ইন্টারনেটের দাম কমানোর পাশাপাশি দেশীয় কন্টেন্ট বাড়ানো এবং টেকসই ব্যবসায় বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে চায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন (বিটিআরসি)। সেই লক্ষ্য বাস্তাবায়নে সোমবার আগারগাঁওয়ে কমিশনের সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো বিকাশমান টেলিযোগাযোগের শক্তিতে বাংলাদেশের ডিজিটাল সেবার সম্পসারণ নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক। বৈঠকে দেশের বিকাশমান ডিজিটাল সেবা উদ্যোক্তা, ব্যাংকার ও অপারেটর উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সাধারণের ক্ষমতায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল সেবার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ‘যে সেবা যেই নেটওয়ার্কের জন্য ভালো হবে সেটিই উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, আমার ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ডেটা ও সাইবার সুরক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। তাই গত ১০ বছরের যে বৈষম্য রয়েছে তা খুঁজে বের করছি। সময়ের চাহিদা মেটাতে ডেটার স্বাতান্ত্রতা, ইন্টার অপারেটেবলিটি গুরুত্বপূর্ণ। এস্তোনিয়া ও তুরস্কের মতো আমরাও ডেটার অ্যাকসেস বিষয়ে উদার হতে চাই।
আমদানিকৃত কিংবা অবৈধ পথে আসা ফোনের দামের চেয়ে দেশে তৈরি মোবাইল ফোনের দাম বেশি হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ববহ বলে মত দিয়েছেন আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী জানিয়েছেন, দাম কমার কারণে সেই ফোনটাই কিনেছেন তিনি। আর এই ফোনগুলো বাংলাদেশের নেটওয়ার্কে সচল হওয়ার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন বিটিআরসি চেয়ারম্যন এমদাদ উল হক।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, গ্রে ফোন না এলে দাম কমবে না বাড়বে? বেশিরভাগই উত্তর দিলেন, বাড়বে। তাই জলের দামে হ্যান্ডসেট দিতে চাই। বিটিআরসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমাদের এবং বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে বড় পরিবর্তন হলো আজকের প্রজন্ম মাল্টি টাস্ক করে। তাদের মতো আমাদের দ্রুত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। আমাদের সময় মন ও যোগাযোগ ছিলো সিম্পল। এখন সেটা অনেক জটিল। কানেক্টিভিটিতে ব্যবসা ভয়েসে। তাই আমরা ভয়েস বেইস নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছি। সময়ের প্রয়োজনে অতিরিক্ত লাইসেন্স দেয়া ও লেয়ারের পর লেয়ার তৈরি করে নেটওয়ার্কর্কে টুকরা-টুকরা করায় ব্যবসায় সফল হয়নি। এই খাতটি হেভি ক্যাপেক্স হয়ে গেছে। কিন্তিু এই ইন্টারনেট বাতাসের মতো ফ্রি হওয়া উচিত। ডাটাকে জলের দামে আনতে হলে। ডিজিটাল সেবা বাড়লে এই নেটওয়ার্ক সচল হবে। এ জন্য প্রচুর ডাটা সেন্টার দরকার। অ্যাডভান্স লেভেলের ফিনটেক দরকার। একইসঙ্গে আরবান টু লোকালে এক দেশ এক রেটের গ্যাপ তুলে ধরতে হবে। এ জন্য সবাই সমন্বিত ভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, রেভিনিউ সৃষ্টি বিটিআরসি’র কাজ নয়। বিটিআরসি শুধু সংগ্রাহক। প্রতিযোগিতার জন্য বিটিআরসি ফ্লোর প্রাইস বেধে দেয়। কিন্তু জটিল প্রযুক্তি জীবনকে সহজ করে। কিন্তু এখাতে ব্যবসা ধরে রাখতে একটি ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। প্রো-অ্যক্টিভ রেগুলেশন নিয়ে কাজ করতে হবে।
টেলিকম বিশেষজ্ঞ মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিটিআরসি চাইলেই বিভিন্ন খাতের সেবা সুলভ করতে দায়িত্ব নিতে পারে। ডেটার ডুপলিকেশন বন্ধে দায়িত্ব নিতে হবে। নির্ভরযোগ্য ডেটা সেট প্রকাশে দায়িত্ব নিতে হবে। এছাড়াও এমএফএস সেবার অধিকার টেলকোকেও দেয়া দরকার।
বিটিআরসি পরিচলাক (এসএম) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মনিরুজ্জামান বলেন, এক ধাপ এগিয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে যেতে হয়েছে এনইআইআর চালু করার বিষয়টি। আশা করছি কয়েক মাসের মধ্যেই এটি ফের চালু হবে। ডেটার ব্যবহার বাড়াতে ভল্টিকল নিয়ে কাজ করছি।
এমআইএসটি’র সাবেক অধ্যক্ষ মেজর জেনারেল ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এআই ভিত্তিক সল্যুশন ইআরপি বা স্বাভাবিক কোনো সেবা নয়। এই বাজারটা এখনো প্রস্তুত নয়। চ্যাটজিপিটি একাই এ কাজ করছে। এআই এর খাদ্য হচ্ছে ডেটা। তাই ডেটা শেয়ারের একটি প্লাটফর্ম থাকা দরকার।
ব্র্যাক ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) সাব্বির হোসেন বলেন, ইউএসডি ব্যহারে এসএমএস খরচ কমানো দরকার। টোল ফ্রি লাইন দ্রুততার মধ্যে নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। যেকোনো আপদকালীন সময়ে কীভাবে ডিজিটাল সেবা চালু রাখা যায় সে বিষয়ে রেগুলশন প্রত্যাশা করি।
দারাজ বাংলাদেশের প্রধান কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস বলেন, ডিজিটাল সেবাই ভবিষ্যত। তাই এসএমইদের মধ্যে ইন্টারনেট ডেটার সুযোগ করে দিতে সেবা সাবসক্রিপশনে ছাড় দেয়া দরকার। অ্যাপে আইপিফোন ব্যবহারের বিষয়টি সহজতর করা দরকার।
এইটিটিপুল বাংলাদেশের মুনাফ মুজিব চৌধুরী বলেন, ডেটার অ্যাকসেস এর সঙ্গে এর মিনিংফুল ব্যবহারের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। ডেটা ব্যবহার করে আমরা কোন সার্ভিসে ভালো হবে সে বিষয়টিই জানে না অনেকে। বাংলাদেশের সঙ্গে মেটা বা ফেসবুকের সম্পর্ক খুব খারাপ। অথচ বাংলাদেশে ফেসবুকের বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনের বাজার। তাই বিটিআরসি এই খাতের ভালো-মন্দের বিষয়টির নিবিঢ় গবেষণা ও সৃজনশীল সমাথারের তিবে নজর দিতে হবে।
শেয়ার ট্রিপ সিইও সাদিয়া হক বলেন, উদ্যোক্তা ইকোসিস্টেমে থাকা ব্যবসায়ীরা এখন ফান্ড রেইজের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ডেটার সঙ্কট নিয়ে আমরা ভুগছি। ভ্রমণে ডিজিটাল সেবা অন্তর্ভূক্তিও এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ইন্টারনেট এড্যুকেশনের ওপর সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।
পাঠাও সিইও ফাহিম আহমেদ বলেন, বিগত সরকারের সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পাশাশি ১৫ দিন বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ ছিলো। ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করে। সেই সময় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। তাই ডেটার লোকালাইজেশনের সঙ্গে ডেটা প্রোটেকশন ও কঞ্জিমার্স প্রোটেকশন নিয়ে আমাদের বেশি নজর দেয়া দরকার।
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, আমরা নিজেদের প্লাটফর্মে বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা যুক্ত করেছি। কিন্তু সেবা গুলো একেক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তাই বিষয়টি বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন ডিজিটার সেবাদাতাদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যেতে চাই। তাই নীতামালার ভার্টিকাল রিফর্মেশন দরকার।
শিখো প্রতিষ্ঠাতা শাহির চৌধুরী বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিলো শিক্ষা থেকে শেষ হয়েছে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন নিয়ে। অপারেটরদের অবকাঠামোর উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া দরকার। তারা শিক্ষা কিংবা বিনোদনের কাজ করবে না। বৈষম্য দূর করতে ডিজিটাল সেবার বিকল্প নেই। একইসঙ্গে ডিজিটাল সেবা গ্রহণে নাগরীকদের অভ্যস্ত করে তোলাও আমাদের দায়িত্ব।
সেবা এক্সওয়াইজেড সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইলমুল হক সজীব বলেন, বৈষম্য বিজয়ের সুফল সব জায়গায় পৌঁছায়নি। এ কারণেই জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি। সঠিক ডেটা আমাদের তুলে ধরা দরকার। ঢাকার অনেক জায়গাতেই আমরা ভালো ইন্টারনেট পাইনা। রিয়েল প্লেয়ারদের সঙ্গে বসে ইন্টারনেটের খরচ কমাতে হবে।
প্রাভা হেলথের টেকনোলজি অফিসার সাবরিনা ইমাম বলেন, ঢাকার বাইরে টেলিমেডিসিন সেবা দেয়াটা কঠিন। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের দাম একটি বড় বাধা।
বিটিআরিস ভাইস প্রেসিডেন্ট আমিনুর রহমান, কমিশনার মুশফিক মান্নান, গ্রামীণ ফোনের হেড অব ডিজিটাল চ্যানেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন জাহিদ জামান প্রমুখ এসময় বক্তব্য দেন।