ে গিয়ে কাজ করা দরকার। তুই না শিক্ষকতা করার স্বপ্ন দেখিস। তুই যদি একশ’ শিক্ষার্থীর সামনেও মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দেশবিরোধী পরিকল্পনার মতন নেতিবাচকতা বিষয়গুলো সম্পর্কে বলিস, তাহলে পাঁচজন তো অন্তত শুনবে-বুঝবে। একদিন তারাই দেখবি দেশের পক্ষে আমাদের মতো করে পরমতসহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিবে। আর কাজটা শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে খুব ভালোভাবে করা সম্ভব। চিন্তা করে দেখ, এই কাজটা তুই ভাল মতো পারবি। কত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে। চেষ্টা করে দেখ।’

মুক্তা বলেন, তারপর আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা শুরু করি। পূর্বের চাকরি ছেড়ে দেয়ার প্রায় আট মাস পর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) থেকে ডাক আসে। নিয়োগ বোর্ডের সামনে যথারীতি সাক্ষাৎকার দেই। একমাস পর সংবাদ আসে ওই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে বশেমুরবিপ্রবি’তে বাংলা বিভাগে যোগদান করি।

শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর শিক্ষকতার পাশাপাশি গোপালগঞ্জের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও কাজ করা শুরু করেন মুক্তা। এরপর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে যেসব অন্যায়-বৈষম্য, শোষণ, শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন, বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন লাঞ্চনা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে যখন যেখানে অন্যায়, অন্যায্যতা, বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন দেখেছি সাথে সাথেই নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্য থেকে সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক দুর্নীতিপরায়ণ উপাচার্যের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও জোর প্রতিবাদ করেছি। কখনো কখনো সমমনা সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে পত্রিকায় কলাম লিখেছি। আমি আমার সংগ্রাম ও আদর্শের জায়গায় একেবারেই অনঢ়। এখনও পর্যন্ত একচুলও আমার আদর্শ থেকে আমি সরে যাইনি। এর জন্য কর্মজীবনে নানাভাবে হয়রানির শিকারও হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরাগভাজন হওয়ার কারণে আমাকে অনেক সময় অনেক মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। আমার প্রতি অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা একটা সময় পর্যন্ত প্রতিদিনকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আমি আমার পেশায় অনেক দূর যেতে পারতাম, সেটাকে অপকৌশলে বারবার বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।

আপনার প্রতি কী ধরনের অন্যায় করা হয়েছে? মুক্তার ভাষ্য, দেখেন, আমি বশেমুরবিপ্রবি’তে নিয়োগ পাওয়ার আগেই ঢাবি'তে এমফিল ডিগ্রিতে ভর্তি হই। ডিগ্রির প্রথম পর্ব শেষ করে দ্বিতীয় পর্বের গবেষণার অংশটা বাকি ছিল। নিয়োগের সময়ই বিষয়টা বিশ্ববিদালয়ের কর্তৃপক্ষ জানত। কিন্তু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দোহাই ও কৃত্রিম শিক্ষক সংকট সৃষ্টি করাসহ শিক্ষক পদোন্নতির নীতিমালা না থাকার অজুহাতে এমফিলটা শেষ করার জন্য আমার প্রাপ্য শিক্ষাছুটি দেয়া হয়নি। অথচ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনেক সহকর্মীই বিনা অনুমতিতেও দিনের পর দিন ছুটিতে ছিলেন, যার কোনো জবাবদিহিতা কখনোই প্রশাসন নেয়নি। কারণ তারা ছিলেন আস্থাভাজন। আর আমি বিরাগভাজন।

এরপর যখন শর্তসাপেক্ষে ছুটি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন ডিগ্রির সময় শেষ। অথচ প্রথম পর্বের ভালো ফলাফলের জন্য আমি একটা ভালো স্কলারশিপও পেয়েছিলাম। যদিও সেটা পরবর্তী সময়ে আমার কোনো কাজেই লাগেনি। কেননা গবেষণাটাইতো আমি সম্পন্ন করতে পারিনি। ফলে এরপর যখন আমি আবার ভর্তি হতে গেলাম, আমাকে আমার বিভাগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়। বলা হলো, এবার পূর্ণ দুই বছরের শিক্ষাছুটি নিয়ে আসতে হবে এবং পিএইচডি নয়, এমফিলে ভর্তির জন্য নাকি আমাকে আবেদন করতে হবে। আমি মূলত পড়ে যাই এক দুর্ভাগ্যের দুষ্টুচক্রে। অন্যদিকে, আমাকে সময় মতন পদন্নোতিও দেয়া হয়নি। আমার নির্বাচিত গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে অনৈতিকভাবে বাধা দেয়া হয়েছে। নানাভাবে বিপদে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়েছে, যা আমাকে মানসিক ও পেশাগতভাবে হেয় করার নামান্তর।

কথায় কথায় মুক্তা জানান, নিজের জীবনের আদর্শ হিসেবে তিনি বিবেচনা করতেন নারীবাদী জনপ্রিয় লেখক ডাক্তার তসলিমা নাসরিন, ভাষাবিজ্ঞানী প্রাবন্ধিক ও কবি ড. হুমায়ুন আজাদ এবং প্রাবন্ধিক ড. আহমেদ শরীফকে। তাদের জীবনাচরণ ও জীবনদর্শন, ব্যক্তিত্ব, চিন্তার জগৎ, লেখালেখি সবকিছুই তাকে মুগ্ধ করতো। নব্বইয়ের দশকে তাঁদের নিয়ে দেশে অনেক বিতর্ক ছিলো। তাঁদের চিন্তা-চেতনা, লেখনি ছিলো প্রতিষ্ঠান বিরোধী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার। সমাজ ও দেশের মানুষের ভালোর জন্য এসব প্রতিবাদী চিন্তা ভাবনাই মুক্তাকে আর্কষণ করতো। অনুপ্রেরণা দিতো এমনভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে। একারণেই মুক্তা তাদের দর্শনকে একাগ্রভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে। এরপর নিজে থেকেই ওই ভাবনার আলোকে নিজের চিন্তাজগতকে সাজিয়েছেন। এই তিন আদর্শিক মানুষ তার প্রতিবাদী মনোভাবকে আরো স্বচ্ছ ও দৃঢ় করেছে। তাই যেকোনো অন্যায় দেখলেই তিনি প্রতিবাদমুখর হন।

মুক্তা তার আট বছরের শিক্ষকতার জীবনে অনেক কিছু অর্জন করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, বশেমুরবিপ্রবি’তে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন, পরিবার-সমাজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা দেশের যেকোনো অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ-বৈষম্য-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ করার শিক্ষা দেয়া- সেটি তিনি দিতে পেরেছেন। স্বচ্ছ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে তার একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে পরিচিত পরিমণ্ডলে। এমনকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীরা পাস করে বেরিয়েছেন, আর এখনো যারা আছেন- তারা অনেকেই যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশে মুক্তার সাথে নির্দ্বিধায় রাজপথে নামেন। তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার সংগ্রামে মুক্তাকে তারা পাশে পান। সবার কাছে এই আস্থার জায়গাটা তিনি তৈরি করতে পেরেছেন। তার প্রতি সংগঠিত সাম্প্রদায়িক উগ্রতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে এটা তার অন্যতম বড় পাওয়া বলে তিনি মনে করেন।

মুক্তা কেবল অন্যায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন-মিছিল, মানববন্ধনে বক্তব্য দেন না। লেখালেখির মাধ্যমেও প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করতে পছন্দ করেন। তিনি সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা, পারিবারিক-সামাজিক মনঃস্তত্ত, নারীবাদ, নিসর্গনারীবাদ বিষয়ে নিয়মিত মুক্ত মতামত ও কলাম লেখেন। এছাড়া তিনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, গান শুনতে, গবেষণাধর্মী বই পড়তে, ভ্রমণ করতে ভীষণ পছন্দ করেন।

চিন্তা ও চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন প্রতিবাদী এই লেখিকা। স্বপ্ন দেখেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম-নিরপেক্ষ সোনার বাংলা গড়ার কারিগরদের পাশে থাকার। গড়তে চান মুক্তচিন্তার বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে না কোনো অন্যায়-অবিচার। দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিদের মাঝেও এ চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত নিয়েছেন তিনি।
image

আপনার মতামত দিন