মানুষকে মহাকাশের প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নকে আরও এক ধাপ বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে এল মার্কিন মহাকাশ পর্যটন প্রতিষ্ঠান ব্লু অরিজিন (Blue Origin)। কোম্পানিটি ৮ অক্টোবর সফলভাবে সম্পন্ন করেছে তাদের ১৫তম মহাকাশ পর্যটন মিশন।
এই অভিযানে তাদের সাব-অরবিটাল রকেট নিউ শেপার্ড এর মাধ্যমে ছয়জন সাধারণ নাগরিক পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের শেষ প্রান্তে ভ্রমণের অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
এই যাত্রা কেবল প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়, বরং এটি ইঙ্গিত দেয় যে মহাকাশ ভ্রমণ আর বিজ্ঞানীদের একচেটিয়া বিষয় নয়- বরং সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার অংশ হতে পারছেন। ব্লু অরিজিন গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ধাপে ধাপে এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এনএস-৩৬: ১৫তম ফ্লাইটে ছয়জন মহাকাশ পর্যটক
নিউ শেপার্ড এনএস-৩৬ (NS-36) মিশনে ছয়জন যাত্রী অংশ নেন, যারা বিশ্বের বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, জেফ এলগিন, ফ্র্যাঞ্চাইজি নির্বাহী, ডান্না কারাগুসসোভা, মিডিয়া উদ্যোক্তা (কাজাখস্তানের প্রথম নারী মহাকাশযাত্রী), ক্লিন্ট কেলি তৃতীয়, বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী, অ্যারন নিউম্যান, সফটওয়্যার উদ্যোক্তা ও লেখক, ভিটালি অস্ত্রভস্কি, ইউক্রেনীয় বিনিয়োগকারী, উইল লুইস, ইনসমেডের সিইও ও চেয়ারম্যান।
টেক্সাসের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে রকেটটি আকাশে উড়ে যায় নির্ধারিত সময় অনুযায়ী। উৎক্ষেপণের পর রকেটটি কারম্যান রেখা অতিক্রম করে, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশের সীমানা হিসেবে ধরা হয়। সর্বোচ্চ প্রায় ৬৬ মাইল (১০৬ কিলোমিটার) উচ্চতায় পৌঁছানোর পর যাত্রীবাহী ক্যাপসুলটি মূল রকেট থেকে আলাদা হয়। এই উচ্চতায় যাত্রীরা কয়েক মিনিটের জন্য সম্পূর্ণ ভারহীনতার (Zero Gravity) অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পান, যা মহাকাশ ভ্রমণের অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত।
কারাগুসসোভা: কাজাখস্তানের প্রথম নারী মহাকাশযাত্রী
এই মিশনের অন্যতম আলোচিত নাম ছিলেন ডান্না কারাগুসসোভা, যিনি কাজাখস্তান থেকে মহাকাশে যাওয়া প্রথম নারী হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন। মিডিয়া উদ্যোক্তা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত কারাগুসসোভা মহাকাশে পৌঁছেই আনন্দে বলে উঠেন, “ওহ মাই গড, ওহ মাই গড!” যা লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এই অর্জন কাজাখস্তানের মহাকাশ ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। তাঁর এই ভ্রমণ প্রমাণ করে যে মহাকাশে যাওয়া কেবলমাত্র পেশাদার নভোচারীদের জন্য নয়; বেসরকারি খাতের ব্যক্তিরাও এখন মহাকাশ অভিযানের অংশ হতে পারছেন।
অন্যদিকে, ক্লিন্ট কেলি তৃতীয়-এর জন্য এটি ছিল দ্বিতীয় মহাকাশযাত্রা। তিনি ২০২২ সালের আগস্ট মাসে NS-22 মিশনে অংশ নিয়েছিলেন। ধারাবাহিকভাবে মহাকাশ পর্যটনে তাঁর অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে সাব-অরবিটাল ফ্লাইট এখন পুনরাবৃত্তিযোগ্য ও তুলনামূলকভাবে নিরাপদ অভিজ্ঞতা হয়ে উঠছে।
১০ মিনিট ২১ সেকেন্ডের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা
এই মিশনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্মরণীয় ভ্রমণকাল। উৎক্ষেপণ থেকে অবতরণ পর্যন্ত পুরো যাত্রা স্থায়ী ছিল ১০ মিনিট ২১ সেকেন্ড। এই সময় যাত্রীরা কয়েক মিনিটের জন্য সম্পূর্ণ ভারহীনতার অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
ভারহীন অবস্থায় ক্যাপসুলের ভেতরে ভেসে বেড়ানো, জানালা দিয়ে মহাকাশের অন্ধকারে ভাসমান পৃথিবীর নীল আভা দেখা, এগুলো যাত্রীদের কাছে জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকে। এরপর ক্যাপসুলটি ধীরে ধীরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে এবং নিরাপদে অবতরণ করে টেক্সাসে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘নিউ শেপার্ড’
ব্লু অরিজিনের এই সাফল্য হঠাৎ আসেনি। অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস ২০০০ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে মহাকাশ পর্যটনকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করে আসছে।
নিউ শেপার্ড রকেটটি বিশেষভাবে সাব-অরবিটাল ভ্রমণের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি পুনঃব্যবহারযোগ্য হওয়ায় একাধিকবার উৎক্ষেপণ ও অবতরণ সম্ভব, যা খরচ অনেক কমিয়ে আনে। এ কারণেই মহাকাশ ভ্রমণ ধীরে ধীরে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে।
এই ১৫তম সফল ফ্লাইট প্রমাণ করে যে ব্লু অরিজিন শুধু বাণিজ্যিক দিক থেকে নয়, প্রযুক্তিগতভাবেও মহাকাশ পর্যটনে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে তারা আরও বড় ও দীর্ঘ মেয়াদি মহাকাশ ভ্রমণের পরিকল্পনাও করছে। সূত্র: সিএনএন, দ্য ভার্জ, রয়টার্স