তিন দিনের মূল্যায়ন নিয়ে তাড়াহুড়া করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশটি নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। আইনজীবী, রাজনীতিক ও ভূক্তভোগী কেউই সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারছেন না এই আইনে। তাদের ভাষায়, অধ্যাদেশ তৈরির আগে বহুপক্ষীয় মত নেওয়া হয়েছে বলা হলেও এই আইন বেশ কিছু সাংঘর্ষিক ধারা রয়ে গেছে ঠিকই। ফলে সাইবার সুরক্ষা ও নিরাপত্তাকে গুলিয়ে ফেলে সাইবার বুলিংটিই এই আইনে অনেক সালিসী বিষয় বুমেরাং হয়ে সংযুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন তারা। কেবল সরকারি ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সাইবারা সুরক্ষা কাউন্সিল গঠনের বিধান রেখে আরেকটি এনটিএমসি গড়ে তোলা হচ্ছে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪ কে হতাশাজনক খসড়া উল্লেখ করে এই ধারার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তার মতে, ধারা ১২-তে থাকা সুরক্ষা কাউন্সিল পূর্বে সার্ভেলেন্স ছাড়া তেমন কোনো কাজ করেনি। ধারা ১৭-১৯ এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশ বিষয়টিও নিরপেক্ষ সালিশী বিষয়। এখানে কে, কেন, কিভাবে করবে সেটা স্পষ্ট নয়। ১৮ ধারাকে হ্যাংকিংয়ের অধীনে আনা হলেও পজেটিভ হ্যাংকিংয়ের বিষয় অন্তর্ভূক্ত হয়নি। ১৯ ধারায় ভৌত কাঠামোর ক্ষতি সাধন আগের আইনের মতোই। ধারা ২৫-এ ভাষাটা চমৎকার হলেও অপমান, হয়রানি, ব্লাকমেইল বা হেয় প্রতিপন্ন করার ক্ষেত্রে ‘শৈল্পিক ও শিক্ষগত মূল্য নেই’ জুড়ে দিয়ে বুমেরাং করা হয়েছে। একইভাবে ব্যক্তির সমাজিক মর্যাদাহানীকর লিখে মানহানির মতো সিভিল অফেন্সকে ক্রিমিন্যাল অপরাধে চালান করা হলো।
অধ্যাদেশের ২৬ ধারাটি আগের ৫৭ ধারাতেও ছিলো এবং এখানে শিশুর অধিকার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন ধারার সমালোচনা শেষে তিনি বলেন, শাস্তিতে ১০ লাখ টাকার দণ্ড দিলেও কারাদণ্ড কে প্যানেল আইনের শাস্তি থেকে কম করে দেড় বছর ধরা হয়েছে। কোনো নারী বা অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের জন্য শাস্তি আলাদা করে করার বিষয়টি আর্টিকেল ২৭ এর মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। আইনের ধারায় না রেখে ব্যাখ্যায় সাইবার বুলিং জুড়ে দিলেও তা এখনো প্যানাল কোডে নেই। একই ভাবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আপত্তি জানাতে বিশেষ আইনে বিচার পরবর্তী আপিলের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এর ৪১ ধারায় না থাকায় যে সুযোগ নিষ্ফল হবে। বস্তুত, আইনটিতে ব্যবহারিক বিষয় আমলে নেয়া হয়নি। ডিজিটাল সিকিউরিটির চেয়ে এর তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই এটা ফ্রাস্টেটিংলি ব্যাড ড্রাফটিং।
২৬ ধারাটি আগের ৫৭ ধারাতেও ছিলোনতুন অধ্যাদেশটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ঝুঁকির মুখেই থাকবে মন্তব্য করে এটি বাস্তবায়নের ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা নিয়ে ক্ষুব্ধ মত প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, তিনটি স্পেসকে একসঙ্গে করে এটি একটি জগাখিচুড়ি পাকানো হয়েছে। ভৌত অবকাঠামো, অনধিকার প্রবেশ ইত্যাদি বিষয় এক নয়। এই আইন বৈধ স্ক্র্যাইব-কে অবৈধ করতে পারে। তাই সাইবার সুরক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা এসব আইন আলাদা হওয়া উচিত।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নেই- এমন তীর্যক মন্তব্য করে ইন্টারনেট অধিকার নিশ্চিত করতে কে দায়বদ্ধ হবে বলে প্রশ্ন করেন এই এনজিও কর্মী। সুরক্ষা আইনটি ওয়েবে সবার জন্য উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ধারা-৮ এ ডিএসএ মহাপরিচালককে চাইলেই যে কেনো কন্টেন্ট ডিজিটাল স্পেস থেকে অপসারণ করা অধিকারের সমালোচনা করেছেন। ২৫ ধারায় অপরাধকে লেজেগোবর করা হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ ২০২৪ (খসড়া)’ রাষ্ট্রীয় নিবর্তন ব্যবস্থা বহাল ও গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতি অবজ্ঞা বিষয়ক নাগরিক সংলাপে আরো বক্তব্য দেন জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক মানবাধিকার কর্মী আইরিন খান, মানবাধিকার বিষয়ক আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার সারা হোসেন, রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের দিদারুল আলম ভূঁইয়া, রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার ফুয়াদ, রাজনীতিবিদ ববি হাজ্জাজ, ই-আরকি’র প্রধান সিমু নাসের, টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের সাবহানাজ রশীদ দিয়া, ভয়েস ফর রিফর্মের সহ-আহ্বায়ক ফাহিম মাশরুর।
আইনের বেশ কিছু ধারা সংঘর্ষিকনাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘ভয়েস ফর রিফর্ম’ আয়োজিত এবং মানবাধিকার কর্মী আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের সঞ্চালনায় এই গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, ‘সাইবার সিকিউরিটি আইন ২০১৮’ বাতিল করে “ডিজিটাল সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৪” জারি করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা জুলাই গণ-অভুথানের আকাঙ্খার সাথে বিশাল বিশ্বাসঘাতকতাI এই অধ্যাদেশে জনগণের মৈলিক মানবাধিকারের বিষয়সমূহ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছেI
বিষয়টি তুলে ধরে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক আইরিন খান বলেন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতির সংস্থার বিভিন্ন মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট কনভেনশনে বাংলাদেশ সাক্ষর করেছেI এই আইনের বেশ কিছু ধারা সেগুলোর সাথে সাংঘর্ষিকI সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠির সঙ্গে এই অধ্যাদেশের খসড়াটি মিলিয়ে দেখা যায়, একটু অদলবদল করে সেটা এই সরকারকে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। আন্তর্জাতিক আইনে সবার ওপরে থাকে মানবাধিকার। আগের সরকার এবং এই সরকারও মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করছে না, তারা নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এ দুটি বিষয় একে অপরের পরিপূরক।
আগের সরকারকে লেখা চিঠিতে তিনি যেসব সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেটা এবারও প্রযোজ্য উল্লেখ করে আইরিন খান বলেন, এখানে ভাষা অস্পষ্ট। এতে ঝুঁকি থাকে। অস্পষ্ট ভাষা যেখানে থাকে, সেখানে সরকারের ক্ষমতাসীনেরা এর অপব্যবহার করে। ভাষাকে শক্ত করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য ২৫ ও ২৬ দুটি ধারাতেই সমস্যা রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা ও এই অধ্যাদেশ পাশাপাশি রেখে দেখা যাচ্ছে, সরকারের হাতে একই রকমভাবে ক্ষমতা রয়েছে।
আইরিন খান আরও বলেন, অপতথ্য ও ভুল তথ্যের বিষয়গুলো এই অধ্যাদেশে আসেনি। এগুলো আসা উচিত। এ ছাড়া মানহানি কেন ফৌজদারি আইনে থাকবে, সে প্রশ্নও তুলে বলেন, এতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও অনেক হুমকিতে পড়বে।
অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাইবার আইনটি নিয়ে কাজ করায় সরকারকে সাধুবাদ জানান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন। তিনি বলেন, আইনটি প্রয়োজন। কিন্তু এই আইনের যে বিষয়গুলো নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে, তার প্রক্রিয়া ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে শুরু হয়েছে আইসিটি আইনের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ সরকার তা রেখে দেয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারও তা রেখে দেবে, সে আশা ছিল না। অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে সব পক্ষের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হলো কি না, সে প্রশ্ন তুলে কাদের সঙ্গে আলোচনা হলো, কারা কী সুপারিশ দিল, সেটা সবাইকে জানানো উচিত বলে মত দেন তিন।
নারী ও শিশুসহ যাদের সুরক্ষার জন্য এই আইনে নতুন কিছু ধারা যুক্ত করা হলেও অধ্যাদেশ তৈরির সময় তাদের সাথে কথা বলা হয়েছে কিনা অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন টেক পলিসি বিশেষজ্ঞ সাবহানাজ রশীদ দিয়া।
তিনি বলেন, সাইবার সুরক্ষা অবকাঠামো পর্যায়ে কাজ করে। কিন্তু সাইবার অপরাধ হয় কন্টেন্ট পর্যায়ে। তাই অনলাইন সুরক্ষা এবং সাইবার সুরক্ষা দুইটি আলাদা আইন হওয়া উচিত।
রাজনীতিবিদ দিদারুল আলম অভিযোগ করেন, আগের সাইবার নিরাপত্তা আইন দিয়ে যেসকল ব্যক্তির বিরদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে তার বেশিরভাগই এখনো প্রত্যাহার করা হয় নাই, যদিও অনেক উপদেষ্টা ও বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সেগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে।
রাজনীতিবিদ ববি হাজ্জাজ বলেন, একটি ব্যাঙ্গ কার্টুন আঁকলে যদি এক লাখ টাকার জরিমানা হয় তাহলে তো আমি যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়ে মজা করতে পারি। এই ধরনের আইন নতুন বাংলাদেশে বাস্তবায়ন আমরা চাই না। কেননা আইনের ব্যবহার বা প্রয়োগ আইনের জায়গা থেকে হওয়ার সংস্কার আগে দরকার।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, শেখ হাসিনার শাসনকালে খসড়ার কোন ভার্সনটা (সংস্করণ) আইন হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে থাকতে হতো। এবারও খসড়াটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তিনি আশা করেন, সরকার ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই আইন করতে যাচ্ছে। সবার পরামর্শ নিয়ে অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত হবে।
ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, আমলারা সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করছে বলেই এরকম বাজে ও গণবিরোধী একটি অধ্যাদেশ সামনে আনা হয়েছে।
ফাহিম মাশরুর বলেন, এই অধ্যাদেশের সবচেয়ে বড় খারাপ দিকটা হচ্ছে পুলিশের হাতে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারি ক্ষমতা দেওয়াI এর মাধ্যমে পুলিশকে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে সাধারণ জনগণকে হয়রানির জন্য ও চাঁদাবাজির করার। এছাড়া পুলিশ ইচ্ছা করলেই যে কারো মোবাইল তল্লাশি করতে পারবে যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও সঞ্চালক মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম বলেন, কয়েক হাজার জীবনের বিনিময়ে যে পরিবর্তন এসেছে ও তার ধারাবাহিকতায় যে নতুন সরকার এসেছে, তাদের কাছ থেকে এরকম একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অধ্যাদেশ কোনোভাবেই আশা করা যায় না। কোনোভাবেই এই অধ্যাদেশ চূড়ান্তভাবে প্রণয়ন করা যাবে না। মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সকল নাগরিকের মতামত নিয়ে নতুন করে সাইবার জগতে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বা অধ্যাদেশ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। খসড়া অধ্যাদেশটি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।