জিপিটির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে সচেতনতা গড়ার তাগিদ

প্রকাশ: শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি, ২০২৫
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png নিজস্ব প্রতিবেদক
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, উভয় ক্ষেত্রের একই সুর সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হলে স্বাস্থ্য খাতে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তথ্যপ্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ফলে তৃণমূলে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির পাশাপাশি চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীদেরও জেনেরেটিভ এআই বা জিপিটি ব্যবহারে সচেতনতা গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্বারোপ করলেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, দেশের চিকিৎসা সেবায় বিদ্যমান গ্রাম ও শহরের জনপ্রতি চিকিৎসক-রোগীর অনুপাতের বৈষম্য ঘুচে দিয়ে, স্বাস্থ্য তথ্যের গোপনীয়তার সুরক্ষা এবং লজ্জা, ভয়, সংশয় ঘুচে দিয়ে একটি সুষম রসায়ন হতে পারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (AI)। জিপিটি ও অন্যান্য নতুন স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে শহরের ডাক্তারের কাছাকাছি মানের চিকিৎসা পরামর্শ দিতে পারেন গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা (কমিউনিটি চিকিৎসক বা ফার্মেসি কর্মী)। তাই তাদের মধ্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা উন্নয়ন এবং রোগীদেরও এটি ব্যবহারে সচেতন করা দরকার।

এক্ষেত্রে চিকিৎসা সেবাকে কেবল মৌলিক অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তা পূরণে আইনি বাধ্যবাধকতার অধীনে আনতেও গণস্বাস্থ্য সেবাকে কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট এবং এই সেবা প্যাকেজটি নতুন করে সঙ্গায়ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রতীক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও অন্তবর্তী সরকারের স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার কমিশনের সদস্য লিয়াকত আলী।

তিনি বলেন, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্যাকেজকে ট্রেডিশনাল মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু এবং চাইল্ড কেয়ারের বাইরে এনে সেখানে এনসিডি কেয়ার এবং অন্যান্য বিষয়গুলো ইনক্লুসিভ করে ইমার্জেন্সি কেয়ার প্যাকেজের আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্রকে এই দায় নিতে বাধ্য করতে হবে। সংবিধানে মৌলিক অধিকার বিষয়ে একটি ট্রিক্স আছে। সিডিউল ২-এ এই মৌলিক অধিকারকে রাষ্ট্রের একটি নীতি হিসেবে লেখা আছে। একইসঙ্গে খুব সাবধানে প্রথমদিকে লিখে দেয়া হয়েছে- দিজ আর নট জুডিশিয়ালি ইনফোরসেবল। ফলে অধিকার না পেলেও আপনি বিচার চাইতে পারবেন না। তাই জুডিশিয়ালি না হলেও কতটা অবলিগেশন তৈরি করা যায় সেটােই আমাদের প্রধান টার্গেট হওয়া দরকার।

ডিজিটাল বৈষম্য বিষয়ে সতর্ক করে তিনি আরো বলেন, ট্রেডিশনাল সিস্টেম দিয়ে প্রেডিক্টিভ এআই এর ব্যবহার আমি আগে থেকেই জানি। তবে কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার এবং ফার্মেসিতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা বিদ্যমান ৬০ শতাংশ জনস্বাস্থ্য কর্মীর ঘাটতি দূর করে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরে সক্ষম হবো। এআই প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের অনেক কিছুই সহজ করে দেবে।

তবে স্বাস্থ্যখাতে জিপিটি ব্যবহারের রেগুলেটরি ম্যাকানিজম তৈরি করতে তাগাদা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, রেফার্ড ওপিডি এবং জেনারেল আইপিডি’র জন্য নাগরিকদের স্বাস্থ সেবা চাহিদা প্রাপ্তির ক্ষমতায়ন গড়ে তুলতে হবে। এজন্য একটি হেলথ কার্ড করতে হবে যেখানে রোগীর জন্য বান্ডেল সার্ভিস ফ্যাসিলিটি রাখতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার: ‘সুশাসন ও প্রযুক্তির ব্যবহারে উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ নিয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শুক্রবার অনুষ্ঠিত সভায় এসব কথা বলেন তারা।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান ‘ভয়েস ফর রিফর্ম’ সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুরের সঞ্চালনায় সভায় স্বাস্থ্য খাতে এআই প্রযুক্তির টেকসই ব্যবহার এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা নিয়ে তিনটি বিষয় ভিত্তিক উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়। উপস্থাপনায় কোনো প্রযুক্তি বিশেষ করে এআই নিজে কোনো সল্যুশন নয় বরং এটি সমাধানের পথ সৃষ্টি করে বলে মন্তব্য করেন ডিজিটাল স্বাস্থ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এমপাওয়ার সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ জিয়ন’র সহ-উদ্যোক্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের এনএস নেটওয়ার্ক এর গ্লোবাল হেলথ পোন্টফোলিও ডিরেক্টর রুবায়েত খান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে হলিস্টিক সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা দিতে হলে এআই বা জিপিটি হতে পারে অন্যতম অনুষজ্ঞ। ইতিমধ্যেই ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে রেডিওলজি প্লেট বা এক্সরে ডিটেক্ট করতে পারে এআই। এখন রিয়েল টাইম আল্ট্রা সাউন্ড বিশেষ করে বাটার ফ্লাই মেশিনেওে এআই ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। দেশের ১২ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য তথ্য রেকর্ড করে এখন আমরাই প্রেগনেন্সি রিলেটেড অসুখ নিরুপন এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি নির্ণয় আগাম নির্ণয় করতে সক্ষম হচ্ছি।

এছাড়াও স্বাস্থ্য খাতে যেকোনো সংস্কারের আগে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গুরুত্বারোপ করে বিশদ উপস্থাপনা পেশ করেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌফিক জোয়ারদার। তিনি বলেন, প্রাথমিক ভাবে ব্যবহৃত প্রযুক্তির পরবর্তী সংস্করণ আমরা ব্যবহারে সক্ষম হবো কি না এসব বিষয় আগে খতিয়ে দেখতে হবে। এছাড়াও একই প্রযুক্তি যখন একাধিক প্রতিষ্ঠান করে তখন তাদের একে অপরের মধ্যে সমন্বয় দরকার। এজন্য এগুলো নিয়ন্ত্রণে ভোক্তার আস্থায় এনে সঠিক চ্যানেলে বাস্তবায়নের বন্দোবস্ত করতে হবে।

অপরদিকে আলো’র ৬টি ক্লিনিকে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ভিত্তিক স্বাস্থ সেবা উদ্যোগ ‘সুস্বাস্থ্য এআই’ মডেলে রেফারেল সিস্টেমের বিষয় তুলে ধরেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন।

তিনি বলেন, বিল অ্যান্ড গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে আমরা ইতিমধ্যেই একটি বাংলা মেডিকেল জিপিটি তৈরি করেছি। এটি বয়ঃসন্ধিকালীন যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা দেয়। যেহেতু এই বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে শরম পায়, তাই এই মোবাইল অ্যাপটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এখন আমরা চিকিৎসক ও রোগীর কথোপকথন থেকে জিপিটির মাধ্যমে মেডিকেল স্ট্রাইভিং সিস্টেমে প্রেসক্রিপশন অডিট করার সুবিধা নিয়ে কাজ করছি। এটি চিকিৎসককে রোগীকে ভুল চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক করবে।

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করা বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ আলোচনায় অংশ নেয়।

সভায় জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইডিসিআর) সাবেক উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সাইফুদ্দিন কিসলু, সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ককাজী সাইফুদ্দিন বেন্নুর, বায়ো বায়ো ওয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফখর উজ জামান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস এর অধীন শেয়ার্ড হেলথ রেকর্ড প্রকল্পের সিনিয়র কনসালটেন্ট ও হেড ব্লক ফাউন্ডার আসিফ আতিক, ডিজিটাল হেলথ কেয়ার সল্যুশন ডকটাইম লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ আল মাসুম, এনজিও কর্মী শাবাব মাহমুদ, আয়াত এড্যুকেশনের চিফ অপারেটিং অফিসার তৌহিদুল ইমরান চৌধুরী, বাংলাদেশ রিসার্চ ইনফরমেশন এনালাইসিস নেটওয়ার্ক (ব্রেইন) এর রুমী আহমেদ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন প্রমুখ।

আলোচকরা মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা বিনামূল্যে নিশ্চিত করতে সরকারবে বাধ্য করার ওপর গুরুত্বারোপ করারা পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, হাসপাতাল, ঔষধ কোম্পানী ও চিকিৎসকদের মধ্যে সৃষ্ট দুর্নীতি চক্র ভাঙতে প্রযুক্তির ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করেন।

image

আপনার মতামত দিন