আমরা প্রায়ই অনুভব করি, পৃথিবীর আবহাওয়া আর আগের মতো নেই। বাংলাদেশে এখন শীত ও গ্রীষ্ম ছাড়া অন্য ঋতুগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। বছরের পর বছর ধরে পরিবেশের এই পরিবর্তন আসলে জলবায়ুর বড় পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দেয়।
বিশেষ করে ২০২৪ সাল ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উষ্ণতার রেকর্ড গড়া একটি বছর। বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন-এই উষ্ণায়ন যদি এভাবে চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের পৃথিবী একেবারেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
বৈশ্বিক সচেতনতা ও পদক্ষেপশুধু গবেষণা কিংবা আলোচনা নয়-বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেউ তাদের অর্থনীতিকে টেকসই ও পরিবেশবান্ধবভাবে পুনর্গঠন করছে, কেউ নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে, আবার কেউ রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
নবায়নযোগ্য শক্তিতে ডেনমার্কের নেতৃত্ব১৯৭৩ সালে তেলের সংকটের পর থেকেই ডেনমার্ক নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। বর্তমানে দেশটি অফশোর উইন্ড টারবাইনের মাধ্যমে বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়, ডেনমার্ক বিশ্বের প্রথম ‘এনার্জি আইল্যান্ড’ তৈরির কাজ শুরু করেছে, যেখান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সবুজ জ্বালানি সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। কৃষি ও মৎস্যনির্ভর সংস্কৃতি ডেনিশদের প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ তৈরি করতে সহায়তা করেছে।
রিসাইক্লিংয়ে সুইডেনের সাফল্যসুইডেনের ৯৯% বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা হয়, যা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়। দেশটি শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই নয়, পরিবেশদূষণ রোধ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার ও বিকল্প জ্বালানিভিত্তিক গণপরিবহনেও বিশ্বসেরা।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সবুজ নগরী গড়ছে জাপানজাপান তাদের 'স্মার্ট সিটি' প্রকল্পের মাধ্যমে এমন নগর তৈরি করছে, যেখানে বিদ্যুৎ, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় এবং পরিবেশবান্ধব। প্রতিটি জাপানি পরিবারে বর্জ্য ৮ ভাগে ভাগ করা হয়, যাতে কার্যকরভাবে রিসাইক্লিং সম্ভব হয়।
সূর্যভিত্তিক শক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছে ভারতভারত 'ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স' গঠনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সৌরশক্তির প্রসারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দিল্লি থেকে রাজস্থানের মরুভূমি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা সৌরপ্যানেল এখন শক্তির অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি 'গ্রিন ইন্ডিয়া মিশন' এর আওতায় দেশে ব্যাপক বনায়ন কার্যক্রম চলছে।
জৈব কৃষিতে অস্ট্রিয়ার অগ্রগতিঅস্ট্রিয়ার প্রায় ২৫% খামার এখন জৈব কৃষিনির্ভর। সরকারের সহায়তা, পরিবেশবান্ধব কৃষিনীতি এবং সচেতন ভোক্তাদের সহযোগিতায় দেশটি ইউরোপে অরগানিক চাষাবাদে শীর্ষে রয়েছে।
দূষণের বিরুদ্ধে লড়ছে চীনএকসময় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল চীন। বর্তমানে তারা নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ করছে। বেইজিং ও সাংহাই শহরে হাজার হাজার ইলেকট্রিক বাস ও বাইক চালু হয়েছে, যা শহরের বায়ু গুণমান উন্নত করছে।
পরিবেশসচেতন সুইজারল্যান্ডসুইজারল্যান্ডের ৬২% বিদ্যুৎ আসে জলবিদ্যুৎ থেকে। 'সুইসস্টেইনেবল' নামের উদ্যোগের মাধ্যমে দেশটির পর্যটন খাতেও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সূর্য ও লবণ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে চিলিদক্ষিণ আমেরিকার চিলি দেশের আতাকামা মরুভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। তারা লবণ-ভিত্তিক ব্যাটারির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংরক্ষণ প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও পিছিয়ে পড়াঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর। অথচ বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ, যেখানে সৌরশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি ও বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তবু বাস্তবায়নের ঘাটতি, জনসচেতনতার অভাব, এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালার দুর্বলতা বাংলাদেশকে পিছিয়ে রেখেছে।
আমাদের করণীয় কী?বাংলাদেশে একটি পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যৎ গড়তে চাইলে কেবল সরকারের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়-এখানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন:
>> নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
>> বন সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমে তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করতে হবে।
>> রিসাইক্লিং ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতে আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
>> পরিবেশশিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
>> কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, বাইসাইকেল ও ইলেকট্রিক যানবাহনের প্রচলন বাড়াতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর কোনো দূর ভবিষ্যতের বিষয় নয়, এটি আমাদের বর্তমান। তাই এখনই সময়-যৌথ উদ্যোগে পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার। সরকারের নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ-সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে একটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ এবং টেকসই বাংলাদেশ। সূত্র: এশিয়া নিউজ ও গ্লোবাল সিটিজেন সলিউশন