ইন্টারনেটের কি আসলেই কোনো ওজন আছে? অবাক করা হলেও সত্যি, বিজ্ঞানীদের মতে ইন্টারনেটেরও নিজস্ব ভর বা ওজন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রাসেল সিটজের গবেষণা অনুযায়ী, ইন্টারনেটের ভর ৫০ গ্রাম, যা দুই-তিনটি স্ট্রবেরির ওজনের সমান। তবে সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে ইন্টারনেটের বর্তমান ওজন আরও বেড়ে গেছে। এখন তা হতে পারে একটি মাঝারি আলুর সমান!
২০০৬ সালে রাসেল সিটজ ইন্টারনেটের ওজন নির্ধারণের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, সার্ভার চালাতে যে শক্তি প্রয়োজন, সেই শক্তির ভর হিসাব করলেই ইন্টারনেটের ভর পাওয়া সম্ভব। আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী (E=mc²), শক্তিরও ভর রয়েছে। সে অনুযায়ী, ইন্টারনেটে সংরক্ষিত ও পরিবাহিত তথ্যের শক্তি হিসাব করে তিনি ইন্টারনেটের মোট ভর নির্ধারণ করেছিলেন।
তবে ২০০৬ সালের তুলনায় এখনকার ইন্টারনেট অনেক বিস্তৃত। তখন স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ক্লাউড স্টোরেজ বা ৮কে ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের যুগ শুরুই হয়নি। বর্তমানে ইনস্টাগ্রাম, আইফোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মতো প্রযুক্তি ইন্টারনেটকে অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ এবং শক্তিনির্ভর করে তুলেছে। ফলে ইন্টারনেটের বর্তমান ভর বাড়তে বাড়তে এখন একটি মাঝারি আকারের আলুর ওজনের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইন্টারনেটের ভর বৃদ্ধি আমাদের জীবনের নানা দিককে প্রভাবিত করছে। সার্ভারের সংখ্যা বাড়ছে, শক্তি খরচ বাড়ছে এবং তার সাথে বাড়ছে পরিবেশগত চাপও। ভবিষ্যতে ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষ প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে, যাতে শক্তির ব্যবহার কমিয়ে এই ভারসাম্য বজায় রাখা যায়।
ঠিক একই সময়ে, ডিসকভারি ম্যাগাজিন ভিন্ন একটি উপায়ে ইন্টারনেটের ওজন বের করার চেষ্টা করে। তারা ধরে নেয়, ইন্টারনেটের তথ্য সংরক্ষণ হয় ইলেকট্রনের অবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে। প্রতিটি বিট তথ্য ধারণে কয়েকটি ইলেকট্রন প্রয়োজন। ডিসকভারি ম্যাগাজিনের অনুমান ছিল, ২০০৬ সালে ইন্টারনেটে মোট ৪০ পেটাবাইট (১ পেটাবাইট=১০¹⁵ বাইট) তথ্য প্রবাহ ছিল। সেই তথ্য সংরক্ষণে যত ইলেকট্রন দরকার, তাদের সম্মিলিত ভর মাত্র ০.০০০০০৫ গ্রাম-অর্থাৎ এক গ্রামের ৫০ লাখ ভাগের এক ভাগ! সহজ ভাষায়, একটি ফোঁটা স্ট্রবেরি জুসের ওজনের সমান।
তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, এই হিসাবগুলো পুরোপুরি নির্ভুল নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাসেল সিটজের ৫০ গ্রাম ওজনের হিসাব আসলে সার্ভারের চালনার শক্তির ভর, সরাসরি তথ্যের ভর নয়। অন্যদিকে, ডিসকভারি ম্যাগাজিনের হিসাবও মূলত ইন্টারনেটের তথ্যপ্রবাহের ইলেকট্রনিক গতি-প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল, ইন্টারনেটের স্থায়ী ডেটার ভর নয়।
এই বিভ্রান্তি দূর করতে এগিয়ে আসেন বেল ল্যাবসের বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার হোয়াইট। তিনি বলেন, শুধু সার্ভারের শক্তি বা শুধু ইলেকট্রনের ভিত্তিতে ইন্টারনেটের প্রকৃত ভর নির্ণয় করা যাবে না। কারণ প্রতিটি মাইক্রোচিপের বিদ্যুৎ প্রবাহ একরকম হয় না। তাই তিনি একটি ভিন্ন পদ্ধতি প্রস্তাব করেন-যদি পৃথিবীর সব তথ্য এক জায়গায় রাখা হয়, তখন সেই তথ্য সংরক্ষণের জন্য যতটুকু শক্তি খরচ হয়, সেই শক্তির ভর হিসাব করা সম্ভব হবে।
২০১৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ডেটা কর্পোরেশন (IDC) পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে ইন্টারনেটের তথ্যভাণ্ডার ১৭৫ জেটাবাইট ছাড়িয়ে যাবে। (১ জেটাবাইট = ১০²¹ বাইট)। এই বিশাল তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় শক্তির ভর হিসাব করলে দেখা যায়, তা হবে মাত্র ৫৩ কোয়াড্রিলিয়নথ (১০⁻¹⁵) গ্রাম-এতটাই সামান্য যে তা প্রায় শূন্যের সমান বলা যায়!
তথ্য সংরক্ষণের আরও উন্নত পদ্ধতি খুঁজতে বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন একটি ধারণার দিকে ঝুঁকেছেন-ডিএনএ স্টোরেজ। জীবন্ত কোষের ডিএনএ-তে বিশাল পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা রয়েছে। গবেষণা বলছে, মাত্র ১ গ্রাম ডিএনএতে ২১৫ পেটাবাইট তথ্য রাখা সম্ভব।
এই হিসাব অনুযায়ী, যদি পুরো ইন্টারনেটের ১৭৫ জেটাবাইট তথ্য ডিএনএ-তে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে সেই ডিএনএয়ের মোট ওজন হবে প্রায় ৯৬১ কেজি-প্রায় ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সমান অথবা ৬৪ হাজার স্ট্রবেরির সমান!
গবেষকরা মনে করেন, ইন্টারনেটের ভর নির্ধারণ করা অত্যন্ত জটিল কাজ। কারণ ইন্টারনেটের তথ্য বাস্তবে এক জায়গায় স্থির নয়; তা সর্বক্ষণ চলাচল করছে। আবার ডেটা সংরক্ষণ, স্থানান্তর ও ব্যবহার ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শক্তির ব্যবহার ঘটায়, যার প্রত্যেকটির ভর আলাদা। ফলে কোনো একক মাপকাঠিতে ইন্টারনেটের প্রকৃত ওজন নির্ধারণ করা এখনো সম্ভব হয়নি।
তবে একথা নিশ্চিত, ইন্টারনেটের প্রসার ও তথ্যের বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিচালনায় ব্যবহৃত শক্তি এবং পরোক্ষভাবে এর ভর ক্রমশই বাড়ছে। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ভবিষ্যতে আরও নিখুঁত পদ্ধতিতে ইন্টারনেটের প্রকৃত ভর নির্ধারণ সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইন্টারনেটের প্রকৃত ওজন নিয়ে গবেষণা এখনো চলছে। তথ্য যতই ভার্চুয়াল হোক, তার অস্তিত্ব এবং ভর বাস্তব জগতেই প্রভাব ফেলে। ভবিষ্যতে যখন ডিএনএ স্টোরেজের মতো প্রযুক্তি আরও উন্নত হবে, তখন ইন্টারনেটের ওজনের হিসাব হয়তো একেবারে নতুন রূপ নেবে। সূত্র: উইয়ার্ড ডটকম ও প্রথম আলো