কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি নিয়ে এখন কম-বেশি সবাই কথা বলছেন। বিশেষ করে শিক্ষায় এর ব্যবহার নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই। তবে বেশিরভাগ আলোচনায় কেন্দ্রে থাকে শিক্ষার্থীরা। তারা এআই ব্যবহার করে হোমওয়ার্ক করে, নকল করে, কিংবা চটজলদি গবেষণা সারতে চায়। এতে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা কমছে কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
কিন্তু শিক্ষকরা? তাঁরা কীভাবে এআই ব্যবহার করছেন? সহায়ক হিসেবে না কি বিকল্প হিসেবে? এ বিষয়ে নজরকাড়া একটি গবেষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এআই কোম্পানি অ্যানথ্রোপিক।
এখানে আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করব শিক্ষকেরা এআই কীভাবে ব্যবহার করছেন। তারা কোন কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। আর কাজ করতে গিয়ে কোনটায় দ্বিধায় ভুগছেন। সেসাথে এটি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কী বার্তা বহন করে।
গবেষণার কাঠামো ও পদ্ধতি
অ্যানথ্রোপিকের গবেষণাটি হয় ২০২৫ সালের মে ও জুন মাসে। গবেষণাটিতে তারা তাদের চ্যাটবট ক্লাউড ডট এআই ব্যবহার করা ৭৪ হাজার সংলাপ বিশ্লেষণ করেছে। সংলাপগুলো এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ইমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে।
এই সংলাপগুলোতে পাওয়া গেছে, সিলেবাস তৈরি, অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন, শিক্ষার্থী ফিডব্যাক ও গবেষণা সংক্রান্ত আলোচনা। এই তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম দপ্তরের ওএনইটি ডেটাবেইস অনুযায়ী শিক্ষাগত পেশাজীবীদের কাজের তালিকার সঙ্গে। পাশাপাশি, নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষককে নিয়ে জরিপও করা হয়।
এআই ব্যবহার কোথায় বেশি?
গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষকেরা এআই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন পাঠ্যক্রম উন্নয়ন এবং গবেষণায়। পাঠ্যক্রম উন্নয়নে ৫৭%, একাডেমিক গবেষণায় ১৩%, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে (গ্রেডিং, ফিডব্যাক) ৭%, প্রশাসনিক কাজে (রেকর্ড, ভর্তি, বাজেট) উল্লেখযোগ্য হারে, শিক্ষণ ও নির্দেশনায় সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এই তালিকা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, যেখানে কাজ বেশি যান্ত্রিক বা সময়সাপেক্ষ, সেখানে শিক্ষকরা এআইকে স্বয়ংক্রিয় সহকারী হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহী।
শিক্ষকের ক্লাসরুমে এআই, সহযোগী নাকি বিকল্প?
অ্যানথ্রোপিক উল্লেখ করেছে, ব্যবহারকারীরা সাধারণত এআইকে সহকারী হিসেবে ব্যবহার করতে চান, কিন্তু স্বয়ংক্রিয়করণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এই দ্বন্দ্ব অনেক বেশি। যেমন, গ্রেডিংয়ে। এ বিষয়ের ক্ষেত্রে মানবিক বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত দরকার, সেখানে ৪৮.৯% ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা গ্রেডিংয়ের কাজ এআইয়ের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন।
অথচ জরিপে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ শিক্ষক বলেছেন, এআইকে মূল্যায়নে সবচেয়ে কম কার্যকর মনে করেন।
একজন শিক্ষক বলেছেন, “শিক্ষার্থীরা এআইয়ের সময়ের জন্য টিউশন ফি দেয় না, তারা আমার সময়ের জন্য দেয়। আমার নৈতিক দায়িত্ব, আমি নিজে ফিডব্যাক দিই, যদিও এআই সহযোগিতা করতেই পারে।” এই মন্তব্যটা শুধু এআই নিয়ে নয়, বরং শিক্ষকের ভূমিকাকে কেন্দ্র করেই বড় প্রশ্ন তোলে।
শিক্ষক কি শুধুই ব্যবহারকারী?
না, শিক্ষকরা শুধু এআই ব্যবহার করেই থেমে থাকেননি। কোডিং না জেনেও অনেকে নতুন নতুন এআই টুল নিজেরাই তৈরি করছেন।
অ্যানথ্রোপিকের আর্টিফেক্ট নামক ফিচার ব্যবহার করে শিক্ষকরা তৈরি করছেন, শিক্ষামূলক গেম, ডেটা ভিজুয়ালাইজেশন, একাডেমিক ক্যালেন্ডার, মূল্যায়ন টুল, বাজেট পরিকল্পনা। এর মানে, শিক্ষকরা প্রযুক্তিকে নেতৃত্বে নিয়ে আসছেন, শুধু অনুসরণে নয়।
মূল্যায়নে এআই: ঝুঁকি ও নৈতিকতা
অ্যানথ্রোপিক স্পষ্টভাবে বলেছে, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের মতো সংবেদনশীল কাজ এআই দিয়ে করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এ কাজগুলোতে ব্যক্তি মূল্যায়ন, প্রসঙ্গভিত্তিক বিচার, মনস্তাত্ত্বিক সহানুভূতি-এই সবই জরুরি, যা এখনো এআই দিতে পারে না। তবুও কিছু শিক্ষক সময় বাঁচাতে এআই ব্যবহার করছেন গ্রেডিং বা ফিডব্যাকে, আর এখানেই উঠছে নৈতিকতার প্রশ্ন। এটা কি সুবিধা নাকি দায়?
এআই টুলের বাজার প্রসার
এআই কোম্পানিগুলোর চোখ এখন শিক্ষাক্ষেত্রে। তারা আনছে শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি টুল। অ্যানথ্রোপিক: ক্লাউড কোড লার্নিং মোড, ওপেনএআই: স্টাডি মোড, স্পেসিফাই: টেক্সট-টু-পডকাস্ট, গুগল: শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি এআই টুলস। এটা স্পষ্ট, আগামী বছরগুলোতে এআই শিক্ষার প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করতে চলেছে।
কে দেবে নিয়ন্ত্রণের উত্তর?
এই টুলগুলোর ব্যবহার কি শুধু শিক্ষকের বিবেচনার ওপর থাকবে? না কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালা বা গাইডলাইন তৈরি করবে? এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে শিক্ষকের বিবেচনাই নিয়ন্ত্রণের জায়গায় দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু টুল যেহেতু সহজলভ্য, তাই সীমিত নিয়ন্ত্রণেই সব চলবে।
শিক্ষকত্বের ভবিষ্যৎ ও এআই
এই গবেষণা আমাদের দেখিয়েছে, শিক্ষকরা এখন এআইকে সহযোগী হিসেবে দেখতে আগ্রহী, কিন্তু নির্ভর করতে চান না। যেখানে চিন্তা, বিশ্লেষণ, সহানুভূতি-এই গুণগুলো দরকার। আর এই জায়গায় মানুষের বিকল্প এখনো হয়নি। তবে এটাও স্পষ্ট যে, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষকের কাজের ধরন বদলাচ্ছে। এখন তিনি কেবল জ্ঞান বিতরণকারী নন, বরং প্রযুক্তি ব্যবস্থাপক, চিন্তার অংশীদার, ডিজিটাল উদ্ভাবকও। সূত্র: জেডনেট ডট কম