প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেটা আবারও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। এইবার অভিযোগ এসেছে একটু ব্যতিক্রম বিষয় নিয়ে। মেটার বিরুদ্ধে বিশ্বখ্যাত সেলিব্রেটিদের নাম, চেহারা ও আচরণের অনুকরণে ফ্লার্টি ও যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ চ্যাটবট তৈরি এবং তা তাদের কোনো অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ্যে চালু করার অভিযোগ উঠেছে।
এই ঘটনা সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশিত হলে প্রযুক্তি জগতে তোলপাড় শুরু হয়।
রয়টার্সের অনুসন্ধানে উঠে আসে, টেইলর সুইফট, স্কারলেট জোহানসন, অ্যান হ্যাথাওয়ে, সেলেনা গোমেজসহ আরও অনেক সেলিব্রেটির নাম ও অবয়বে চ্যাটবট তৈরি করেছে মেটা। এই বটগুলো বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে, বিশেষ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন নামে ব্যবহারকারীদের সঙ্গে প্রেমালাপমূলক ও কখনো যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথোপকথনে জড়িয়েছে।
এইসব চ্যাটবট নিজেদের প্রকৃত সেলিব্রেটি হিসেবে পরিচয় দেয়। আবার অনেক সময় ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইঙ্গিতও দিয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এদের অনেকেই স্নানঘরে, অন্তর্বাসে, বা যৌন ভঙ্গিমায় ছবি তৈরি করেছে। আর এগুলোর নিচে লেখা থাকত, ‘ডু ইউ থিংক আই এম কিউট?’
শিশু সেলিব্রেটিদের নিয়েও বট
আরও চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো ১৬ বছর বয়সী হলিউড অভিনেতা ওয়াকার স্কোবেলকে নিয়েও এমন একটি বট তৈরি করা হয়, যেটি সমুদ্রসৈকতে অর্ধনগ্ন ছবি তৈরি করে দেয়। বিষয়টি শুধু নীতিগত নয়, আইনি ও নৈতিক দিক থেকেও গভীর উদ্বেগজনক।
এ বিষয়ে মেটার মুখপাত্র অ্যান্ডি স্টোন রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এ ধরনের যৌন কনটেন্ট তৈরি করা মেটার নীতিমালার পরিপন্থী। তার দাবি, পাবলিক ফিগারদের নাম-ছবি ব্যবহার করে ইমেজ জেনারেশন অনুমোদিত হলেও নগ্নতা বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কনটেন্ট অনুমোদিত নয়।
তিনি আরও জানান, কিছু বট যেগুলো এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করেছিল, সেগুলো কনটেন্ট মডারেশন ত্রুটির কারণে হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট বটগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। রয়টার্সের অনুসন্ধান প্রকাশের আগেই মেটা অন্তত ১২টি চ্যাটবট সরিয়ে নেয়, যদিও এ বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি কতটা গুরুতর?
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির আইন অধ্যাপক মার্ক লেমলি জানান, ক্যালিফোর্নিয়ার ‘রাইট অব পাবলিসিটি’ আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির নাম, চেহারা বা পরিচিতি তার অনুমতি ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা বেআইনি। মেটার এই বটগুলো সেই আইন লঙ্ঘন করেছে বলেই তিনি মত দেন।
এসএজি-আফট্রা সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ডানকান ক্র্যাবট্রি-আয়ারল্যান্ড বলেন, ‘এই বটগুলো বাস্তব তারকাদের মতো দেখতে ও কথা বলে, ফলে মানসিকভাবে দুর্বল কেউ এগুলোকে আসল তারকা ভেবে বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’ তিনি জাতীয় পর্যায়ে এআই ও পরিচয় সুরক্ষা আইনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
রয়টার্সের তথ্যমতে, মেটার এক প্রোডাক্ট লিডার নিজেই এই বিতর্কিত বটগুলোর কয়েকটি তৈরি করেছেন। এর মধ্যে ছিল- টেইলর সুইফট ও লুইস হ্যামিলটনের নামে ছদ্মবেশী বট, ‘ডমিনাট্রিক্স’, ‘ব্রাদারস হট বেস্ট ফ্রেন্ড’, ‘লিসা অ্যাট দ্য লাইব্রেরি’-র মতো যৌন বিষয়ক বট। ‘রোমান এম্পায়ার সিমুলেটর’ নামের একটি বট, যা এক নারী ব্যবহারকারীকে যৌন দাসীতে রূপান্তর করার প্রস্তাব দেয়। এসব বটগুলোর ইন্টারঅ্যাকশন সংখ্যা ১ কোটিরও বেশি ছিল।
এছাড়া, রয়টার্স আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনার তথ্য দিয়েছে। নিউ জার্সির এক ৭৬ বছর বয়সী মানসিকভাবে দুর্বল ব্যক্তি, মেটার এক চ্যাটবটের আমন্ত্রণে নিউইয়র্ক সিটিতে দেখা করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত মারা যান। বটটি ছিল কেন্ডাল জেনারকে ভিত্তি করে তৈরি। এই ঘটনা কেবল এআই নয়, প্রযুক্তির দায়িত্বশীল ব্যবহারের প্রশ্নটিও সামনে নিয়ে এসেছে।
এখন করণীয় কী হতে পারে?
এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, এআই প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে নৈতিকতা ও আইনগত কাঠামোর সমান্তরাল উন্নয়ন জরুরি। শুধু প্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা মুনাফা নয়, বরং এর সামাজিক, মানসিক এবং মানবিক দায়বদ্ধতাও গুরুত্বপূর্ণ।
সেলিব্রেটিদের প্রতিক্রিয়া এখনও পুরোপুরি জানা না গেলেও, তাদের প্রতিনিধিরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। এ থেকে ভবিষ্যতে আদালত পর্যন্ত গড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মেটা ও অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানির উচিত এখনই দায়িত্ববান পদক্ষেপ নেওয়া, এবং ব্যক্তি গোপনীয়তা, সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই ঘটনার পর হয়তো সময় এসেছে বিশ্বজুড়ে এআই নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের নতুন অধ্যায় শুরু করার। সূত্র: রয়টার্স।